Read more
মেঘদূত ও নব মেঘদূত : রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব পাঠ
‘প্রাচীন সাহিত্য' বইটিতে ‘মেঘদূত' নামে যে প্রবন্ধটি আছে সেটি অন্য প্রবন্ধগুলি অর্থাৎ রামায়ণ, কুমারসম্ভব ও শকুন্তলা, কাদম্বরীচিত্ত বা কাব্যে উপেক্ষিতা থেকে চরিত্রগতভাবে একটু আলাদা। অন্য সব কটি প্রবন্ধই কমবেশি বিশ্লেষণমূলক, ব্যাখ্যামূলক এবং কখনে হয়তো একটু বস্তুনিষ্ঠ বিশেষ সমালোচনাও বটে। কিন্তু ‘মেঘদূত' প্রবন্ধটি মূল কাব্যের বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা বা বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা একেবারেই নয়। মূল বাক্যের একটি সূত্র—বিরহ বা বিচ্ছিন্নতার সূত্রটুকু-টেনে এনে সার্বজনীন একটি মানবিক স্বভাবকে ঘিরে একটি রোম্যান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘মেঘদূত' প্রবন্ধটিকে কেন্দ্রে রেখে মেঘদূত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব পাঠের যে অভিজ্ঞতা গড়ে উঠেছে মেঘদূত-কেন্দ্রিক নানা ভাব ও চিন্তা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার কিছুটা পরিচয় নেওয়া যাক। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর পাঠ-অভিজ্ঞতার সমগ্র এই প্রবন্ধটিকে যুক্ত করে দেখতে চাই।
১৮৯০ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে একটি ঘনবর্ষণের দিনে ঝড়বৃষ্টি ও বিদ্যুতের তর্জন গর্জনের মধ্যে যখন মেঘদূত পড়ছিলেন রবীন্দ্রনাথ তখন তার মেঘমন্দ্র শ্লোকের মধ্যে যক্ষের ব্যক্তিগত চরিত্রের সঙ্গে বিশ্বের সমস্ত বিরহীকে একাত্ম করেই দেখেছিলেন তিনি। মেঘদূতের সঘনসঙ্গীতের মধ্যে সমস্ত বিরহীর শোকের অন্ধকার যেন পুঞ্জীভূত হয়ে আছে বলেই তাঁর মনে হয়েছিল। মানসী-র মেঘদূত কবিতা সেই চিরকালের অন্তহীন বিরহেরই ছবি। যক্ষ সেই বিরহেরই প্রতীক ছাড়া কিছু নয়। আর ঘনবর্ষার মুহূর্তে কবি নিজে আরও অসংখ্য বিরহীর মতো যে যক্ষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন সেই যক্ষের মতোই মেঘের সঙ্গে দেশে দেশে ভেসে ‘কামনার মোক্ষধাম অলকার মাঝে' উত্তীর্ণ হতে চেয়েছেন। ‘সৌন্দর্যের আদি সৃষ্টি' বিরহিনী প্রিয়তমার সঙ্গে মিলনের আশঙ্কাই তাঁর লক্ষ। মেঘদূতের কবিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলছেন,
কবি, তব মন্ত্রে আমি মুক্ত হয়ে যায় রুদ্ধ
এই হৃদয়ের বন্ধনের ব্যথা, লভিয়াছি বিরহের স্বর্গলোক,
যেথা চিরনিশি যাপিতেছে বিরহিণী প্রিয়া
অনন্ত সৌন্দর্যমাঝে একাকী জাগিয়া।
মেঘদূত-পাঠের প্রাপ্তি এই ‘বিরহের স্বর্গলোক’-প্রাপ্তি। এই ব্যবধানের অভিশাপই সমস্ত মানুষের অন্তর্গত চরিত্র। কেন এই অভিশাপ সে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। এই অভিশাপের শেষও নেই : সশরীরে কোন্ নর গেছে সেইখানে। মানসসরসী তীরে বিরহশয়ানে শারীরিক মিলনে সেই মানসী অপ্রাপ্যই থেকে যায়। মানসী-র এই মেঘদূত কবিতাটির পর বছর দুয়েকের মধ্যেই (অগ্রহায়ণ, ১২৯৮) প্রাচীন সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত মেঘদূত প্রবন্ধটি লেখা। এই প্রবন্ধটির পরবর্তীকালের চিন্তাসূত্র ধরে এগিয়ে গিয়ে আবার এই প্রবন্ধেই ফিরে আসব। প্রবন্ধটির প্রায় চার বছর বাদে 'মেঘদূত' নামে একটি মনেই লেখেন রবীন্দ্রনাথ। বৈতালির মধ্যে তা সংকলিত হয়েছে। কবিতার প্রথম লাইনটি খুবই নাটকীয়ভাবে শুরু হয়েছে 'নিমেষে টুটিয়া গেল সে মহাপ্রতাপ'। মহাপ্রতাপের স্বরূপটি কী? সেটি হল কবিকল্পনার একটি মিলনের সুখসদ্য, যেখানে সমস্ত মানুষই একটি সর্বাত্মক মিলনবন্ধনের মধ্যে মহাপ্রতাপে রাজত্ব করছিল। তারপর একদিন দেবতার শাপ নেমে এল। বিচ্ছেদের শিখা এসে মিলনের কুহেলিকা দূর করে দিলে। যে ছটি ঋতু চলে গেল সেই সুখরাজ্যের রঙ্গ যবনিকা তুলে দিয়ে। দেখা গেল, শুধু অশ্রুপ্লুত আষাঢ়ের সুন্দর এই ভুবনে শুধু বিরহেরই সকরুণ বীণা বেজে চলেছে অবিরাম। আগেকার মানসীর মেঘদূত কবিতাটিতেও এমন একটি সুখরাজ্যচ্যুতির অভিশাপের স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল কবিতাটির শেষের দিকে, যখন বলছিলেন :
ভাবিতেছি অর্ধরাত্রি অনিদ্রনয়ান।
কে দিয়েছে হেন শাপ, কেন ব্যবধান ?
কাজেই মেঘদূত-পাঠের প্রতিক্রিয়ায় যে নিজস্ব পাঠ রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছিলেন তাতে মিলনের সুখরাজ্যের অবিচ্ছিন্ন একাগ্রতা বিছিন্ন হয়ে যাবার চিন্তাটা প্রথম থেকেই ছিল। এখন এই বিচ্ছিন্নতার বিরহই কবির কাছে মনে যে প্রেমের মূল শক্তি ও চরিত্র, এবং সৃষ্টিরও চরিত্র। বিরহের বেদনা নিয়েই মিলন আসে। যাকে বলে distancing বা দূরত্বের অনুভব, তা-ই মিলনকে সম্পূর্ণ করে। প্রায় চব্বিশ বছর বাদে লিপিকার অন্তর্ভুক্ত ‘মেঘদূত' নামে একটি রচনায় সেই বিরহের মেঘই ঘনিয়ে এসেছিল মিলনের আকাশে। একটি বাস্তব মৃত্যুবোধকেই যেন কেন্দ্র ক'রে :এক একদিন জ্যোৎস্নারাত্রে হাওয়া দেয় ; বিছানার 'পরে জেগে বসে বুক ব্যথিয়ে ওঠে ; মনে পড়ে, সেই পাশের লোকটিকে তো হারিয়েছি। এই বিরহ মিটবে কেমন করে, আমার অনন্তের সঙ্গে তার অনন্তের বিরহ। এমন সময়ে নববর্ষা ছায়া উত্তরীয় উড়িয়ে পূর্ব দিগন্তে এসে হাজির। উজ্জয়িনীর কবির কথা মনে পড়ল। মনে হল, প্রিয়ার কাছে দূত পাঠাই। আমার গান চলুক উড়ে, পাশে থাকার সুদূর দুর্গম নির্বাসন পার হয়ে যাক। কিন্তু তাহলে তাকে উড়ে যেতে হবে কলের উজান-পথ বেয়ে বাঁশির ব্যথায় ভরা আমাদের প্রথম মিলনের দিনে, সেই আমাদের যে দিনটি বিশ্বের চিরবর্ষা ও চিরবসন্তের সকল গন্ধে সকল ক্রন্দনে জড়িয়ে রয়ে গেল, কেতকীবনের দীর্ঘশ্বাসে আর শালমঞ্জরীর উতলা আত্মনিবেদনে।
নির্জন দিঘির ধারে নারিকেলবনের মর্মরমুখরিত বর্ষার আপন কথাটিকেই আমার কথা করে নিয়ে প্রিয়ার কানে পৌঁছে দিক, যেখানে সে তার এলো চুলের গ্রন্থি দিয়ে আঁচল কোমরে বেঁধে সংসারের কাজে ব্যস্ত।' এইভাবে যক্ষপ্রিয়ার অনুসরণে কবির প্রিয়াই হয়ে উঠেছে কবির লক্ষ। আসল আর পৃথিবীর মাসখানটা যেমন দুয়েরই উন্মুখীনতার ব্যাকুলতায় চোখের জলের গানে, বর্ষণের স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে, সেইরকম স্নিগ্ধ বর্ষণই বাস্তবে সেই বিচ্ছেদের মধ্যে। কবি কল্পনা করছেন, 'যখন ঝিল্লীর ঝংকারে বেণুবনের অন্ধকার থরথর্ করছে, যখন বাদল হাওয়ায় দীপশিখা কেঁপে কেঁপে নিবে গেল, তখন সে তার অতি কাছের ঐ সংসারটাকে ছেড়ে দিয়ে আসুক, ভিজে ঘাসের গন্ধে ভরা জনপথ দিয়ে, আমার নিভৃত হৃদয়ের
নিশীথরাত্রে।'
তাহলে কবির প্রেমের অনুভবে কাছের মানুষের মধ্যে দূরত্বের অনুভব মিলিয়ে দিয়েছে মেঘদূত। মিলনে, মিশে গেছে চিরবসন্ত আর চিরবর্ষা। অতি কাছের সংসারের প্রিয়া এসেছে নিভৃত হৃদয়ের নিশীথরাত্রে। সেই মানসসরসীতীরে বিরহশয়ানেরই প্রতিরূপ হয়ে। শেষ সপ্তক কাব্যের আটত্রিশ সংখ্যক কবিতায় যক্ষকে সম্বোধন ক'রে মিলন-বিরহের যে ভাবনা ফুটে উঠেছে তাতে দেখছি, যক্ষ ও যক্ষপ্রিয়ার একটি সাংসারিক মিলনের অবস্থা কল্পনা করা হয়েছে। যক্ষ যে তাঁর প্রিয়াকে সংসারিক জীবনের প্রেয়সী হিসেবে পেয়েছিলেন তাতে প্রিয়ার আসল রূপটি ধরা পড়েনি। শ্রাবণের মেঘমালা যেমন নিজেরই আলিঙ্গনে ঢেকে ফেলে চাঁদকে তেমনি যক্ষ যেন আলিঙ্গনে ঢেকে রেখেছিল প্রিয়াকে। কিন্তু যেই প্রভুর শাপ নেমে এল যক্ষের জীবনে অমনি প্রিয়া যেন কাছের বেড়াজাল ঘেরা মূর্তি থেকে বেরিয়ে এল বিশ্বের মাঝখানে। বিচ্ছেদের সৌম্য বিষাদের অশ্রু-ধোয়া মূর্তিতে সে ছড়িয়ে পড়ল। আর তখনই যক্ষ হয়ে উঠল সত্যিকারের কবি।
“আজ তোমার প্রেম পেয়েছে ভাষা,
আজ তুমি হয়েছ কবি,
ধ্যানোত্তরা প্রিয়া
বক্ষ ছেড়ে বসেছে তোমার মর্মতলে
বিরহের বীণা হাতে।
আজ সে তোমার আপন সৃষ্টি
বিশ্বের কাছে উৎসর্গ-করা।'
বাস্তব মিলন যখন বিরহে পৌঁছোয়, শরীরের স্পর্শ যখন অন্তরে লাগে তখনই প্রেমের সম্পূর্ণতা আসে। সেই একই মানসিকতায়, হৃদয়ানুভবে, ধ্যানে, শারীরিক সীমা ছাড়িয়ে ‘সৌম্য বিষাদের দীক্ষায়' প্রেমের পরিণতি। মেঘদূতের নিজস্ব রাবীন্দ্রিক পাঠের এইটেই স্বরূপ। মৃত্যুর আগের বছর সানাই-কাব্যের অন্তর্ভুক্ত 'যক্ষ' নামে যে কবিতাটি লিখেছিলেন তাতে ওই কবি-যক্ষেরই রূপটিকে সৃষ্টির স্বরূপে পৌঁছে দিয়েছেন। অলকাপুরী যেন বন্দিনী যক্ষপ্রিয়ার স্থির স্তব্ধগতি অচল রূপের জগৎ। সে জগতে বিরহিণীর কোনো চলার পথ নেই। শুধু ক্লান্তিকারে ধূলিশায়ীর আশা' নিয়েই তার প্রতীক্ষা। যে বিরহের তীব্র বোধ মানুষকে সচল ক'রে তীর্থলোভী ক'রে তোলে, পরিপূর্ণতার জন্যে ব্যথিত করে, সেই বিরহ তথাকথিত অলকার স্বর্গপুরীতে কোথায়? যেখানে পুষ্প নিত্যই ফুটে আছে, যেখানে নিত্যই পূর্ণিমার জ্যোৎস্না, সেখানে 'অস্তিত্বের শোক'-ই শুধু থাকতে পারে, অস্তিত্বের ব্যথা কোথায়? সেখানে শুধু 'স্বপ্নমুগ্ধ ঘুম' আছে, জাগরণ নেই। তাই প্রভুর 'শাপ' নির্বাসিত যক্ষের পক্ষে শাপে বরই হয়েছে। কবি বলছেন,
'প্রভু বরে যক্ষের বিরহ
আঘাত করিছে ওর দ্বারে অহরহ।
স্তব্ধগতি চরমের স্বর্গ হতে
ছায়ায় বিচিত্র এই নানা বর্ণ মর্তের আলোতে
উহারে আনিতে চাহে
তরঙ্গিত প্রাণের প্রবাহে।
অলকাপুরী হয়ে উঠেছে স্বর্গ, নির্বাসিত যক্ষের রামাগিরি হয়ে গেছে মর্ত। স্বর্গ হইতে বিদায়'-এর যুক্তিটাই এখানে ফিরে এসেছে। শুধু একটা নতুন মাত্রা এসেছে। সে হল বিরহকে সৃষ্টিশক্তির মূল হিসেবে দেখা। স্বর্গদ্বারে বিরহের আঘাতেই তার প্রকাশ। মর্তের স্বর্ণময় আলোয় তরঙ্গিত প্রাণের প্রবাহই স্বর্গের চরমের ঐশ্বর্য-কারাকে ভাঙতে চাইছে।
মানসী থেকে সানাই পর্যন্ত পঞ্চাশ বছর ধরে মেঘদূতের এই পাঠ-পাঠান্তর চলেছে কবির মনে। যক্ষকে প্রথম থেকেই তার ব্যক্তিত্বকে ভেঙে বেরিয়ে এসেছে সমস্ত মানুষের বিচ্ছিন্নতার গভীর ও ব্যাপ্ত চেতনায়। ক্রমশ তার দেহনির্ভর প্রেমের সংকীর্ণতা ছাড়িয়ে দেখা দিয়েছে প্রেমের পূর্ণতর বিশ্বময় উপলব্ধি। ঠিক এই উপলব্ধির মুহুর্তেই মানসীর মেঘদূত প্রবন্ধটি লেখা। ইতিমধ্যে আমরা লিপিকা শেষসপ্তক ও সানাই পর্যন্ত বিরহবোধ যে সৃষ্টিশক্তির মূলে এসে পৌঁছেছে তার একটা রূপরেখা পেয়ে গেছি। প্রথম থেকে শেষ অবধি পাঠবদলের এই যে প্রেক্ষাপটটি পেয়েছি তাতে মেঘদূত-প্রবন্ধটির মধ্যে কবির নিজস্ব উপলব্ধিটুকু কোন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মেঘদূত-প্রবন্ধটির প্রথমেই, বলা উচিত, প্রথম বাক্যেই নির্বাসিত যক্ষ তার নিজস্ব পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ঋতু পরিবর্তনের সীমারেখাটি ভেঙে চলে এসেছে চিরকালের মানুষের নির্বাসন-চেতনায়। মানসী-র মেঘদূত কবিতায় যক্ষের বেদনার মধ্যে সর্বকালের মানুষের বিরহচেতনাই পুঞ্জীভূত হয়েছে। মেঘদূত প্রবন্ধের প্রথমাংশের বিরহচেতনার সঙ্গে তার একটু চরিত্রগত পার্থক্য আছে। প্রবন্ধটিতে মেঘদূতের জীবনস্রোত থেকে চিরকালের মতো বিচ্যুত হবার জন্যে আক্ষেপ আছে। সেই জীবনস্রোতের ভেরতকার গাছপালা, পাখি, গ্রাম, গ্রামবৃদ্ধদের গল্প, উজ্জয়িনীর শ্রী ও ঐশ্বর্য, পুরনারীদের সাজসজ্জার গন্ধ, পরিত্যক্ত পথ ও পথ-চলা অভিসারিণীর ছায়া, শোভা সম্ভ্রম ও শুদ্ধতায় ভরা নদী-গিরি-নগরীর নাম কবিকে ব্যাকুল করে। একমাত্র কবির মেঘ ছাড়া আর কেউ ওই জগৎটিতে পৌঁছোতে পারে কি? পারে না বলেই এই বিরহ-ব্যাকুলতা। কাজেই, কবিতাটিতে যেমন বিরহেরই পুঞ্জীভূত রূপ দেখি, প্রবন্ধের প্রথম অংশে তেমনি মেঘদূতে- বর্ণিত জীবন ও যাত্রাপথের বিচিত্র সৌন্দর্য জগৎ থেকে বিচ্যুতির জন্যে আক্ষেপই মূলকথা। এমনকি সেই শোভন-সম্ভ্রমের জগৎ থেকে ‘সময়' অনেকখানি সরে এসেছে বলে আক্ষেপও আছে : ‘সময় যেন তখনকার হইতে ক্রমে ক্রমে ইতর হইয়া আসিয়াছে, তাহার ভাষা ব্যবহার মনোবৃত্তির যেন জীর্ণতা এবং অপভ্রংশতা ঘটিয়াছে। কল্পনা-কাব্যের 'স্বপ্ন' কবিতাটিতে যে প্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছেন কবি সেখানেও ভাষার ব্যবধানই বড় হয়ে উঠেছে। দৃষ্টি-বিনিময় ও নীরবতার ভাষাই সেখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে। প্রবন্ধটির প্রথমাংশের এই বিচ্যুতির দুঃখই স্বপ্ন-কবিতার মূল রস।
এই বিচ্যুতির দুঃখ আবার রবীন্দ্রনাথকে অন্য এক কবির বিচ্ছিন্নতার বোধকেই মনে করিয়ে দিয়েছে। বলছেন, 'কোনো ইংরেজ কবি লিখিয়াছেন, মানুষেরা এক-একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো, পরস্পরের মধ্যে অপরিমেয় অলবণাক্ত সমুদ্র। দূর হইতে যখনই পরস্পরের দিকে চাহিয়া দেখি, মনে হয়, এক কালে আমরা এক মহাদেশ ছিলাম। এখন কাহার অভিশাপে মধ্যে বিচ্ছেদের বিলাপরাশি ফেনিল হইয়া উঠিতেছে।' মনে হয়, ইংরেজ কবি উপলব্ধিতে জেগে-ওঠা মানুষে মানুষে এই বিচ্ছিন্নতার চেতনা মেঘদুতের যক্ষ- বিরহের নিজস্ব পাঠ-নির্মাণে রবীন্দ্রনাথকে অনেকটাই সাহায্য করেছে। ম্যাথু আর্নল্ড-এর To Marguerite-continued কবিতাটির কিছু অংশ উদ্ধার করলে বুঝতে পারা যাবে, সম্মিলিত মানুষের মহাদেশ কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে পরস্পরের মধ্যে সামুদ্রিক জলরাশির ব্যবধান সৃষ্টি করার চিন্তাটা কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছে :
Yes! in the sea of life enisled,
With ecohoing straits between us
thrown,
Dotting the shoreless watery wild,
We mortal millions live alone.
The islands feel the enclasping flow,
And then their endless bounds they
knew.
Oh! then a longing like despair
Is to their farthest caverns sent ;
For surely once, they feel, we were
Parts of a single continent !
Now round us spreads the watery
plain-
Oh might our marges meet again! ...
বোঝা যায়, মনে হয় এককালে আমরা এক মহাদেশ ছিলাম' এই অনুভূতির উৎস কোথায়। এই অনুভূতির পরবর্তী স্তরে পৌঁছে কবি বলছেন, আমাদের এই ‘সমুদ্রবেষ্টিত' বর্তমান থেকে সেই মেঘদূতের জীবন ও প্রকৃতির দিকে যখন চেয়ে দেখি তখন মনে হয় সেই জীবন আর এই বর্তমান জীবনের মধ্যে সংযোগ থাকা উচিত ছিল। আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের গভীর ঐক্য আছে। অথচ কালের নিষ্ঠুর ব্যবধান। তাই কবির সৃষ্টি যে অতীতের অমরাবতী তার থেকে বিরহবিচ্ছিন্ন আমরা কল্পনার মেঘদূত পাঠাই। এই চিন্তার মধ্যে মানসীর মেঘদূত কবিতার চিন্তার মিল আছে—মেঘের সঙ্গে ভেসে ভেসে কামনার মোক্ষধাম অলকার দিকে যাত্রার ছবিতে।
কিন্তু বিচ্ছিন্নতার চিন্তা অন্যমাত্রা নিয়েছে যখন কবি বলছেন, কেবল অতীত এবং বর্তমান নয়, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই অতল স্পর্শ বিরহ। ম্যাথু আর্নলড্-এর যে কবিতাটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি তার আগের কবিতাটিতে Isolation To Marguerite-এ এই বিচ্ছিন্নতার বোধটি আছে। শুধু বিচ্ছিন্ন দ্বীপের পারস্পরিক স্থানগত ব্যবধান নয়, বিচ্ছিন্নতার বোধই কাজ করছে মানুষের মনে।
Farewell-and thou, thou lonely heart, Which never yet without
remorse Even for a moment didst depart From thy remote and sphered course To
haunt the place where passions reign-Back to thy solitude again!
ঠিক এই অনুভূতি থেকেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'অনন্তের কেন্দ্রবর্তী সেই প্রিয়তম অবিনশ্বর মানুষটিকে কে লাভ করিবে। কেবল ভাবে-ভাষায় আভাসে ইঙ্গিতে ভুল ভ্রান্তিতে দেহমনে জন্মমৃত্যুর স্রোতোবেগের মধ্যে তার একটু আভাস পাওয়া যায়। তার বেশি এই বিরহলোকে কেউই আশা করে না। এই কথা বলে তিনি মেঘদূতের যে শ্লোকটি তুলে দিয়েছেন তার আক্ষরিক অর্থ হল : “তুষারাত্রি বা হিমালয় থেকে যে দক্ষিণী হাওয়া দেবদারুর কিশলয়গুলিকে সদ্য ফুটিয়ে তাদের রসক্ষরণের গন্ধ নিয়ে আসছে, সে হাওয়া আমাকে আলিঙ্গন করে এই কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, খুব সম্ভবত সে তোমার শরীর স্পর্শ করেই আসছে।' *কাজেই বিরহকে আপাতত ভুলে থেকে শুধু স্বপ্নেই দেখা যায়। ম্যাথু আর্নল্ড-এর ওই কবিতারই শেষ স্তবকে আছে
Of happier men- for they at least
Have dream'd two human hearts might
blend
In one, and were through faith
released
From isolation without end
Prolong'd, nor knew,
although not less Alone than thou,
their loneliness.
এই বিরহের কথাই বৈষ্ণব কবির প্রেমের ভাবনায় ধরা দিয়েছে। যক্ষের বিরহ চেতনার আরও একটি রূপ পাওয়া গেছে বৈষ্ণব কাব্যে, যেখানে মিলিত দুটি মানুষও অনিবার্য বিচ্ছিন্নতার জন্যে চোখের জল ফেলে। দুটি মানুষের মাঝখানে ব্যবধান রচনা করে রেবা মিত্রা অবস্তী উজ্জয়িনীর সুখ-ঐশ্বর্যের উজ্জ্বল ছবি। সে ছবি ব্যাকুলতাই বাড়ায়। মিলনের পূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারে না। বিরহই মিলনের স্বপ্নকে যথেচ্ছ প্রসারিত করে মিলনকে অনেক বড় করে তোলে।
স্থানগত ব্যবধানের নির্জন নিঃসঙ্গ বিরহ যেমন মেঘদূত-পাঠের একটি মাত্রা, কালগত ব্যবধানের দূরত্ব তেমনি মেঘদূত-পাঠের আর এক মাত্রা। তেমনি আবার, বিরহচেতনা, যা শারীরিক সীমাকে অনায়াসেই অতিক্রম করে যায়, সেও আরও এক মাত্রা। কিন্তু চতুর্থ একটি মাত্রাও এসে গেছে প্রবন্ধটির শেষ দুটি পরিচ্ছেদে। শুধু যে এক মহাদেশে আমাদের সম্মিলিত বসবাস ছিল এবং পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি তাই নয়। এক মানসলোকে ছিলাম, এবং সেখান থেকে নির্বাসিত হয়েছি, এও এক মাত্রা। তুলনায়, এক্ষেত্রেও, বৈষ্ণব কবির উচ্চারণ অনিবার্যভাবেই রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ে যায়। 'তোমায় হিয়ার ভিতর হইতে কে কৈল বাহির'। তাই বৈষ্ণব কবির চিত্ত অস্থির। হৃদয়ের মধ্যে আবার এক হবার বাসনা। কিন্তু মাঝখানে বৃহৎ পৃথিবী। যক্ষের প্রিয়া যেন যক্ষেরই মনোজগতের মানুষ। তাকে তো বাইরে পাওয়া যায় না। আগেই মানসীর মেঘদূত কবিতায় তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছিল। 'মানস সরসীতীরে.... সেই প্রিয়াকে সশরীরে কে কবে পেয়েছে? তাই শেষ অনুচ্ছেদে নির্জন গিরিশিখরের বিরহী যক্ষকে প্রশ্ন করেছেন লেখক, স্বপ্নে যাকে আলিঙ্গন ক'রে মেঘের মুখে সংবাদ পাঠাচ্ছে, কে তাকে চিরমিলনের আশ্বাস দিয়েছে? ‘তোমার তো চেতন-অচেতনে পার্থক্যজ্ঞান নাই, কী জানি যদি সত্য ও কল্পনার মধ্যেও প্রভেদ হারাইয়া থাক।' প্রভেদ তো সে হারিয়েছেই। এবং সেইজন্যেই যক্ষ হয়ে উঠেছে কবি, স্রষ্টা। অলকাপুরীর প্রিয়া তার মনোজগতেরই বহিঃপ্রকাশ। শেষ সপ্তক কাব্যের সেই যক্ষের ইতিপূর্বে উদ্ধৃত কথাটাই মনে পড়ে আবার :
'আজ তুমি হয়েছ কবি
ধ্যানোদ্ভবা বা প্রিয়া
বক্ষ ছেড়ে বসেছে তোমার মমতলে
বিরহের বীণা হাতে
আজ সে তোমার আপন সৃষ্টি
বিশ্বের কাছে উৎসর্গ-করা।'
রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব পাঠ-রূপান্তরের ইতিহাসে মেঘদূত প্রবন্ধটি এমন এক পর্বে লেখা যখন সত্য-মিথ্যার ভাণ মুছে দিয়ে ‘প্রভু-শাপ’-মুক্ত হয়ে ‘প্রভু-বরে’ যক্ষ হয়ে উঠছে কবি। আরও কিছু সময় কেটে গেলে সম্রাট-কবির সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য থাকবে না। কালের প্রহরী এড়িয়ে তাজমহলের মতো সে 'নব মেঘদূত ই রচনা করে ফেলবে। এবং করেছেও তাই।
0 Reviews