রামায়ণের রূপান্তর : মাইকেলের বিবরণে ও বিন্যাস

রামায়ণের রূপান্তর : মাইকেলের বিবরণে ও বিন্যাস

Size

Read more

 

রামায়ণের রূপান্তর : মাইকেলের বিবরণে  বিন্যাস


রামায়ণের
 রূপান্তর : মাইকেলের বিবরণে  বিন্যাস


রামায়ণের
 রূপান্তর : মাইকেলের বিবরণে  বিন্যাস

মেঘনাদবধ কাব্য যে উনিশ শতকের প্রাচ্য-প্রতীচ্য সংস্কৃতির দ্বন্দ্বকেই মূলত প্রমাণ করে তা স্পষ্ট করে বুঝবার চেষ্টা অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে করেছেন। সে-সব চেষ্টার মধ্যে রাম- লক্ষ্মণের চেয়ে বিশেষ করে রাবণ-ইন্দ্রজিতের চরিত্রগত দৃঢ়তা মহত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার ঝোঁকটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তাছাড়াও মাইকেল মেঘনাদবধ কাব্যের প্রকাশভঙ্গিতে, ভাষার আভিজাত্য নির্মাণে, ...-রূপক-উপেক্ষার প্রয়োগে, কাহিনীর বিস্তারে কোথায় কোথায় বিদেশি প্রাচীন পরবর্তীকালের .. কাব্যের অনুসরণ করেছেন, কিংবা কোন্ কোন্ দেব- দেবী বা কোন সংস্কৃতির স্বর্গ-মর্ত-পাতাল মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছেন তারও খুঁটিনাটি আলোচনা অনেকেই করেছেন।

তাই এখানে জীবনদৃষ্টির কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য যা বিশেষভাবেই উনিশ শতকের দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ শাকের পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্র তরুণ বুদ্ধিজীবী সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতারই প্রতিজন মেঘনাদবং কাব্যে কতটা ঘটেছে তা- সূত্রাকারে বলবার চেষ্টা করব।

প্রথম সংস্কৃত বাংলা কাব্যের প্রথাগত আদর্শের মধ্যে, সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রের প্রচলিত বন্ধনের মধ্যে মাইকেল থাকতে চাইছিলেন না। ইয়োরোপীয় সমাজজীবন দৃষ্টিভঙ্গির যতটুকু তিনি এদেশে থেকেই তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখেছিলেন সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিশেষ করে ইংরিজি সাহিত্য ইয়োরোপীয় সাহিত্যের জীবনদৃষ্টিতে মিলিয়ে দিয়ে স্রষ্টা হিসেবে তাঁর মনে হয়েছিল, প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি রচনা পদ্ধতিকে সরিয়ে বাইরের চাওয়া নিয়ে আসতে হবে। রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার কিংবা বিদ্যাসাগর তুলনামূলক বিচারের মধ্য দিয়ে তাঁদের চিন্তা, সৃষ্টি কর্মের মধ্যে দেশি- বিদেশি ভাবনা চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন প্রয়োজনের অনিবার্য তাগিদেই। মাইকেলের বন্ধু রঙ্গলালও তাঁর সৃষ্টিকর্মে অনেকটাই দেশি-বিদেশি সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু রঙ্গ লালের তুলনার মাইকেলের পড়াশোনা ছিল অনেক ব্যাপক। ভাষাজ্ঞান ছিল অনেক তীক্ষ্ণ। সৃষ্টির ক্ষেত্রে সেই ব্যাপক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবার মতো মুক্ত মানসিকতার মাত্রা ছিল অনেক বেশি, আর সৃষ্টিক্ষমতাও ছিল দুঃসাহসিক। কতোখানি দুঃসাহসিক, তা অমিত্রাক্ষর ছন্দকে কারে প্রয়োগ করার ক্ষমতা থেকেই বোঝা যায়। নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে থেকেও কথাভঙ্গিকে কতো সহজেই একাধিক লাইনে প্রবাহিত করে দিতে পেরেছিলেন তিনি। নাট্যসংলাপের নানা মেজাজি ভঙ্গি তিনি কাব্যের মধ্যেও অনায়াসে এনে দিয়েছিলেন! ইয়োরোপ ভূমধ্যসাগরীয় হাওয়া মাইকেলের জাদুতে বঙ্গোপসাগরীয় মৌসুমী হাওয়া হয়েই আমাদের প্রাণ জুড়িয়েছিল। কিন্তু যাকে 'জাদু' বলছি তা কিন্তু প্রেরণা পরিহাসেরই যৌথ ফল। অমিত্রাক্ষরে ভাবের প্রকাশ পঙক্তি ডিঙিয়ে যাওয়াতে বিচিত্র রকমের স্বাধীনতা এসেছে। এসেছে নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রশ্নের প্রবাহ এবং তার উত্তরের প্রবাহ। মাঝে মাঝে... সম্বোধনে কাব্যের উদ্দিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতি যেন অনুভব করা যায় একেবারেই নাটকীয় সংলাপের মতো। অনেক সময় স্বগত সংলাপও আছে। মাইকেল নিজেই তো কুপার-এর ইলিয়াডের অনুবাদ এবং মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট-এর পক্তি তুলে দেখিয়েছেন :

কি কারণে ত্যজি লঙ্কা, কহ, শুভঙ্করি,

সারদে, প্রবাসে বাস করে শূরমণি,

মেঘনাদ ?

ইত্যাদি প্রশ্নাত্মক বাচনভঙ্গি who of the gods impelled them to contend? (Homers Iliad...) এবং who prist seduced them to that foul revolt? / The infernal serpent. (Milton's par.... last, Book 1)- অনুসরণ। এই প্রশ্নের নাটকীয় ভঙ্গিতে বাচন শুরু করলে পরবর্তী ঘটনার জন্যে পাঠকের কৌতূহল তৈরি হয়ে যায়, এবং কাহিনীকাব্যের পক্ষে তা বিশেষ প্রয়োজন। মধুসূদন নিজেও এব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। তাই ওপরের ওই উদাহরণ তুলে রাজনারায়ণকে বলেছিলেন : 'These lines ought to give you some idea of the Episode that follow? কাজেই শুধু ছন্দমুক্তি নয়, কাব্যকে প্রসারিত করার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে নাটকীয় কৌতূহল নিরন্তরই সৃষ্টি করে চলেছেন মাইকেল। এবং খুবই সচেতন ছিলেন যাতে বড় কাহিনীকাব্যে বর্ণনার মধ্যে নাটকীয়তা থাকে নইলে কাব্যিক আকর্ষণই তো হারিয়ে যাবে।

আর শুধুই কি কৌতূহল বাড়াবার কৌশল? আবেশও আছে। এমন এক একটি অংশ আছে যেখানে তুলনা-উপমা ছাড়া সবরকম দুঃখ-কষ্ট বেদনাকে প্রমান করা হয়েছে এই প্রশাত্মর বাক্যেই। নিজের দুর্বলতার কথা বলতে গিয়ে রাবণ একটি তুলনা দিয়েছেন প্রথম পর্বে। শাখা কেটে কেটে অবশেষে যেমন কাঠুরিয়া বৃক্ষটিকেই কেটে ফেলে তেমনি একে একে তাঁর পক্ষের বীরদের পতন তাঁর নিজেরই বর্নাশ ডেকে আনছে। এই তুলনার পরেই দেখছি :

তা না হলে মারি কি কভু

শুলী শম্ভুসম ভাই কুম্ভকর্ণ মম,

অকালে আমার দোষে? হায় সুপর্ণাখা,

কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই রে অভাগী,

কাল পঞ্চবটী বনে কালকূটে ভরা

তুজগে?

সম্পূর্ণ 'টি সর্গের মেঘনাধবধ কাব্য এই রকম নাটকীয় পরিবেশে, নাটকীয়প্রশ্নেও সংকল্পে। বীরত্বে সম্মুখ সমরের উত্তেজনায়, এবং গভীরে অথচ সংযত বিলাপে অসম্ভব চরিত্র পেয়েছে। সেকসপিরীয় নাটকে নাটকের পতনে যে দেহে-মনে সংগ্রামের শক্তিও মহত্ত্ব দেখি, সেইরকম একটি শক্তিমান মানুষের মৃত্যুবরণে আর এক শক্তিমান মানুষের অভ্রভেদী সংযত সংহত বিলাপ শোনা গেছে। সে প্রসঙ্গে আমার আগে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিন্যাসে মাইকেল কতোখানি পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তা দেখা যাক। ঘটনাটি হল নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে মেঘনাদের মুখোমুখি বিভীষণ লক্ষ্মণ।

প্রথমে দেখা যাক, ইন্দ্রজিৎ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণের সঙ্গে বিভীষণকে যা বলেছিলেন তা বাল্মীকিকে কতোটা অনুসরণ করেছে। বিভীষণকে দেখে কঠোর বাক্যে তিনি বলেছিলেন, পিতৃব্য হয়ে কী করে আমার শত্রুতা করছ? দুবুদ্ধি, তুমি স্বজন ত্যাগ করে পরের দাস হয়ে সাধুজনের নিন্দাভাজন হয়েছ। যে পক্ষ ত্যাগ করে পরপক্ষে যায়, স্বপক্ষ ক্ষীণ হলে পরপক্ষই তাকে বিনষ্ট করে। উত্তরে বিভীষণ বললেন, তুমি কি আমার স্বভাব জানো না? যদিও আমি ক্রুরবর্মা রাক্ষসদের কূলে জন্মেছি তবু মানুষের যা শ্রেষ্ঠ গুণ এবং রাক্ষসে যা দুর্লভ সেই সত্ত্বগুণই আমার স্বভাবগত। যে ব্যক্তি ধর্মপথ থেকে ভ্রষ্ট এবং পাপবুদ্ধি তাকে হস্তস্থিত আশীবিষের মতো ত্যাগ করাই শ্রেয়। পরস্বাগহারী পরস্ত্রীধর্ষক ব্যক্তি প্রজ্বলিত গৃহের মতোই ত্যাজ্য। মহর্ষিদের হত্যা, দেবগণের সঙ্গে বিরোধ, গর্ব, রোষ, শত্রুতা এবং হিতৈষীর প্রতিকূলতাএই সব দোষ আমার ভ্রাতার জীবন ঐশ্বর্য নষ্ট করছে। এই কারণেই তোমার পিতাকে আমি ত্যাগ করেছি। তুমি অতি গর্বিত, অল্পবয়স্ক দূর্বিনীত, কালনাশ তোমাকে বদ্ধ করেছে। তুমি যা ইচ্ছে হয় বলো। আজ তুমি লক্ষ্মণের সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না।

মোট তিনটি সংক্ষিপ্ত সর্গে এই তর্কাতির্ক আছে (যুদ্ধকাণ্ড, সর্গ ৮৫-৮৭) এবার কৃত্তিবাসের রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ড থেকেইন্দ্রজিৎবধঅংশ অনুসরণ করে দেখা যাক লক্ষ্মণ যখন বাণ সন্ধান করে ইন্দ্রজিৎকে শমনের কাছে .. জন্যে আস্ফালন করলেন তখন লক্ষ্মণকে এড়িয়ে বিভীষণের উদ্দেশ্যে বললেন, রাক্ষসের কুলে তোমার জন্ম। তোমাকে ধার্মিক বলেই সকলে জানে। তুমি পিতৃসহোদর। অতএব পিতার সমান। সমান ভেবেই তোমার সেবা করেছি। কিন্তু বন্ধুদের ছেড়ে তুমি মানুষের আশ্রয় নিয়েছ। রাক্ষসবংশে বাতি দেবার আর কেউ রইল না। এত মৃত্যু ঘটিয়েও তোমার শান্তি নেই। এখন আমার মৃত্যুর কারণ বলে দিয়েছ। সমস্ত রাক্ষসকুলকে তুমি শেষ করলে। তোমাকে দেখলে পাপ অনেক বেড়ে যায়। সজাতি নিৰ্গুণ হোক, সগুণ হোক, তবু জ্ঞাতি। জ্ঞাতি বন্ধু মিলে-মিশেই সকলে থাকে। এতো ভ্রাতুষ্পুত্র মেরেও তোমার ক্ষমা নেই! কোন্ লজ্জায় তুমি আমাকে মারতে এসেছ? বানরদের থেকে তুমি দূরে থাকো। যজ্ঞ সম্পূর্ণ করে আমি বর চেয়ে নেবো। আর তোমাকে মেরে আমি শনির প্রভাব ঘোচাব।

উত্তরে বিভীষণ বললেন, তুমি তো বিপরীত কথা বলছ। রাক্ষসকুলে জখেও কখনও কদাচার করিনি। পরদ্রব্য-পরদার কখনো নিইনি। তোমার পিতার ঘরে চোদ্দ হাজার নারী। তবু সে পরদার গ্রহণ করে। তপস্যায় তপস্বিনী নারীকেও সে হরণ করে এনেছে। শাপ- শাপান্ত করলেও সে তাকে ছাড়েনি। কতো মুনি-ঋষি মেরেছেন। তার পাপের অন্ত নেই। এতকাল সে-সব পাপের ফল ফলেনি। কিন্তু এইবার সময় হয়েছে। মেঘনাদবধকাব্যের ষষ্ঠ সর্গে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে লক্ষণকে দেখে অবাক হয়ে তাকে 'তস্কর' বলে, কে তাকে এনেছে এই প্রশ্ন করে, কোষা তুলে তার মাথায় মারলেন এবং দেব-অসি তুলতে গিয়ে তুলতে পারলেন না। তখন অভিমানে দরোজার সামনে হঠাৎ বিভীষণকে দেখে বুঝলেন, কে লক্ষ্মণকে এই গোপন স্থানে নিয়ে এসেছে। তারপর মাইকেলের মেঘনাদ যা বলেছেন তার সঙ্গে বাল্মীকি এবং কৃত্তিবাসের মেঘনাদের উচ্চারণে এমন কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই যাতে বিশেষ করে উনিশ শতকেরই কবির হাতের সৃষ্টি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু পার্থক্য আছে বিন্যাসেনিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে আসার পূর্বপ্রস্তুতিতে। কৃত্তিবাসে এই দীর্ঘ প্রস্তুতি নেই। দুটি ক্ষেত্রেই মেঘনাদবধের কৌশল বিভীষণই বলে দিয়েছে। বাল্মীকিতে আছে, বিভীষণ বলেছেন, ব্রহ্মা ইন্দ্রজিৎকে বলেছিলেন, নিকুড়িল যজ্ঞের আগে যে তাকে আক্রমণ করবে তার হাতেই তার মৃত্যু হবে। সেইজন্যেই লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে বিভীষণ গেছেন যজ্ঞের আগেই যাতে মেঘনাদকে বধ করা যায়।

কৃত্তিবাসে দেখি, বিভীষণ বলেছেন, ব্রহ্মা যেদিন ইন্দ্রজিৎকে বর দেন সেদিন ছিলেন তিনি। ব্রহ্মা ইন্দ্রজিৎকে বলেছিলেন, যজ্ঞ করার পর কেউ তাকে মারতে পারবে না। কিন্তু যজ্ঞের সময়ে যে এসে যজ্ঞ পণ্ড করবে তার হাতেই তার মৃত্যু হবে। কাজেই বিভীষণ লক্ষ্মণকে নিয়ে গিয়ে যজ্ঞ পণ্ড করেই লক্ষ্মণকে দিয়ে ইন্দ্রজিৎকে বধ করালেন।

কিন্তু মাইকেল এত সহজে বিভীষণ-লক্ষ্মণকে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে নিয়ে যান নি। কাব্যের প্রায় সূচনা থেকেই তো মাইকেল রাবণের সমস্ত শক্তি সংহরণ করবার পরিকল্পনা করেছেন এবং মেঘনাদ-বধকেই মূল লক্ষে রেখে লক্ষ্মণের হাতে অস্ত্র তুলে দেবার আয়োজন করেছেন। দ্বিতীয় সর্গে দেব-ষড়যন্ত্র তো ওই কারণেই। ওই সর্গের নামকরণেঅস্ত্রলাভরাখারও একই উদ্দেশ্য। এবং এই দেবষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি হোমারের ইলিয়াড থেকেই নেওয়া। উপকরণের উৎসগুলো জানানো এই আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু মাইকেল যে বাল্মীকি কৃত্তিবাস থেকে সরে গিয়ে একটু অন্যভাবে রাম-লক্ষ্মণ এবং রাবণ-মেঘনাদকে দেখতে চাইছিলেন সে কথাটা স্পষ্ট করার জন্যেই এই উৎস-প্রসঙ্গটুকু বলা দরকার। রাম-লক্ষ্মণকে দৈববলে শক্তিমান্ করে এবং দেবতার আশীর্বাদচ্যুত রাবণকে আত্মনির্ভরশীল 'মানাধক' বলে বলীয়ান করতে গিয়েই মাইকেল রামায়ণ কাহিনীর এই বি-নির্মাণ ঘটিয়েছেন। মাইকেলের এই মনোভাবটিকেই স্পষ্ট করতে চাইছি।

ইন্দ্রজিৎ বধের আগে, পঞ্চম সর্গেও ইন্দ্র -নিয়নের উদ্যোগ' চলেছে। একদিকে পরাশর্ম অনুযায়ী মায়া দেবী যাচ্ছেন ইন্দ্রজিৎ-বধে লক্ষ্মণের সাহায্যে, অন্যদিকে ওই মায়াদেবীই লক্ষ্মণকে চণ্ডীপূজো করিয়ে তাঁকে বর পাইয়ে দিলেন অনেক বাধা কাটিয়ে। আবার আর একদিকে প্রমীলার স্বামীর মঙ্গলের জন্যে প্রার্থনা কৈলাসে পৌঁছোলো না দেবচক্রান্তে। আবার রাম-লক্ষ্মণকে দুর্বল করে দেখানোর মধ্যেও খানিকটা ক্ষতিপূরণের করতে চেয়েছেন তিনি এই সর্গেদেবশক্তির সাহায্য নিয়েও লক্ষ্মণের নিজস্ব চারিত্রিক সমুন্নতির পরিচয় দিয়ে। যদিও মহামায়া বলেছেন, ‘মোর বলে পশিবি দুজনে অদৃশ্য”, তবু মেঘনাদকে আক্রমণের সময় যেন শার্দুলবিক্রমেই আক্রমণটি ঘটে। রামকে কিন্তু তেমনভাবে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে দেখান নি মাইকেল। ইন্দ্ৰজিৎ-লক্ষ্মণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা একেবারে একপেশে না হয় এমনই একটা মনোগত বাসনা ছিল মাইকেলের মনে।

অন্যদিকে মেঘনাদ-প্রমীলার সম্পর্কটিকে প্রেম বীরত্বের সমন্বয়ে গড়ে তুলতে মাইকেল এতই আগ্রহী যে, বৈপরীত্যে, ইন্দ্র ইন্দ্রপত্নীর দাম্পত্য দুর্বলতা অসহায়তাই দেখিয়েছেন। অর্থাৎ রাবণ-মেঘনাদের আত্মবিশ্বাসী মহত্বকে ফোটাতে গিয়ে দুটি বিপরীত শক্তিকে কোন্ পর্যায়ে পরস্পরের সম্মুখীন করাবেন তা নিয়ে দ্বন্দ্ব যেমন তাঁর ছিল তেমনি রাবণ-মেঘনাদের ট্র্যাজিক মহত্বের প্রতি পক্ষপাতে সামান্য নিজ ক্ষতিপূরণের চেষ্টা ছাড়া দেবকুল রাম-লক্ষ্মণকে রাক্ষসকুলের সমপর্যায়ে আনতেই চান নি।

ষষ্ঠ সর্গেও তাই ইন্দ্রজিৎ-লক্ষ্মণের সংগ্রামের আগে মাইকেল আরও সময় নিয়েছেন রামের ভয় দ্বিধা, লক্ষ্মণের জন্য তাঁর আশঙ্কা, বিভীষণের সাহসদান, লক্ষ্মণের প্রতিজ্ঞা, অকালসম্ভবা সরস্বতীর সিন্নী-সর্প-যুদ্ধের প্রপঞ্চ সৃষ্টি ইত্যাদি ঘটনার পরেও রামকে অম্বিকার কাছে প্রার্থনা করতে দেখা গেছে নিস্তার অধীনে। আর অন্যদিকে, মায়া কমলাকে রামের প্রতি প্রসন্ন হতে বলছেন এই চরম সংগ্রামের মুহুর্তে। এবং তারপরেই 'সত্বরে চলিলা দোঁহে, মায়ার প্রমাসে/অদৃশ্য' এই বিস্তৃত ভূমিকা করার উদ্দেশ্যই হল, পরোক্ষে মেঘনাদের শৌর্যবীর্যকে প্রমাণ করা। এরপর লক্ষ্মণ, বিভীষণ মেঘনাদের মধ্যে যে উত্তর-প্রত্যুত্তর চলেছে তা মূল বাল্মীকি কৃত্তিবাস থেকে সরে না গেলেও উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে মেঘনাদের উচ্চারণে স্বজন স্বজাতির অবমাননার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর একটা তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায় বিশেষ করে বাল্মীকি কৃত্তিবাসের এই কথাগুলোই মাইকেলের সমকালের জাতীয় চেতনা-উদ্বোধনের পরিপ্রেক্ষিতে পাঠক .......... কাছে নতুন করে অর্থবহ হয়ে উঠতেই পারে।

কিন্তু লক্ষ্মণ-বিভীষণ-মেঘনাদের কথোপকথনে মাইকেলের আরও একটা ... মনোভঙ্গি কিংবা মূল্যবোধের প্রকাশও ঘটেছে। সেটি হল, সুযোগ বুঝে নিরস্ত্র শত্রুকে সশস্ত্র হয়ে বধ করতে আসা। একে তো জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, জাতি' জলাঞ্জলি দেওয়ার মধ্যে কোনো ধর্মবোধ বা নৈতিক বোধ নেই একথা মেঘনাদ বলেই দিয়েছে, তারপরে সে লক্ষ্মণকে বলেছে, 'আতিথেয় সেবা, / তিষ্ঠি', লহ, শূরশ্রেষ্ঠ, প্রথমে এধামে/রক্ষোরিপু তুমি, তবু অতিথি, হে, এবে।/ ... বীরজ্ঞানে আমি। নিরস্ত্র যে অরি, / নহে রথীকুল প্রথা আঘাতিতে তারে : বিধি, হে বীরবর অধিদিত নহে। / ক্ষত্র তুমি, তব কাছে; কি আর কহিব?" হেকটর-এবিলিস-এর লড়াই- হোমার বা শেক্সপিয়ার যে যুদ্ধনীতি বজায় রেখেছেন মাইকেলের মেঘনাদও সেই heoric code- কেই মেনে চলেছেন। মেঘনাদকে বধ করার পর মাইকেল বিভীষণকেও শোকাপ্লুত দেখিয়েছেন। এবং তারপর লক্ষ্মণের সান্ত্বনায় আশ্বস্ত হয়ে দুজনেই মায়ারই প্রমাদে দ্রুত গিয়ে হাজির হয়েছেন রামচন্দ্রের কাছে এই সংবাদ দিতে। রামচন্দ্র শুনে সীতা-উদ্ধারের সাফল্য যে অনুজেরই প্রাপ্য তা বলে 'ধন্য জন্মভূমি অযোধ্যা এই উচ্চারণও করেছেন। একজন জন্মভূমির জন্যে প্রাণ দিলেন, অন্যজন জন্মভূমি রক্ষার জন্যে প্রাণ নিয়ে জন্মভূমি রক্ষা করলেন। এই জন্মভূমি-চেতনার মধ্যে পুরোনো হলেও (জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী) একটা সমকালীন চেতনা থাকা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু রামচন্দ্রের উক্তির শেষ অংশটিতে মাইকেলের মানবিকবোধ উনিশ শতকীয় মাত্রায় খুবই স্পষ্টভাবে ছুঁয়ে গেছে। রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে মনে করিয়ে দিয়েছেন :

'পুরু কিন্তু বলদাতা দেবে, প্রিয়তম। নিজবলে দুর্বল সতত

মানব সুফল ফলে দেবের প্রাসাদে?

রামচন্দ্র এখানে নিজেদের 'মানব' জাতির প্রতিনিধি বলেই মনে করছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন মানবিক দুর্বলতার কথা। অন্যদিকে রাক্ষসবংশ দেববলবিচ্যুত হয়েও অন্ধবিশ্বাসে প্রাণ দিতে প্রস্তুত আছে, প্রাণ দিয়েছেও। মেঘনাদ মৃত্যুর আগে ভাগ্যকেই ধিক্কার দিয়েছে। কিন্তু পিতার হাতে যে লক্ষ্মণের নিস্তার নেই সম্পর্কে সে নিশ্চিত। দেবতাকে সে দোষ দেয় নি, তাই প্রসাদও সে চায়নি। পিতা মাতা বীকে স্মরণ করেই লঙ্কার 'গগন-রবি' কিন্তু এই মহান আত্মত্যাগের একটা বড় প্রতিক্রিয়া দরকার। সেই প্রতিক্রিয়ায় রাবণের অসীম আত্মবিশ্বাসী শক্তির প্রকাশ ঘটেছে সপ্তম সর্গে। আরাধ্য দেবতাকে এবং অন্যান্য দেবতাদেরও তিনি বিচলিত করেছেন তাঁর প্রতি সবার সংকল্প। আবার মেঘনাদ যেমন লক্ষ্মণকে অতিথি হিসেবে বরণ করতে চেয়েছিলেন বীরোচিত ন্যায়বোধ, রাবণও তেমনি 'দেবাকৃতি লক্ষ্মণের শৌর্যে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন অকপটে। একদিকে শক্তিশেল প্রয়োগের অটুট সংকল্প, অন্যদিকে সেই শত্রুরই প্রশংসা রাবণকে আদর্শ বীরত্বে পৌ দিয়েছে। ষষ্ঠ সর্গে মেঘনাদের মধ্যে যেমন নায়কোচিত গুগের প্রমাণ ঘটেছে। সপ্তম সংগ তেমনি রাবণেরও অকল্পনীয় শক্তিরই প্রকাশ ঘটেছে। শক্তিবাদ দিয়ে লক্ষ্মণকে বিদ্ধ করাতেই তার প্রমাণ। আপাতত, রাবণ যুদ্ধে জয়ী হলেও মূল কাহিনীর অনুসরণে লক্ষ্মণকে সেই সূত্রেই দেবতারই কৃপায় রামচন্দ্র মায়ার সঙ্গে প্রেতপুরীতে গেলেন। সেইখানেই দশরথের সঙ্গে দেখা করে লক্ষ্মণের পুনর্জীবনের উপায় জেনে নেবেন। প্রেতপুরীতে দশরথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে রামচন্দ্রের নরকদর্শন হল পাপীদের যন্ত্রণার দৃশ্য দেখিয়ে বিধির বিধানকেই প্রমাণ করা হল। প্রমাণ করা হল, রামচন্দ্রের অসাধারণ সহনশীলতা। অম্লান সুখভোগ হয়তো ওঁর ভাগ্যে নেই। কিন্তু এই নববরণেইভারতভূমি'তে তার যশ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে। ভারতভূমির এই যোগ্য রাজাই মাইকেলের চেতনায় ভবিষ্যৎ প্রশাসকের চরিত্র। পিতার পাপ যে পুত্রকেই বহন করে সহনশীলতার কঠিন পরীক্ষা দিতে হয় সেইভাবেরবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন পাপের মার্জনা' সেই পাপের মার্জনার ভার পড়ল রামচন্দ্রের ওপর। বাল্মীকি কৃত্তিবাস থেকে সম্পূর্ণ সরে এসে মাইকেল দেবতার প্রসাদে রামচন্দ্রের বিষপাপ সত্তাকে তুলে ধরেছেন।

কিন্তু দেবতার প্রসাদ যারা পেলনা সেই মেঘনাদ রাবণকে পাপ-পুণ্য ধারণার মধ্যে রেখেও বিধির বিধানের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি বেশি। মেঘনাদকেও সেই বিধানের অংশীদার হয়ে প্রাণ দিতে হল। বিধি বিরূপ বলে তাঁর আক্ষেপ হয়েছে। কিন্তু দেবতার প্রসাদবঞ্চিত বলে নয় : 'রাবণনন্দন আমি, না ডরি শমনে। আর কিছু নয়। রাবণ কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাপবোধে বিচলিত হয়েছেন। তবু বলেছেন, প্রতিশোধ নিতেই তিনি বেঁচে থাকবেন।

তাই এই অনমনীয় শক্তির উপযুক্ত সংস্কারই হবে 'সংস্ক্রিয়া" বা শোধনে। তাই সারণকে পাঠিয়ে সাত দিনের যুদ্ধবিরতি চাইলেন রাবণ। ইলিয়াডে একিলিসের প্রতি প্রায়ামের উক্তিতে এগারো দিনের যুদ্ধবিরতির কথা আছে। রাবণ যথেষ্ট হীনবীর্য হয়েছেন বলে রামচন্দ্র যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। নিরস্ত্র মেঘনাদকে বধ করা, নিশ্চর 'অধর্ম', কিন্তু তার সৎকার করা 'ধর্ম-কর্ম" কিন্তু যুক্তিটা বোধহয় এইরকম যে, সে অন্যায়' তো পাপ নাশের জন্যেই। কাজেস এখন রামচন্দ্রকে বলতে শুনি : 'ধর্ম-কর্মে রত জনে কভু না প্রহারে / ধার্মিক। সুতরাং যুদ্ধবিরতি হল। এবার ইলিয়াডের অনুসরণে (সর্গ ২৪) মেঘনাদের শবদেহ বহন করে যাত্রা। সর্বাগ্রে হস্তীপৃষ্ঠে দুন্দুভি, তারপরে পদাতিক, প্রমীলার বানী, প্রমীলার অশ্বপৃষ্ঠে প্রমীলার বেশভূষা, মেঘনাদের রথ, মেঘনাদের শবের পাশে সোনার সিংহাসনে প্রমীলা, সধবা রাক্ষসনারীর দল ইত্যাদি, এবং শেষে পদব্রজে 'রক্ষঃকূল রাজা' রাবণ। পরনে তাঁর বিশদ বস্ত্র, বিশদ উত্তরী। রাবণের এই শুদ্র বেশ বর্ণনা করে মাইকেল তাঁর সঙ্গে তুলনা দিলেন মহাদেবেরই, যে মহাদেবকে তুষ্ট করে মেঘনাদ-রাবণকে পরাস্ত করার মধ্যে দেবতাদের এতো হুড়োহুড়ি : ধুতুরার মালা যেন ধূর্জটির গলে!' আর তাঁর পেছনে আবালবৃদ্ধবনিতা লঙ্কাবাসী।

এমন শোকযাত্রায় মাইকেল রামচন্দ্রেরদশশত' রথীকেও যুক্ত করে দিলেন অঙ্গদের নেতৃত্বে। সিন্ধুতীরে পৌঁছোলো শবাধার। দাহস্থলমন্দাকিনীর পবিত্র জলে ধোওয়া হল। রক্ষ-পুরোহিত মন্ত্র পড়লেন। প্রমীলা চিতায় উঠলেন। তারপর রাবণের শেষ ... বিলাপ তাঁর মনে হয়েছে পূর্বজন্মের হলেই তাঁর এই সর্বনাশ। কৈলাসে ধূর্জটিও বিচলিত হলেন। রাবণকে তিনি ভালোবাসেন। শুধু সতীর অনুরোধেই তিনি যেন রামলক্ষ্মণকে ক্ষমা করলেন। অগ্নিদেবকে বললেন, মেঘনাদ-প্রমীলাকে শীঘ্র 'পবিত্র' করে নিয়ে এসো। চিতা জ্বলে উঠতেই সোনার আসনেঅনন্ত যৌবনকান্তি' নিয়ে তাঁর চলে গেলেন। দাহস্থলের আগুন দুগ্ধধারায় নেভানো হল (ইলিয়াডে সুরা দিয়ে দাহস্থলের আগুন নেভানোর কথা আছে।) তারপর রক্ষ-শিল্পীরা দ্রুত নির্মাণ করে ফেললেন অভ্রভেদী স্বর্ণপার্টিকেলে মঠ' একেবারেই গ্রিক প্রথায় স্মৃতি-স্তম্ভ। কিন্তু দাহস্থল ধোওয়া হয়েছে মন্দাকিনী-জাহ্নবীর জলে। কাহিনীর সমস্ত উপকরণ, পরিবেশ, সংলাপ নাটকীয়তার আয়োজনের পেছনে কাজ করছে এমন এক বি-নির্মাণ-চেতনা যাতে বাল্মীকি-কৃত্তিবাসের রামায়ণ উনিশ শতকের দেবপ্রসাদ বিছিন্ন আত্মনির্ভরশীল দুঃসাহসী মানবিক চেতনার নতুন রামায়ণ হয়ে উঠেছে। 'নিজবলে দুর্বল মতত মানব এখন আর দেববলে সুফলের আশা করে না। মিল্টনের Satan- চরিত্রসৃষ্টির কথা বলতে গিয়ে মাইকেল বলেছিলেন, ‘He is Satan Himself" মাইকেল এক দেহে রাবণ মেঘনাদ। তাই পরাজিত মানুষের আকাশ-ছোঁয়া স্মৃতিস্তম্ভ তুলে ধরলেন স্বর্গ-মর্তের দেব-মানব শত্রুমিত্র একাকার-করা জনতারই সামনে


Read More:

বিধি-বন্দি রাবণ:

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/-%20.html

রামায়ণের রূপান্তর : মাইকেলের বিবরণে  বিন্যাস

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20%20%20%20.html

গদ্যছন্দ  রীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20.html

রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20.html

বহুবর্ণময় রামায়ণী প্রতীক : সোনার হরিণ

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/blog-post_19.html

মেঘদূত  নব মেঘদূত : রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব পাঠ

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20%20%20%20%20.html

যক্ষের বিদীর্ণ সত্তা: মেঘদূত

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20%20.html

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 Reviews