বহুবর্ণময় রামায়ণী প্রতীক : সোনার হরিণ

বহুবর্ণময় রামায়ণী প্রতীক : সোনার হরিণ

Size

Read more

 

বহুবর্ণময় রামায়ণী প্রতীক : সোনার হরিণ



বহুবর্ণময় রামায়ণী প্রতীক : সোনার হরিণ

জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলাকার পড়াশোনায় একেবারে প্রথম যুগের কথা যখন মনে করবার চেষ্টা করেছেন তখন তাঁর স্মৃতিপথের দূরতম প্রান্ত থেকে দুটি বইকে তিনি উদ্ধার করে এনেছেন। প্রথমটি, চাণক্য শ্লোকের বাংলা অনুবাদ। দ্বিতীয়টি, কৃত্তিবাসী রামায়ণ। উত্তীর্ণ-পঞ্চাশ রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টতই মনে করতে পারেন একটি মেঘলা ধূসর বিকেলের কথা। যে ভাগনে সত্যপ্রসাদ ছোটবেলায় বরাবরই তার সমবয়সী মামাটিকে অবাক করে বা ভয় দেখিয়ে নির্ভেজাল আনন্দ পেত সে হঠাৎ বারান্দায় দাঁড়িয়েপুলিসম্যান' বলে ভয় দেখাতেই তার ছোট্ট মামাটি পুলিশের ভয়ে দৌড়ে গিয়ে মা- ঘরে আশ্রয় নেয়। মা-কে বিপদের কথা জানায়। মা কিন্তু তেমন উৎকণ্ঠা দেখান না। সন্ত্রস্ত ছেলেটি তখন নিরুপায় হয়ে একটি মার্বেল-কাগজ-মোড়া কোণ-ছেঁড়া মলাটওয়ালা কৃত্তিবাসের রামায়ণ নিয়ে পুলিসের ভয় থেকে মনটাকে সরিয়ে নিতে চায়। ধীরে ধীরে পুলিসী সন্ত্রাস কোথায় চলে যায় কে জানে! ঠিক পরের স্মৃতির ছবিটি এই রকম : সামনে চৌকোণা বারান্দায় মেঘাচ্ছন্ন আকাশের বিষণ্ণ আলো পড়েছে। রামায়ণের কোনো একটা করুণ বর্ণনায় ছেলেটির চোখে জল দেখে দিদিমা জোর করে ছেলেটির হাত থেকে রামায়ণখানি কেড়ে নিয়ে যান।

কৃত্তিবাসের রচনায় এই মগ্নতা কোনো প্রবীণ সাহিত্যবুদ্ধির পরিচয় অবশ্যই নয়। কিন্তু বোঝা যায়, রামায়ণের কাহিনীগত তীব্র একমুখী আকর্ষণের জন্যেই এই মগ্নতা। আর এই মগ্নতা থেকেই বনবাসে সীতার কুটীরের চারদিকে গণ্ডি-কাটার যে ভয় রোমাঞ্চটুকু ছেলেটির মনে গেঁথে গিয়েছিল সেই ভয়টুকুর সুযোগ নিয়েই ভৃত্য শ্যাম তাকে গণ্ডির মধ্যে নিশ্চিন্তে রেখে অন্য কাজে মন দিত। সীতার সর্বনাশের কথা ছেলেটির ভালোই মনে ছিল বলে গণ্ডিটিকে নিতান্ত অবিশ্বাসীর মতো উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। আর একজন ভৃত্যঈশ্বরসন্ধেবেলা ছেলেদের দুরন্তপনাকে আটকাবার জন্যে রেড়ির তেলের ভাঙা সেজের চারদিকে ছেলেদের বসিয়ে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প শোনাতেন। ক্ষীণ সেজের আলোয় কড়িকাঠ পর্যন্ত মস্ত মস্ত ছাড়া পড়তো। আর তার মাঝখানেই হাঁ করে রামায়ণ শুনতে শুনতে কুশ-লবের বীরত্ব কাহিনীতে মন মজে আছে। এদিকে জেগে থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। ঔৎসুক্য তখন কিন্তু চরমে। এই সংকটে হঠাৎ বাবার অনুচর কিশোরী চাটুজ্যে এসে দাশু রায়ের পাঁচালি গেয়ে কাহিনী-সংকটের বাকিটা পূরণ করে দিলেন। কৃত্তিবাসের সরল পয়ারের মৃদু মন্দ-ধ্বনি মিলিয়ে গেল। দাশু রায়ের অনুপ্রাসের চকমকি ঝংকারে রবীন্দ্রনাথ হতবুদ্ধি হয়ে গেল।

স্মৃতির পরের পাতাগুলিতে পড়াশোনার যে ইতিহাস লেখা আছে সেখানে বাবাকে কেন্দ্র করে অনেক বইয়ের কথা এসেছে। সেই সূত্রেই এসেছে বাবার কাছে অক্ষয়কুমার দত্তের ঋজুপাঠ পড়ার খবর। এই ঋজুপাঠে বাল্মীকি রামায়ণের একটুখানি অংশ ছিল। কৈকেয়ী-শরণ-সংবাদ' সেই আদি কবির সংস্কৃত রামায়ণ পড়ে এবং তার ভুল ব্যাখ্যা করে মা- কাছে অসাধ্য সাধনের পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। এবং এই স্মরচিত' ব্যাখ্যার জন্যে স্বর্গত বাল্মীকির কাছে সকৌতুক স্নেহ-হাস্যের মার্জনাও চেয়েছিলেন 'জীবনস্মৃতির' পশ্চাশোধের লেখক রবীন্দ্রনাথ।

এরপর থেকে তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু হয়ে গেল পুরোদমে। সাহিত্য-চর্চার ফাঁকে ফাঁকে রামায়ণ এবং মহাভারত দুটি মহাকাব্যেরই কাহিনী তাৎপর্য নিয়ে পণ্ডিতদের বিতর্কও বেশ খানিকটা বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু আশ্চর্যের সঙ্গেই লক্ষ্য করা গেল, মহাভারতের কাহিনীর ওপর প্রত্যক্ষভাবে ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর যতগুলি 'সৃষ্টিমূলক' রচনা লিখলেন, তার প্রায় সবটাই নাটক, কাব্যনাট্য। আর রামায়ণের ওপর ভিত্তি করে যে রচনাগুলি তিনি লিখলেন তা সবই কবিতা। চিত্রাঙ্গদা, কর্ণকুন্তী সংবাদ, বিদায় অভিশাপ, গান্ধারীর আবেদন ইত্যাদির মতো অসাধারণ কারনটিক মহাভারতেরই কাহিনী নিয়ে লেখা। আর রামায়ণের কাহিনী নিয়ে লিখলেন গীতিনাট) বাল্মীকি প্রতিভা কালমৃগয়া, চরিত্র যেখানে প্রধান নয়, ভাবই যেখানে বেদনা, গানই যে বেদনার বিস্তারে গভীরতায় সহযোগী। আর লিখলেন 'অহল্যার প্রতি', 'ভাষা ছন্দ', 'পতিতা' আশ্চর্য সব কবিতা, কিংবা চৈতালি' মধ্যে প্রথিত একটি করুণাঘন ছোট সনেট 'বনে রাজ্যে'—যার উল্লেখ প্রায় কোনো সমালোচকই করেন না। এছাড়া আছে 'বনবাস'-এর মতো শিশুর ইচ্ছাপূরণের কবিতা কিংবা ছিয়াত্তর বছর বয়সে লেখা 'আকাশ প্রদীপ কাব্যেরযাত্রাপথ' কবিতা যেখানে ছোটবেলাকার কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়ার স্মৃতি থমকে আছে। রামচন্দ্রের জীবন যে বাঁধা পথে এগোতে পারতো সেখানে পিতৃসত্য পালন, সীতাহরণ সীতা পরিত্যাগের অনিবার্য ঘটনা অভাবিতপূর্ব দুঃখ, বিপদ, সংগ্রাম, অন্ত কারুণ্য এনে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ সৃষ্টি করেছে যাতে জীবনের অনির্দেশ্যতাই প্রমাণিত হয়। রামচন্দ্র যেন রূপকথার রাজপুত্র, কোটালপুত্র, সদাগর-পুত্রের মতোই বেরিয়ে পড়েছে অজানা জীবনের পথেসমাধানের গোপন মাণিকটি খুঁজে বার করার জন্যে। এই অন্বেষণই জীবনরস। জীবনের সোনার হরিণ এইভাবেই আভাস দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। এমন কিছু কবিতাও আছে যেখানে প্রসঙ্গত রামায়ণের বিচিত্র প্রতীকী ব্যাথায় এই রকম নতুন ইশারা-ইঙ্গিতের বিদ্যুৎদীপ্তি ঝলসে ওঠে।

আবার এও লক্ষ করার মতো যে, চিন্তামূলক রচনায় মহাভারতের তুলনায় রামায়ণই বেশি জায়গা নিয়েছে পরবর্তী সাহিত্যিক আলোচনায়। 'বঙ্গদর্শনে' ১৩০৪ সালের আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত 'সাহিত্যসৃষ্টি' প্রবন্ধে এবং 'প্রবাসী' ১৩১৯ সালের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত 'ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা এবং আরও বহু প্রবন্ধে রামায়ণকে রবীন্দ্রনাথ যতখানি বিস্তৃত আলোচনার বিষয় করে নিয়েছেন, মহাভারতকে নিয়ে সে তুলনায় কমই লিখেছেন। উল্লিখিত দুটি প্রবন্ধে রামায়ণের অন্তর্বাহী ভারতীয় সমাজ ইতিহাসের ধারাটিকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং সে ব্যাখ্যাতে স্বভাবতই প্রমাণ হয়ে গেছে, মহাভারতের তুলনায় ভারতীয় জীবনে রামায়ণ অনেক বেশি অন্তরঙ্গ। 'পঞ্চভূত' (১৮৯৭) বইটিতেও ক্ষিতির মুখে রামায়ণ কাহিনীর মধ্যে প্রেমের (সীতা যার প্রতীক) সঙ্গে ত্যাগ প্রচারক প্রবীণ বৈরাগ্যধর্মের (রামচন্দ্রের পারিপার্শ্বিক সমাজ) দ্বন্দ্বের কথা বলা হয়েছে। ভারতীয় জীবনধর্মে যেমন ত্যাগ, বৈরাগ্যকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ক্ষিতির দৃষ্টিতে রামচন্দ্র সেই রকম ত্যাগেরই আদর্শ, সীতা, লব, কুশ সেই আদর্শে প্রেমের রক্তরাগটুকু রেখে গেছে রামায়ণের সামাজিক পটভূমি ব্যাখ্যা করে তিনি দেখিয়েছেন, মহাভারত যে প্রত্যক্ষতার সঙ্গে সমকালীন ভারতীয় সমাজ মানসিকতার প্রসারকে ধরে রেখেছে, রামায়ণ সেভাবে ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু মহাভারতের তুলনায় রামায়ণের অপেক্ষাকৃত সংহত কাহিনী কাব্যসৌন্দর্য ঠিক ততোখানি ঐতিহাসিক তথ্যের রস দেয়নি, যা দিয়েছে তা তীব্র মানবিক রস, অন্তর্নিহিত মানবনীতির ইতিহাস। অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধা, ভ্রাতৃপ্রেম, দাম্পত্য প্রেম, অপত্য স্নেহবিশেষ করে সামাজিক নৈতিক জীবনের এই দিকগুলি রামায়ণের রাম, লক্ষ্মণ সীতার মধ্যে কাব্যিক রসে মূর্ত হয়ে উঠেছে তুলনাহীনভাবে। অন্যদিকে মহাভারতের কাহিনী তার নাটকীয় চারিত্রিক সম্ভাবনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়েও ভারতীয় মনে এতোখানি অন্তরঙ্গ আসন পায়নি। কবির জীবন সৃষ্টি নিয়ে সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথ যখন ভাবছিলেন তখন তার মনে হচ্ছিল বাল্মীকির জীবন নিয়ে যে অতি-কথা বা মিথ গড়ে উঠেছে তা একদিক থেকে বাল্মীকির জীবন-তথ্যের চেয়েও সত্য। কারণ ক্রেীষ্মের বিয়োগ-ব্যথায় যে ক্রৌঞ্চীর বিলাপ দেখে বাল্মীকির কারুণ্য জেগেছিল সেই কারুণ্য তাঁর বর্ণিত রাম-কথার মধ্যেও থেকে গেছে। ক্রৌঞ্চ হত্যাকারী ব্যাধের মতো রাবণও আদর্শ দাম্পত্য জীবনে যে বিচ্ছেদ এনে দিয়েছিল তা মিলনের পরেও এড়ানো গেল না, মৃত্যুর চেয়েও তা হয়ে উঠেছিল ভয়ানক। এই ব্যাখ্যা কতখানি মনস্তত্ত্বসম্মত জানি না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছে রামায়ণ-কাহিনী হয়ে উঠেছিল ক্রৌঞ্চ-দম্পতির বেদনাদায়ক বিচ্ছেদের প্রতিমান। সাহিত্য সৃষ্টি' এবং 'গ্রাম্য সাহিত্য' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ রামচন্দ্রকে সহনশীলতা, আত্মত্যাগ এবং দুর্লভ আত্মদমনের প্রতীক হিসেবে দেখেছেন। এই কারণেই রামচন্দ্রকে আদর্শ নায়ক করতে গিয়ে বাল্মীকির বাক্যভঙ্গিকে প্রায় আক্ষরিক অনুসরণ করে 'ভাষা ছন্দ' কবিতায় পার্থিব গুণাবলীর মহত্তম প্রকাশরূপে রামচন্দ্রকে দেখেছেন। আদিকাণ্ডে বাল্মীকির বর্ণনায় দেখি :

চরিত্রেণ কো যুক্তঃ সর্বভূতেষু কো হিতঃ

বিদ্বান কঃ কঃ সমর্থণ কশ্চৈবা প্রিয়দর্শনঃ।

আত্মবান কো জিত ক্রোধো দ্যুতিমান কোইনসূয়কঃ।

কথা বিভেতি দেবাশ্চ জাত রোষস্য সংযুগে।। (১১০-)

ভাষা ছন্দ' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন :

কহ মোরে বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম,

কাহার চরিত্র ঘেরি সুকঠিন ধর্মের নিয়ম

ধরেছে সুন্দর কান্তি মাণিক্যের অঙ্গদের মতো,

মহৈশ্বর্যে আছে নম্র, মহাদৈন্যে কে হয়নি নত

স্পষ্টই বোঝা যায়, রামায়ণ রবীন্দ্রনাথের মনে কবিত্বের বা সৃষ্টির আবেগের ইশারা জাগিয়েছে, বিচ্ছেদ-বেদনার জীবনপাত্রটি হাতে ধরে দিয়েছে, একটি আদর্শ রাজ-চরিত্রের উদাহরণ যুগিয়েছে, যে রাজন্য গুণাবলী রবীন্দ্রনাথের প্রতীক-নাটকে রাজার চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে।ভাষা ছন্দ' কবিতায় বর্ণিত রামচন্দ্রের অঙ্গসৌষ্ঠবের সঙ্গে 'রাজা' নাটকের সুদর্শনার মুখে বর্ণিত রাজার অঙ্গসৌষ্ঠবের একটুখানি মিলও আছে। যে ক্ষত্রিয় রামচন্দ্র গুহক চণ্ডালকে বন্ধু বলে গ্রহণ করেছিলেন, বহুজাতিকে বিদ্বেষের সংকোচ থেকে প্রেমের ঔদার্যের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই সমাজের গতির পক্ষে বীর্যপ্রকাশক রামের রাজচরিত্রই প্রতীক-নাটকে জাল-মুক্ত প্ৰজা-নায়ক রাজা হয়ে দেখা দিয়েছে। পরবর্তীকালের আরোপিত সমাজরক্ষক রামকে তিনি জালবদ্ধ রাজার মধ্যেই দেখতে চেয়েছেন। রামায়ণের এই ব্যাখ্যায় সমালোচকদের আপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু, সত্যি হোক মিথ্যে হোক, প্রতীক- নাটকে মুক্তির দূত, আলোর দূত হয়ে এসেছে।

তেমনিপতিতাকবিতায় ঋষ্যশৃঙ্গকে মুগ্ধ করবার জন্যে যে আশ্চর্য সকালটিকে রচনা করা হয়েছে সেখানে পতিতার মুখে ঋষ্যশৃঙ্গের দ্বারা তার অতর্নিহিত দিব্যতার উদ্বোধনের শিহরণটুকুকে বলতে দেখা গেছে। সেই রোমাঞ্চকর আত্ম-উদ্বোধনের একটুখানি নাটকীয়তার পরেই সমস্ত কবিতাটি একটি কিশোরীর মুগ্ধ আত্মসমর্পণের আবেগে ভরা। এই ব্যক্তিগত নাটকীয় আবেগ চমৎকার প্রতিমানে ধরা পড়েছে।মানসী' অহল্যার প্রতিকবিতায়। অহল্যা সেখানে আদিম পাষাণী পৃথিবীতে সবুজের উদ্বোধন। জীবনের উদ্বোধনের প্রতীক। তার নগ্ন শরীরে সবুজের পুষ্পিত বিকাশ নিখুঁত সূক্ষ্মতায় বিকশিত। অহল্যা সেখানে প্রথম আলোর স্পর্শ, মরুভূমিতে প্রথম বর্ষণের স্নিগ্ধতা, পাথর ভেঙে বেরিয়ে আসা জীবধাত্রী মাটির রস, বিশ্বজননীর শরীরে ফুটন্ত ফুলের জাগরণ। অপূর্ব রহস্যময়ী মূর্তি বিবসন, নবীন শৈশবে স্নাত সম্পূর্ণ যৌবনপূর্ণস্ফুট পুষ্প যথা শ্যামপুত্র পুটে শৈশবে যৌবনে মিশে উঠিয়াছে ফুটে এক বৃত্তে। বিস্মৃতি সাগরনীল নীরে প্রথম উষার মতো উঠিয়াছে ধীরে। একটি গানেও অহল্যার এই প্রতিমান বা সিম্বল একই তাৎপর্য এনেছে :

আমি আঁধার বিছায়ে আছি রাতের আকাশে

তোমারি আশ্বাসে

তারায় তারায় জাগাও তোমার আলোক-ভরা বাণী,

ওহে সুন্দর, হে সুন্দর।

পাষাণ আমার কঠিন দুঃখে তোমায় কেঁদে বলে,

পরশ দিয়ে সরস করো, ভাসাও অশ্রুজলে,

ওহে সুন্দর, হে সুন্দর।

শুষ্ক যে এই নগ্ন মরু নিত্য মরে লাজে আমার চিত্ত মাঝে,

শ্যামল রসের আঁচল তাহার বক্ষে দেহ টানি,

ওহে সুন্দর, হে সুন্দর।

 অহল্যার প্রতি' কবিতায় যে মহাজননীর প্রতীক্ষায় অহল্যা তার 'অনুর্বর অভিশাপ'- মুক্ত হতে চেয়েছে এবং মুক্তি পেয়েছেসদ্যোজাত কুমারী' হয়ে, -গানে সেই মুক্তির প্রার্থনা। রামচন্দ্রঅহল্যার প্রতি'-তে মহাজননী, উদ্ধৃত গানেসুন্দর’, জীবধাত্রীর অন্তরের উত্তাপ, আলো আর রসায়ণের প্রতীক।মানসীকাব্যেরই আরেকটি কবিতাকুধ্বনি’-তে দূরাগত প্রাকৃতিক সঙ্গীতের প্রতীক কুলুধ্বনির মধ্যে শকুন্তলার নবমিলনের মুখ এবং সীতার বিচ্ছিন্নতার বেদনা দুই- মিশে গেছে। এখানে প্রকৃতি যেমন কুহুধ্বনিতে করুণা বর্ষণ করেছে, সীতার দুঃখ তেমনি সাধারণভাবে মানবিক বেদনারই প্রতিমান হয়ে এসেছে।সোনার তরীপুরস্কার' কবিতায় (১৮৯৩) দেখা যায়, রামায়ণ-কাহিনীর তিনটি সংকট- মুহূর্তের ছবিকে কবি তুলে ধরেছেন তীক্ষ্ণ ট্র্যাজিক বোধে। রামের বনগমনের দিনটি সীতা লক্ষ্মণের সঙ্গে তাঁর অযোধ্যা ছেড়ে যাওয়ার মর্মভেদী দিনটি, বনবাসে কুটীরে ফিরে এসে একদিন সীতাকে খুঁজে না পাওয়ার শূন্যতা এবং শেষত অসহায় সীতার দ্বিধাবিভক্ত ধরিত্রীর বুকে আশ্রয় গ্রহণের মর্মান্তিক দৃশ্যএই তিনটি তীব্র অভিজ্ঞতা রামচন্দ্রের মনে যে তীক্ষ্ণ বেদনা রেখে গেছে তা যুগান্তরে মানুষের মনে এখনও বেজে চলেছে। অতএব এখানেও এই তিনটি মর্মান্তিক দৃশ্যের প্রতীকে মানব-ভাগ্যের চিরন্তর নিয়তিকেই ধরতে চেয়েছেন কবি, যে নিয়তির অমোঘ পরিণতিকে ট্র্যাজিক শিল্পে ধরা হয়েছে চিরকাল।চৈতালিবনে রাজ্যে' (চৈত্র, ১৩১২) নামে একটি সনেটেও দেখি, রামচন্দ্রের একটি করুণ মানসিকতাকে কবি তুলে ধরেছেন। সীতাকে বাল্মীকির আশ্রমে পাঠিয়ে রাজকাজ সেরে গৃহশয্যায় এসে শয্যার অর্ধেক অংশ শূন্য দেখছেন রামচন্দ্র। তখন তাঁর মনে হচ্ছে, বনবাসের সরল জীবনে সুখ ছিল, এখন এই রাজ-ঐশ্বর্যের মধ্যে সুখ তো আবার বনেই ফিরে গেছে।নিত্যসুখ দীনবেশে গেছে বনে ফিরে / স্বর্ণময়ী চিরব্যথা রাজার মন্দিরে।' সীতা সেই নিত্য-সুখের প্রতীক। এবং যে-পর্বে কবিতাটি লেখা সে সময়ের কথা মনে রাখলে, এই প্রতীকটি একটু প্রসারিত করে স্বদেশীয় পূর্বগৌরব স্বাধীনতার তাৎপর্যেও নেওয়া যায়। ভারতবাসীর অন্তরাত্মা রামচন্দ্রের মতোই পরিত্যক্ত বিষণ্ণ। এক অনতিপরিচিত গানে সীতা আর স্বাধীনতা-মুক্তির অভিন্নতা লক্ষ্য করি :

ফিরে ফিরে আমার মিছে ডাক স্বামী,—

সময় হলো বিদায় নেব আমি।।

অপমানে যার সাজায় চিতা

সে যে বাহির হয়ে এল অগ্নিজিতা,

রাজাসনের কঠিন অসম্মানে

ধরা দিবে না সে যে মুক্তিকামী।।

আমায় মাটি নেবে আঁচল পেতে

বিশ্বজনের চোখের আড়ালেতে,

তুমি থাকো সোনার সীতার অনুগামী।।

বনে রাজ্যে' সনেটটি যেদিন লেখেন সেইদিনইদাও ফিরে সে অরণ্য' নামে বিখ্যাত সনেটটিতে লেখেন : পাষাণ পিঞ্জরে তব/নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব/চাই স্বাধীনতা।' কাজেই সীতাহীন রামচন্দ্রের বেদনা যে স্বাধীনতা-হীনতার বেদনা, একথা বললে বোধহয় কষ্ট-কল্পনা হবে না।

শেষ পর্বের নাট্যরচনাকালে, বিশেষ করে যখন তিনি 'রক্তকরবী' (১৯২৫) লিখলেন তখন রামায়ণ-কাহিনীর তাৎপর্য তাঁর হাতে নতুন প্রতীকে সংহত হল।রক্তকরবী' রচনার বারো বছর আগেকার লেখা 'ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা'- বক্তব্যকেই এখানে তিনি আবার নতুন করে স্মরণ করেছেন। সোনার হরিণের কাহিনী যে যন্ত্রসভ্যতার প্রলোভনে পড়া বিনষ্ট কৃষি-সভ্যতার কাহিনী তা আবার তাঁর মনে হয়েছে।রক্তকরবী' যক্ষপুরী মারীচের মায়াবী হরিণের মতো আমাদের নিষ্পাপ অকৃত্রিম আত্মাকে গ্রাস করছে। যতক্ষণ না যক্ষপুরীর রাজা বেরিয়ে এসে প্রজাদের সঙ্গে একাকার হতে গিয়ে দেখছেন যে তাঁরই তৈরি যন্ত্র তাঁকে বিনাশ করতে এগিয়ে আসছে ততক্ষণই এই আগ্রাসন চলেছে। একই সঙ্গে শত্রুধ্বংসী আত্মধ্বংসী এই যান্ত্রিকতাকে উদ্দেশ্য করেই রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, 'আমার স্বল্পায়তন নাটকে রাবণের বর্তমান প্রতিনিধিটি একই দেহে রাবণ বিভীষণ। সে আপনাকে আপনিই পরাস্ত করে।'

চিত্রা'নগরসঙ্গীত' কবিতায় তিনি বলেছিলেন, 'কোন্ মায়ামৃগ কোথায় নিত্য/স্বর্ণঝলকে করিছে নৃত্য, তাহারে বাঁধিতে লোলুপ-চিত্ত/ছুটিছে বৃদ্ধ-বালকে।' কিন্তু এই সোনার হরিণের প্রতিমানকে কবি সর্বত্র কিন্তু সর্বনাশী মায়া কিংবা স্বর্ণঝলকের প্রলোভনের তাৎপর্যে ধরেননি। 'রাজা' নাটকে এক পাগলকে পথে বেরিয়ে যখন গাইতে শুনি, ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই'—তখন সে হরিণ মুক্তি-উৎকণ্ঠার প্রতীক এই চিরপলাতক রহস্য-রোমাঞ্চকর জীবনের পেছনে পেছনে অবাধ অনুসরণের প্রতীক। যে বনের হরিণ মনের মধ্যে তাকে বাঁধলেই তো কষ্ট। জীবনের নিত্য নতুন প্রলোভনে মুগ্ধ হওয়াতেই জীবনের রহস্য, মৃত্যুর সামনে জীবনের এই হলো জাদুকরী খেলা। 'চিত্রাঙ্গদা' কাব্যনাট্যে দেখিবিশ্বের ঐশ্বর্য চিত্রাঙ্গদাকে পেয়ে কর্মহীন সক্রিয় অর্জুন যখন মৃগয়ার কথা ভাবছে তখন চিত্রাঙ্গদা তাকে বলেছিল :

তবে কি জেনেছ রি

এই স্বর্ণ মায়ামৃগ তোমারে দিয়েছে ধরা?

নহে, তাহা নহে।

বন্য হরিণী আপনি রাখিতে নারে আপনারে ধরি।

চকিতে ছুটিয়া যায় কে জানে কখন স্বপনের মতো।

ক্ষণিকের খেলা সহে, চিরদিবসের পাশ বহিতে পারে না।

মায়ামৃগী ছুটিয়া বেড়ায়, মেঘাচ্ছন্ন জগতের মাঝে, বাধাহীন, চিরদিন।

সোনার হরিণ সেই ক্ষণি উজ্জ্বল পরমায়ুর জীবন।

তাই মনে হয়, মহাভারত রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি রঙ্গমঞ্চ যেখানে চরিত্রেরা তাদের archetype বা আদি রূপসজ্জার ওপরে যুগোপযোগী নতুন সাজ চড়িয়ে নতুন করে দ্বন্দ্বে মেতেছে। কিন্তু রামায়ণের স্রষ্টা তাঁর কাছে এমন এক জীবন-যাদুকর যার যিনি সাহিত্যের সম্ভাব্য সত্যের জাদুদণ্ড হাতে নিয়ে অন্য এক সত্যতর অযোধ্যার স্রষ্টা হয়ে বসেছেন, তাঁর হাতের গুণে অহল্যা জেগে উঠে মরুবিজয়ের কেতন উড়িয়ে দেয়, পতিতার মনে দিব্যতার অপার্থিব শিহরণ জাগে, প্রাকৃতিক কূজনে-গুঞ্জনের মধ্যে সীতার মর্মান্তিক দুঃখই বেজে ওঠে, ক্রৌঞ্চ-ঘাতক ব্যাধ হঠাৎ হয়ে যায় রাবণ, রামচন্দ্র হয়ে ওঠেন ব্যথিত ভারত-আত্মা, সীতা হয়ে ওঠেন ব্যথিত স্বাধীনতাকামী যিনি সকল-বহা সকল-সহা' 'মাতার মাতা' হয়ে বিশ্বমায়ের মতোই আঁচল পাতা পেতে দেন, রাক্ষসপুরী হয়ে যায় যক্ষপুরী, সোনার হরিণ কখনো হয় লোভনীয় সর্বনাশ, কখনো হয়ে যায় মৃত্যুর হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অবিস্মরণীয় জীবনের মোহন রূপ। রামচন্দ্রের মাণিক্যের অঙ্গদ কখনো ঝলসে ওঠে রবীন্দ্রনাথেররাজা দেহে, শূদ্র শম্বুকের ঘাতক রামচন্দ্র নয়, চণ্ডাল গুহকের পরমবন্ধু রামচন্দ্র মিলেমিশে একাকার হয়ে যান কারাগার-মুক্ত ধ্বজা ভেঙে বেরিয়ে আসা রাজার প্রতীকে, যে রাজা দীন পতিতের ভগবান, যাঁর পদতলে আশ্রয় নেয় লক্ষ মাটির ঢেলা।


0 Reviews