Read more
রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা
রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা
পুনশ্চ, শেষসপ্তক, পত্রপুট ও শ্যামলী—এই চারটি কবিতার বইতে রবীন্দ্রনাথ গদ্যকবিতার যে-আসর জমিয়েছিলেন, সে আসরের ইতিহাস বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ মানসী, বলাকা, পলাতকা এবং লিপিকার ছন্দ মুক্তি প্রচেষ্টার কথা পরে বহুবার বলেছেন। এবং শেষ পর্যন্ত গদ্যের মধ্যে কাব্যরস খুঁজে পেয়ে কবি গদ্যকাব্যের সপক্ষে অশ্রান্ত কৈফিয়ৎ দিয়েছেন। গদ্যকাব্য সম্পর্কে তাঁর প্রবন্ধ ও কৌতূহলীদের কাছে লেখা চিঠিপত্র দেখে মনে হয়, তিনি নতুন যুগের অব্যর্থ কাব্যবাহন খুজে পেয়েছেন। গদ্যকাব্য সম্পর্কে তিনি যে-সব কথা বলেছেন, তার থেকে প্রধান দাবীগুলি মোটামুটি উপস্থাপিত করা যেতে পারে। প্রথমত, তিনি বলেছেন যে, ছন্দোবদ্ধ কাব্যের সসজ্জ, সলজ্জ অবলুণ্ঠন প্রথা থেকে তিনি গদ্যকাব্যকে মুক্তি দিয়েছেন। পুনশ্চ কাব্যের ভূমিকায় কবি বলেছেন :
'গীতাঞ্জলির গানগুলির ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করেছিলেন। এই অনুবাদ কাব্যশ্রেণীতে গণ্য হয়েছে। এই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজিরই মতো বাংলাগদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কিনা .... পরীক্ষা করেছি, লিপিকার অল্প কয়েকটি লেখায় সেগুলি আছে।... গদ্যকাব্যে অতিনিরূপিত ছন্দের বন্ধন ভাঙাই যথেষ্ট নয়, পদ্যকাব্যে ভাষায় ও প্রকাশরীতিতে যে একটি সসজ্জ সলজ্জ অবগুণ্ঠন-প্রথা আছে তাও দূর করলে তবেই গদ্যের স্বাধীন ক্ষেত্রে তার সঞ্চরণ স্বাভাবিক হতে পারে। দ্বিতীয়ত, তিনি দাবি করেছেন যে গদ্যছন্দের প্রবর্তন করে তিনি কাব্যের পরিধি বাড়িয়েছেন। পুনশ্চ কাব্যের ভূমিকাতেই তিনি বলছেন :
“অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেকদূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব, এই আমার বিশ্বাস, এবং সেইদিকে লক্ষ্য রেখে গ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলি লিখেছি।”
তৃতীয়ত, তিনি দাবি করেছেন, গদ্যছন্দে তিনি এমন অনেক কবিতা লিখেছেন, যা তাঁর পক্ষে প্রচলিত কাব্যছন্দে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। গদ্যকবিতার সপক্ষে তাঁর আর যা- কিছু বক্তব্য তা এই তিনটি দাবিরই বিস্তার বলা যেতে পারে।
এখন এই তিনটি দাবির মূল্য কতখানি তা বিচার করা যেতে পারে। প্রথম সিদ্ধান্তের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় কবি বলেছেন যে, রসসৃষ্টিই আমাদের লক্ষ্য। কাজেই তা পদ্যছন্দের নর্তনে বা গদ্যছন্দের পদযাত্রায়—যাতেই আসুক না কেন, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখার দরকার নেই। তবে অতিনিরূপিত কাব্যছন্দ যে ভাবের স্বচ্ছন্দ বিহারের বিরোধী এবং গদ্যছন্দেই সেই স্বচ্ছন্দ বিহার সম্ভব—একথাও কবি জোর দিয়ে বলেছেন। এর উত্তরে বলা যেতে পারে যে, ছন্দের মধ্যে ভাবের স্বচ্ছন্দ বিহার কবিপ্রতিভার উপর নির্ভর করে। একটু আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, যিনি ছন্দকাব্যে ভাবের স্বচ্ছন্দ বিহারের বাধা অনুভব করলেন। অকবি বা অপরিণত কবির হাতে ছন্দের নিয়মিত স্পন্দন-নর্তন হয়তো ভাবপ্রকাশের বাধা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু শ্রেষ্ঠ কবির ক্ষেত্রে একথা কিছুতেই সত্য নয়। মহাকবিরা ছন্দকাব্যকেই মানুষের নিবিড়তম ও বিস্তৃততম অনুভূতি প্রকাশের বাহন করে এখনও ‘মহাকবি' মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছেন। তাছাড়া গদ্যকাব্য ছন্দাকাব্যের চেয়ে স্বাভাবিক—একথা বলেও কবি গদ্যকাব্যের আপেক্ষিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু কোনো পাঠক কি জোর গলায় বলতে পারেন যে, নিতান্ত স্বাভাবিকতার খাতিরেই রবীন্দ্রনাথের গদ্যকাব্য তাঁর ছন্দকাব্যের চেয়ে আরও বেশি প্রিয়। বরঞ্চ স্বাভাবিকতার যথাযথ অনুকরণেই তো কবিতা জাতিচ্যুত হতে পারে। স্বাভাবিক হয়েও যা স্বভাবকে অতিক্রম করে যায় তাই তো শ্রেষ্ঠ শিল্প। কবি নিজেও তো বলেছেন : কিন্তু বিষয় বাছাই করা নিয়ে তার রিয়ালিজম নয়, রিয়ালিজম ফুটবে রচনার জাদুতে। সেটাতেই বাছাইয়ের কাজ যথেষ্ট থাকা চাই, না যদি থাকে তবে অমনতরো অকিঞ্চিৎকর আবর্জনা আর কিছুই হতে পারে না।` (সাহিত্যের স্বরূপ) রবীন্দ্রনাথের এই কৈফিয়ৎ-ব্যাখ্যার যে উত্তর দেবার চেষ্টা করছি তার সমর্থন পাই এলিয়েটের উক্তিতে :
Only a bad poet could welcome free verse as a liberation from
form. It was a revolt against dead form, and a prepration for a new form or for
the renewal of the old; it was an insistence upon the inner unity which is
unique to every poem, against the outer unity which is typical..
পাউণ্ডের কাব্যসংকলনের ভূমিকাতেও এলিয়ট এই কথারই প্রতিধ্বনি করে বলেছিলেন : No verse is libre for the man who
wants to do a good job. কাজেই কবি গদ্যে বা পদ্যে যাতেই রসসৃষ্টি করুন না কেন—কবিকে শ্রেষ্ঠ শিল্পের কলাকৌশল অবলম্বন (insistence upon the inner unity-র মধ্যে যার স্পষ্ট ব্যঞ্জনা রয়ে গেছে) করতেই হয়। সে-কলাকৌশল সসজ্জ সলজ্জ বা আটপৌরে—যাই হোক, কবিকে তার প্রয়োগে পরিশ্রম করতেই হয়। এবং প্রতিভাবানের পক্ষে সে পরিশ্রম খুবই আনন্দদায়ক। একথা গদ্যছন্দের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও আমরা মানতে বাধ্য। রবীন্দ্রনাথও ‘গদ্যছন্দ' প্রবন্ধের এক জায়গায় গদ্যের অসংকোচ ও তার স্বাধীন বিচরণক্ষেত্রকে একটু বিশেষিত করেছেন। তিনি বলেছেন : ‘একে বলতে হবে কাব্য, বুদ্ধির সঙ্গে এর বোঝাপড়া নয়, একে অনুভব করতে হয় রসবোধে। সেই জন্যেই যতই সামান্য হোক, এর মধ্যে কাব্যসংস্থানের একটা শিল্পকলা, শব্দব্যবহারের একটা ‘তেরছা চাহনি' রাখতে হয়েছে। সুবিহিত গৃহিণীপনার মধ্যে লোকে দেখতে পায় লক্ষ্মীশ্রী, বহু অলংকার তার প্রকাশ নয়। ভাষার কক্ষেও অনতিভূষিত গৃহস্থালি গদ্য হলেও তাকে সম্পূর্ণ গদ্য বলা চলবে না, যেমন চলবে না আপিসঘরের অসজ্জাকে অন্তঃপুরের সরলশোভনতার সঙ্গে তুলনা করা। আপিসঘরের ছন্দটা প্রত্যক্ষই বর্জিত, অন্যত্র ছন্দটা নিগূঢ় মর্মগত, বাহ্য ভাষায় নয়, অন্তরের ভাবে।’
এই ভাববিন্যাসের শিল্প বা ভাবের ছন্দ সৃষ্টি করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নিজের গদ্যকবিতারও বার বার সংশোধন করতে হয়েছে। গদ্যছন্দের স্বাধীন বিচরণগুণ থাকা সত্ত্বেও কার্যত রবীন্দ্রনাথকে ছন্দকাব্য সৃষ্টির সমান পরিশ্রমই করতে হয়েছে। গদ্যকাব্যের প্রবর্তক ওয়াল্ট হুইটম্যানও অত্যন্ত সচেতন শিল্পী ছিলেন। তাঁর The Prayer of Columbus কুড়ি বার সংশোধনের ফল। কাজেই গদ্যকে কাব্যের আসরে নামিয়ে উল্লসিত হবার কথা নয়। কারণ কবিদের কাজ তাতে কিছু কমে না। নতুন পরীক্ষার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণায় কবি প্রথমে একটু উৎসাহ দেখিয়েছিলেন বেশি। ওপরে উদ্ধৃত উক্তি অপেক্ষাকৃত স্থির মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত
দ্বিতীয় দাবিতে কবি বলেছেন যে, তিনি গদ্যকবিতায় কাব্যের পরিধি অনেক বাড়িয়েছেন। কার্যক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এই দাবির সত্যতা বজায় রাখতে পারেননি বলেই মনে হয়। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন :
'গল্পরস, মনোবিশ্লেষণের রস, তুচ্ছ উপকরণ থেকে উদ্ভূত একরকম তৃণ-সুলভ গন্ধ, অলস অর্ধোক্তির আয়েসী আমেজ, দার্শনিক মননের আলগা সুতোর গাঁথুনি—এই বিমিশ্র বিচিত্রতা এই কবিতাগুলি থেকে বিকীর্ণ হয়েছে।" তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতার স্বাদবৈচিত্র্য এখানেই। লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, এই গুণগুলি গদ্যকাব্যের বিশিষ্ট গুণ নয়। গল্পরস ও মনোবিশ্লেষণের রসের প্রচুর প্রমাণ ‘পলাতকা'র মধ্যে আছে। তুচ্ছ-অতুচ্ছ সব বিষয় সম্পর্কেই কবির সমান পক্ষপাত বরাবর ছিল। প্রকৃতিবিষয়ক কবিতার অলস অর্ধোক্তির আয়েসী মেজাজ ছড়িয়ে আছে। আর দার্শনিক মননের ছাপ তো কবির বেশির ভাগ লেখাতেই স্পষ্ট। গল্প, কবিতার ক্ষেত্রে স্বভাবতই তা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। গদ্যকবিতার বইগুলি ছাড়া অন্যত্রও গল্পকবিতা তিনি অজস্র লিখেছেন। ওই ‘পলাতকা'র মধ্যে দার্শনিক মননের 'আম্মা' সুতোর গাঁথুনি'র প্রমাণ অনেক পাওয়া যাবে। তা ছাড়া গদ্যকবিতার স্বাতন্ত্র্য্য নির্দেশ করতে গিয়ে কবি উপমার আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি ছন্দকাব্যকে পদ্মার সঙ্গে এবং গদ্য কবিতাকে কোপাই-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। পদ্মার বিরাট চেহারা যেন প্রাত্যহিক জীবন আর ভাবজীবনের বিরাট ব্যবধানের নির্দেশ করে দেয়। কিন্তু কোপাই-এর জলে প্রত্যহই ভাঙা ছাতার মানুষ, গরুর গাড়ি আর গুরুমশাই সবাই পার হয়ে যায়। কোপাই-এর জলে-স্থলে, এপারে-ওপারে নিবিড় সম্পর্ক। গদ্যকবিতাতেও সেইরকম দৈনন্দিন বাস্তব ও শিল্প-লোকের ওতপ্রোত সম্বন্ধ। এই দুটি কাব্যপ্রকৃতির স্বরূপবর্ণনায় গদ্য কবিতা যে শ্রেষ্ঠ তা প্রমাণিত হল না এবং ছন্দকাব্যের চেয়ে গদ্যকবিতা যে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য — সে-কথারও প্রমাণ মিললো না। যাই হোক, ভাবজীবনে আর বাস্তব-জীবনে অনেক তফাত হয়ে যাচ্ছে বলেই কবি কোলাব্যাঙ, নেড়ীকুকুর, ছেঁড়া-ছাতার কেরানি আর গুবরে পোকার কথা বলে কাব্যের চেহারায় প্রাত্যহিকতা নিয়ে এলেন। কিন্তু কোলাব্যাঙ, নেড়ীকুকুর ইত্যাদির কথা কাব্যের মধ্যে এতকাল লিখতে পারেননি বলেই দুঃখ করলেন শুধু। সে-দুঃখের উল্লেখটাই এই গদ্য-কাব্যে রইল। তার চেয়ে বেশি কিছু হলো না। আর ছেঁড়া ছাতার কনিষ্ঠ কেরানির যে বৈকুণ্ঠমুখী মেজাজ তিনি দেখালেন, তাতে প্রমাণ হয়ে গেল, 'এ গলিটা ঘোর মিছে', অর্থাৎ তুচ্ছ উপকরণ থেকে সেই স্বপ্নপ্রয়াণই ঘটলো। অখ্যাত জনের অজ্ঞাত মনের কবি হবার ইচ্ছেই হয়তো কবিকে 'ছেলেটা' 'সাধারণ মেয়ে' ইত্যাদি কবিতা লিখতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। কিন্তু ছেলেটা পাঠকের মনে তার দূরন্তপনার চেহারা নিয়ে একটি বিশেষ ছেলেতেই পরিণত হয়েছে। সাধারণ মেয়ে অসাধারণ হবার স্বপ্নেই পাঠকের মনে করুণ স্পর্শ রেখে গেছে। এক কথায়, শিল্পের যা স্বভাব তা-ই এই কবিতাগুলিকে পেয়ে বসেছে। বিষয়বস্তু যতই তুচ্ছ হোক না কেন, তাকে স্মরণীয় বা অসাধারণ করতে না পারলে তার সাহিত্যপদবী পাওয়া মুশকিল। আর শুধু গদ্যকবিতায় কেন, ছন্দকাব্যের মধ্যেও তো কবি সাধারণ মানুষের উপকরণ দিয়ে তার ওপর কবিত্বের রঙ ফলিয়েছেন। 'পলাকতার মানুষগুলি কি খুব অভিজাত ? বিচিত্রতা'র পসারিনিও তো সামান্য মেয়ে। “আকাশপ্রদীপে’র মা-হারা দুটি ভাই-বোন তাদের ছোট্ট ঘরের কোণ থেকেই তো আলোর নৌকায় ভেসে-আসা মায়ের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সর্বত্রই, কি গদ্য কবিতায় কি ছন্দকাব্য, কবির মন থেকে ‘সাম্প্রতের আবরণ' দ্রুত খসে যায়। সমস্ত ছন্দভাঙা অসঙ্গতির মধ্যেও সানাই-এর তানে ঐক্য-মন্ত্র ছড়িয়ে পড়ে। কাজেই গদ্যকবিতায় কাব্যের অধিকার বাড়েনি। আর সে-অধিকার বেড়েছে কিনা সে প্রশ্নের চেয়েও বোধ হয় কাব্য হয়েছে কিনা সে প্রশ্ন আরও গুরুত্বপূর্ণ। সেই জন্যই পরিধি বা অধিকার বেড়েছে কি না সে আলোচনা করতে গিয়ে শিল্পের স্বভাব, সাহিত্য পদবী ও কবিদৃষ্টিতে বাস্তবতার আবরণ উন্মোচনের কথা বলছি।
গদ্যকবিতার সমর্থনে তৃতীয় দাবিতে তাঁর গদ্য কবিতাগুলির অপরিহার্যতা প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর নিজের কাব্যসৃষ্টির ইতিহাস এই অপরিহার্যতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। তাঁর কাব্য রচনার পদ্ধতিও এই দাবিকে ভিত্তিহীন করে। প্রথমত দেখা যাক, কীভাবে তিনি বহুক্ষেত্রেই একই বিষয়কে ছন্দকাব্য ও গদ্যকবিতার বিষয় করেছেন। তিনি বলেছিলেন, 'আমি অনেক গদ্যকাব্য লিখেছি যার বিষয়বস্তু অপর কোনো রূপে প্রকাশ করতে পারতুম না।' কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাবে, একই বিষয়ে দুটি ভঙ্গিতেই প্রকাশিত হয়েছে এবং ছন্দকাব্যের ভঙ্গি গদ্যভঙ্গির তুলনায় কবিত্বের দিক থেকে কোনো অংশেই কম নয়। ‘পুনশ্চ' কাব্যের 'পুকুরধারে' কবিতায় কবি স্মৃতিভারে ব্যথিত হয়েছেন : দূরকালের কার একটি ছবি নিয়ে এল মনে।
স্পর্শ তার করুণ, স্নিগ্ধ তার কণ্ঠ,
মুগ্ধ সরল তার কালো চোখের দৃষ্টি।
তার সাদা শাড়ির রাঙা চওড়া পাড়ে
দুটি পা ঘিরে ঢেকে পড়েছে—
এই করুণ স্মৃতি ছন্দকাব্যের মধ্য দিয়েই কনিষ্ঠ কেরানির জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে: অনন্ত গোধূলিলগ্নে
সেইখানে
বহি চলে ধলেশ্বরী-
তীরে তমালের ঘনছায়া-
আঙিনাতে
যে আছে অপেক্ষা করে তার
পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।
'পুনশ্চ' কাব্যের 'শেষচিঠি'র করুণ-কোমল সুর পলাতকার যে-কোনো কবিতার সংক্ষিপ্ত সংস্করণ বলেই মনে হয়। 'পত্রপুটে'র 'তোমার অন্যযুগের সখা' কবিতায় কবি বলেছেন ।
ওগো চিরন্তনী,
আজ আমার বাঁশি তোমাকে বলতে এল—
যখন তুমি থাকবে না তখন তুমি থাকবে আমার গানে
ডাকতে এলেম আমার হারিয়ে যাওয়া পুরোনোকে
তার খুঁজে পাওয়া নতুন নামে।
এ কথা কুড়ি বছর আগেকার একটি ছন্দবদ্ধ বিখ্যাত গানেরই প্রতিধ্বনি :
তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি?
সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি।
নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,
আসবো যাবো চিরদিনের সেই আমি।
‘শেষ সপ্তক’ কাব্যের সতেরো সংখ্যক কবিতায় বিশ্বসৃষ্টির নৃত্যস্পন্দনকে কবি ধরবার চেষ্টা করেছেন :
অণু পরমাণু অসীম দেশে কালে
বানিয়েছে আপন আপন নাচের চক্র,
নাচছে সেই সীমায় সীমায়
গড়ে তুলছে অসংখ্য রূপ।
তার অন্তরে আছে বহ্নিতেজের দুর্দাম বোধ,
সেই বোধ খুঁজছে আপন ব্যঞ্জনা,
ঘাসের ফুল থেকে শুরু করে
আকাশের তারা পর্যন্ত।
এই নৃত্যস্পন্দনকে ধরবার চেষ্টা আছে নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা-র একটি গানে যা ছন্দধ্বনি-সংগমের এক অপূর্ব কাব্যরূপও বটে :
নৃত্যের বেশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু ; / পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে / বাজিল চন্দ্রভানু। / তব নৃত্যের প্রাণ-বেদনায় / বিংশ বিশ্ব জাগে চেতনায়, / যুগে যুগে কালে কালে ... ইত্যাদি। গদ্যকাব্য ও ছন্দকাব্য থেকে এইরকম সমান্তরাল দৃষ্টান্ত টেনে এই কথাই প্রমাণিত হল যে, গদ্যকাব্যের বহু বিষয় তিনি পূর্বে ও পরে ছন্দকাব্যে লিপিবদ্ধ করেছেন। কাজেই গদ্যকাব্যের বিষয়ের পক্ষে গদ্যভঙ্গি অপরিহার্য নয়। তাছাড়া, তাঁর কোনো কোনো কাব্যরচনার পদ্ধতিও গদ্যভঙ্গির অপরিহার্যতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। ‘আফ্রিকা' কবিতাটির দুটি ছন্দোবদ্ধ পাঠ বিংশখণ্ড রবীন্দ্র রচনাবলীর গ্রন্থ-পরিচয় অংশে পাওয়া যাচ্ছে। তার মধ্যে একটি ১৩৪৪ সালের আশ্বিনের 'কবিতা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রান্তিকের 'অবরুদ্ধ ছিল বায়ু' কবিতাটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তবকের ভাব শেষ সপ্তকের তেইশ সংখ্যক কবিতার মধ্যে গদ্য-রূপ পেয়েছে। গদ্যকাব্যের চিত্র-উপমা সমস্ত কিছুই প্রান্তিকের কবিতাটির ছন্দবদ্ধ পাঠের মধ্যে নিখুঁত বজায় আছে।'
গদ্যছন্দের সমর্থনে কবি বলেছেন :
“মূল কথাটা হচ্ছে এই যে, কবিতার ক্রমে ক্রমে ভাষাগত ছন্দের আঁটাআঁটির সমান্তরে ভাবগত ছন্দ উদ্ভাবিত হচ্ছে। পূর্বেই বলেছি, তার প্রধান কারণ, কবিতা এখন কেবলমাত্র শ্রাব্য নয়, প্রধানত পাঠ্য। যে সুনিবিড় সুনিয়ন্ত্রিত ছন্দ আমাদের স্মৃতির সহায়তা করে তার অত্যাবশকতা এখন আর নেই।'
এই উক্তিতে গদ্যভঙ্গিকে কাব্যের ভবিষ্যৎ হিসেবে প্রমাণ করবার চেষ্টা আছে। কিন্তু কবিতা পড়বার আনন্দে শ্রাব্য সৌন্দর্য যে অনেকখানি সহায়তা করে সে বিষয়ে সন্দেহ নেস। কবিও গদ্যকবিতাকে শেষজীবনের একমাত্র কাব্য কৌশল মনে করেননি। ‘পুনশ্চ’ থেকে ‘পত্রপুট’ পর্যন্ত (১৩৩৯-এর শ্রাবণ থেকে ১৩৪২-এর পৌষ পর্যন্ত) কবি গদ্যকবিতা লিখেছেন। এই সময়ের মধ্যে একটানা যে গদ্যকবিতাই লেখা হয়েছে তা নয়। ‘বীথিকা’র কবিতাগুলি ১৩৪১-এর বৈশাখ থেকে ১৩৪১-এর জ্যৈষ্ঠের মধ্যে রচিত। অনেক মিলযুক্ত সঙ্গীতও তিনি এই সময়েই রচনা করেছিলেন। ‘প্রহাসিনী', ও 'খাপছাড়া’র মিলের খেলা তিনি এই সময়েই দেখিয়েছিলেন। ‘প্রান্তিক’ ও ‘সেঁজুতি’র অধিকাংশ কবিতা এই সময়েই লেখা। গদ্যকাব্যের পর্যায় শেষ করে কবি আবার নতুন করে ছন্দের বেড়া বেঁধেছেন। যদি সত্যিই তিনি কাব্যের অবগুণ্ঠন খুলে দিয়েছেন বলে মনে করে থাকেন, তার পরিধি বা অধিকার বাড়িয়ে থাকেন, এবং গদ্যভঙ্গিরই উপযুক্ত বিষয় পেয়ে থাকেন, তাহলে সমসাময়িক রচনায় ছন্দ বর্জন করতে পারলেন না কেন? কেনই বা রবীন্দ্রকাব্যের ইতিহাসে গদ্যকাব্য রচনা একটি পর্যায় হিসেবেই শেষ হল?
গদ্যকাব্যের ব্যাপারে কবি যে-সমস্ত দাবি করেছেন, সে-সমস্ত দাবির বিরুদ্ধে প্রমাণ তাঁরই কাব্যজীবনের ইতিহাস, কাব্যরচনার পদ্ধতি এবং অপেক্ষাকৃত স্থিরচিত্তের সিদ্ধান্ত। যিনি সসজ্জ সলজ্জ অবগুণ্ঠন প্রথাকে মুক্ত করার দাবি করেছেন, তিনিই গদ্যকবিতার কলা- বৈভবের সজ্জাকে মানছেন। যিনি বলছেন কাব্যের পরিধি বেড়েছে, তিনি ইতিপূর্বেই মানুষের অভিজ্ঞতা ও অনুভবের শেষ পরিধি অনেকটাই ছুঁয়ে এসেছেন ছন্দকাব্যে। গদ্যকবিতাকে যিনি অপরিহার্য অঙ্গ ও কাব্যের ভবিষ্যৎ বলছেন, তিনিই সে-অঙ্গকে পরিহার করে কাব্যের সেই 'ভবিষ্যৎটিকে অতীতে ঠেলে দিয়ে চলে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবি-জীবনের এই বিরুদ্ধ আচরণ দেখে বারবারই এই কথা মনে হয়েছে যে, কবির কৈফিয়ৎ দিয়ে সবসময়ে কবির বিচার চলে না। কৈফিয়ৎদাতার চেয়ে শ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ অনেক বড়। রবীন্দ্রনাথ ... যে ছন্দবন্ধের বদলে গদ্যছন্দে কবিতা লিখেছেন সেটা এই কারণেই যে, ‘কোনো বিষয় বা ভাবের পক্ষে তখনকার মতো গদ্যছন্দই তাঁর বেশি উপযোগী মনে হয়েছে, তার মানে কবিতাটা গদ্যছন্দে এসেছে।” গদ্যকবিতার জন্ম-উৎসের আবেগটিকে অনেকটা এইভাবেই পাউণ্ড তাঁর একটি প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন :
One should write vers libre only when one must: that is to
say, only when the thing builds up a rhythm more beautiful than that of set
metres or more real, more a part of the emotion of the 'thing', more germane,
intimate, interpretative than the measure of regular accentual verse."
কিন্তু এই ‘মোর বিউটিফুল' ‘মোর রিয়্যাল' ইত্যাদির বোধ যে সার্বজনীন বা সর্বকালীন একথা হলফ করে বলা যায় না। লরেন্স ও তাঁর ‘নতুন কবিতাবলী'-র ভূমিকায় সেই উৎস-চেতনাটির স্পন্দনকে ধরবার চেষ্টা করেছেন :
But in free verse we look for the insurgent naked throb of
the instant moment. To break the lovely form of metrical verse and to dish up
the fragments as a new substance called vers libre, this is what most of the
free versiflers accomplish. They do not know that free verse has its own
nature, that it is neither pearl nor star, but instantaneous like psalm. It has
no goal in either eternity. It has no finsh. It has no satisfying stablity,
satisfying to those who like the immutable. None of this. It is the instant,
the quick, the very getting source of all will be and has been. The utterance
is like a spasm, naked contact, all influences at once. It does not want to get
anywhere. It just takes place. **
রবীন্দ্রমকালীন কাব্যসাহিত্য বাস্তবতার নতুন ধারণার চাপ এর প্রত্যক্ষতার আনতে চাইছিল। তার কলেই গদ্যকাব্যের ঝোঁক এনেছিল। এই ঝোঁক রবীন্দ্রনাথ সংগত কারণেই এড়াননি। তাই বলে তখনকার মতো কাব্যের ভবিষ্যৎ মনে হলেও গদ্যকবিতা কাব্যের ভবিষ্যৎ নয়। গদ্যকবিতা কাব্য-সাহিত্যে বাস্তবতার এক নতুন ভূমিকা রচনা করে পরবর্তী করতে স্থায়ী প্রভাব এনেছে। ছন্দকাব্যের পাশাপাশি এই মাধ্যমকেও আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু তাই বলে ছন্দকারের নিবিষ্ট এলাকাতেই তার সঞ্চরণ একথা জোর করে বলা যায় না। রন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তখনকার মতো আবেগের (বিষয়ের নয়) অপরিহার্য চাপে 'instantaneous like asalm' হয়েই এসেছে।
0 Reviews