গদ্যছন্দ ও রীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা

গদ্যছন্দ ও রীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা

Size

Read more

 

গদ্যছন্দ রীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা



গদ্যছন্দ  রীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা

একজন ফরাসি অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথকে একবার কারন : আপনি বর তা রচনা করেছেন কি? রবীন্দ্রনাথ উত্তরে বলেন : আম অনেক ফ্রি ভার্স রচনা করছি। বীন্দ্রনাথের এই মন্তব্য একজন বিশিষ্ট সমালোচককে সংশয়ার করেছিল। হইন্দ্রনাথ ফ্রি ভার্স বলতে কি বুঝিয়েছেন তা সমালোচকের কাছে অপর রয়ে গেছে। বলাকা, পলাতকা কিংবা পুনশ্চ কোন বই-এর বিশেষ বিশেষ কবিতাগুলিকে জি যেতে পারে তাও সমালোচকের মতে অল্পই রয়ে গেছে। তাঁর মতে : আর প্রবোধচন্দ্রের মুক্তক নয়, গদ্যছন্দেও নয়; ওদের ফ্রি ভার্স হলে কবিতার একাধিক রকম ছন্দ স্থান পায়, কিংবা গদ্যপান শোনো থাকে। এই কথা বলে তিনি যে কবিতাগুলি উদাহরণ হিসাবে উদ্ধৃতি দিয়েছেন সেগুলিতে এক এক পান্ডিতে এক এক রকমের ছন্দের সমাবেশ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এবং শেষ পর্যন্ত তার নত অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের 'গদ্যছন্দ উদ্ধৃত একটি কৃত কবিতার इকৃত অনুবাদ এবং স্ফুলিজের টি কবিद्याএইতিনটি কবিठा অর্থাৎ ফ্রি ভার্সের ভঙ্গিতে লেখা।

এই গদ্যকবিতার সংজ্ঞার্থ দেবার আগে সমালোচক সম্ভব করেছেন : ' কথা নির্ভর বলা যায় যে, কোনো ইংরেজ বা ফরাসির কাছে কি ভাে করেন নি। কিন্তু ফ্রি ভার্স বলতে শুধু বিভিন্ন ছন্দের মিশ্রণ বা গদ্যপণ্যের মিশ্রণ বোঝা না। ইংরেজের কাছে নয়, ফরাসির কাছেও নয়। কি ভার্সের পরিষ্কার কোনো সংজ্ঞার্থ ইংরেজ বা ফরাসি দিতে না পারলেও (না দেওয়াই নিরাপদ বলে অনেকে মনে করেন) মোটামুটি ককগুলি বিশিষ্ট লক্ষণের ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁরা

First and most obvious, the lines will be of irregular length, and these variations in length will not occur in any definite pattern. While the staple may be something like length of the standard English heroic line-ten syllables-there will be many short lines, and very likely, some a great deal longer than any recognised in tradi- tional versification.

Secondly, many of these lines are not assignable to any recog nised metrical scheme : we cannot tabel them iambics trochaics, anapaests, or anything else. In extreme cases no line of any recog nised verse-form appears at all; and there are who cherish the suspicion that what they are presented with is simply prose printed in short lengths. This suspicion is regarded as shrewd and damag ing by those who dislike free verse, and as callow and Philistine by those who approve it. And leaving value judgements out of it, it may turn out to have something in it after all. Thirdly, rhyme may be altogether absent; or if it appears, it does so sporadically, in no regular pattern, and many lines are left blank.

গদ্যকবিতা সম্বন্ধে আর একজন কবি তাঁর আলোচনায় ফরাসিদের বক্তব্যকে উপস্থাপিত করেছেন। তিনি বলেছেন ' :

M. Dujardin then describes what the elements of the new verse, ie. rhythm without metre, must logically be. Since the elements of the new verse can no longer be the syllabic feet of the metrical system, they must [ he says ]be rhythmic sense-units which are in revolt against them: and so [a] line of free verse is a grammatical unit or unity, made of accentual verbal units combining to a rhyth- mical import, complete in itself and sufficient in itself ; [b] the line may be various in length, and of any length, only not too long ; [c] the line is absolutely idifferent to syllable numeration or construc- tion apart from its own propriety of sense and pleasant movement; [d] and being free from all metrical obligations, such as caesura, hiatus etc, these and all other artifices proper to metrical prosodies are forbidden to it.

এই উদ্ধৃতি থেকে ইংরেজ ফরাসিদের মনোভাব বিচার করলে দেখা যাবে যে, ইংরেজরা ফ্রি ভার্সের ক্ষেত্রে ছন্দময় পংক্তিকে গ্রাহ্য করেছেন ; তবে একথাও বলেছেন যে, তাকে ভিত্তি করে বড়-ছোট নানা পংক্তির সমাবেশ হতে পারে, বা এমন পংক্তি থাকতে পারে যাকে ঠিক পরিচিত চন্দ-লক্ষণে ধরা যায় না যা পদ্যের লক্ষণাক্রান্ত নয়। মিল থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। থাকলে মাঝে-মধ্যে-শেষে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত থাকবে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই টি. এস. এলিয়টের সংজ্ঞার্থের খানিকটা বুঝতে বিক্ষিপ্ত সুবিধা হয় : there are two ways of coming at free verse-by starting with a conventional pattern and continually receding from it and by starting without any pattern at all and continually approaching some conventional one.

এই দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে, এলিয়টের 'Prufrock'- Jacobean blank verse-এর ভিত্তিতে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা হয়েছে। লরেন্সের 'Snake' গদ্যের ছন্দস্পন্দ বা ধ্বনিস্পন্দ ছেড়ে প্রায়ই lambic decasyllable ভিত্তিক blank verse-এর দিকে ঝুঁকেছে। রবীন্দ্রনাথের 'বলাকা' 'পলাতকা' বিশিষ্ট কলামাত্রিক দলমাত্রিক রীতির ভিত্তিতে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই ইংরেজি মতে এগুলি ফ্রি ভার্স।

কিন্তু ফরাসিদের যে ধারণাটি দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটিতে পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হয়, ব্যাপারে তাঁরা আরও বেশি মুক্তিকামী। কিন্তু ক্ষেত্রে একটি কথা মনে রাখতে হবে। উদ্ধৃতিতে যে মুক্তছন্দকে বোঝানো হয়েছে তাকে ফরাসিতে বলে vers libre ফরাসিতে আর-এক রকমের ছন্দ আছে তাকে বলে vers libere / সংক্ষেপে এই দুটি রীতির সংজ্ঞার্থ দিয়ে পার্থক্য সূচিত হতে পারে : verse libre verse which is bom free" Verse libere 'verse which has been liberated from some pre-existing chains কাজেই এই vers libere- হচ্ছে প্রচলিত ছন্দরীতিকে ভিত্তি করে মুক্তিপ্রাপ্ত গদ্যছন্দ। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের 'বলাকা' বা 'পলাতকা' ছন্দ ইংরেজি মতে free verse, ফরাসি মতে verse libere আর ers libre—উদ্ধৃতি থেকেই প্রমাণ হবে যে তার মধ্যে rhythmic sense-unit ছাড়া কোনো প্রচলিত ছন্দরীতির নামগন্ধ নেইপাওয়া যাবেলিপিকায়, ‘পুনশ্চে বেশির ভাগ কবিতায়, এবংশেষসপ্তক', 'পত্রপুট’-‘শ্যামলী'তে।

কাজেই ফরাসি ইংরেজের গদ্যছন্দ বিষয়ক মতামতগুলিকে সামগ্রিকভাবে বিচার করলে দেখা যায়, প্রচলিত ছন্দকে ভিত্তি করে বৈচিত্র্যসৃষ্টি যেমন ফ্রি ভার্স, তেমনি প্রচলিত ছন্দরীতির বাইরে স্পন্দনময় ধ্বনিযুক্ত sense-unit নির্ভর কাব্যও মুক্তছন্দের কাব্য বা ফ্রি ভার্স। ফরাসিতে যেমন vers libere vers libre-এর পার্থক্য মানা হয়, ইংরেজিতে তেমন মানা হয় না। ইংরেজিতে free verse বললে দুরকম মুক্তছন্দকেই বোঝানো হয়। এর কারণ আছে। ফরাসিতে ছন্দের বন্ধন ইংরেজির তুলনায় অনেক বেশি শ্রদ্ধেয় বলে মানা হত। তাই ফরাসিকাব্যে ছন্দের মুক্তির ইতিহাসে vers libre- পরিণতির আগের ধাপটিকে vers libere বলে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে ছন্দ- মুক্তি এত কঠিন বাধা ঠেলে আসেনি। কাজেই ইংরেজিতে vers libere-কে আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়নি।' Free verse এই কথাটি দিয়েই সমস্ত রকম ছন্দমুক্তিকে বোঝানো হয়ে থাকে। যাই হোক, ফ্রি ভার্সের লক্ষণের যা পরিচয় আমরা পেলাম তাতে রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা, ‘মানসী' নিষ্ফল কামনা' কবিতায় যার সূচনা, 'বলাকা' 'পলাতকা'য় যার বিস্তার 'লিপিকা', 'পুনশ্চ', ‘শেষ সপ্তক', 'পত্রপুট', 'শ্যামলী'তে যার বৈচিত্র্য এবং জীবনের একেবারে শেষ পর্বে প্রবহমান ছন্দের আশ্চর্য কবিতাগুলির মধ্যে যার সমাপ্তিতা সমস্তই ফ্রিভার্স।

ইয়োরোপ আমেরিকায় এই নতুন কাব্যবাহন বা ফ্রি ভার্স অনুভূতিকে বিচিত্রভাবে প্রকাশ করবার উপায় হিসাবেই গৃহীত হয়েছিল এবং প্রতীক আন্দোলনের সহায়ক হয়েছিল। ফ্রি ভার্স-রচনার এই নতুন প্রচেষ্টাকে সমর্থকগণ নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। এই সমর্থকদের মধ্যে প্রায় সকলের রচনার সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ অল্পবিস্তর পরিচিত ছিলেন গদ্যকাব্যের পক্ষে রবীন্দ্রনাথ যে-সব কৈফিয়ত দিয়েছেন তার সঙ্গে এই সমর্থকদের কৈফিয়তের অনেক সাদৃশ্যও আছে।

এই নতুন কাব্যপদ্ধতির অন্যতম সমর্থক গুস্তাভ্ কাহ এই ভঙ্গির মধ্যে নতুন সঙ্গীত জটিল ভাবনার অনুরণন শুনেছিলেন ('une musique plus complex) লাফোর্গ এই পদ্ধতিতে খুঁজে পেয়েছিলেন মনোগত অভিপ্রায়ের অন্তরঙ্গতম প্রকাশের উপায়। মালার্মে কবিতার পোশাকী গাম্ভীর্য ছেড়ে কবিতাকে অন্তরঙ্গ ব্যক্তিগত করবার পথ দেখতে পেয়েছিলেন। এর কিছু আগে ভোলেন একেবারে নিরেট গদ্যকবিতা (vers libre) পছন্দ করতে না পারওে প্রচলিত ছন্দভিত্তিক মুক্তকের (vers libere') মধ্য দিয়ে ছন্দ-ধ্বনিকে যথাসম্ভব ক্ষীণ, সংকুচিত বা দূরান্তরিত করবার চেষ্টায় ছিলেন। ইংল্যাণ্ডেল ইয়েটসের প্রবন্ধগুলিতে ভোলেনের কথায় প্রতিধ্বনিরূপে শোনা গিয়েছিল 'faint, fluid, and tenu- ous kind of verse rhythm এর সমর্থনের কথা, কাহনের নতুন-সঙ্গীতধ্বনি' কথা। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে লেখা টি. . হিউমের আধুনিক কবিতা সম্পর্কিত এক রচনায় দেখা যায় কাহনের বক্তব্যেরই অনুসরণ। হিউমের নিজস্ব ব্যাখ্যায় নতুন ভঙ্গিকে গভীরতর মনোবিশ্লেষণের প্রতিফলন ব্যক্তিগত অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত অধিকতর সুযোগ রূপে

দেখানো হয়। অনেকটা মার্গামের কথারই প্রতিধ্বনি করে হিউম বলেন যে, প্রচলিত নীতির কবিতার স্থায়িত্ব, চিরকালীন সত্য সৌন্দর্যের প্রতি কবিদের প্যাশান দেখা যায়, কিন্তু কি ভাগে চলতি জীবনের চাঞ্চল্য দেখতে পাওয়া যায়, উপরন্ত ব্যক্তিচিহ্নিত অন্তরঙ্গতার অনুভূতি প্রকাশ করবার একটা নিরন্তর প্রচেষ্টাও থাকে। এই ধরনের অন্তরঙ্গ কবিতাকে প্যাটার্নের মধ্যে বাঁধার চেষ্টা ছোট শিশুকে লোহার ফ্রেমে আঁটার মতোই। এজরা পাউণ্ডের গদ্য-কবিতার সমর্থনের মধ্যেও লাফোর্গ মালার্মের কথার প্রতিষ্ঠা শুনতে পাওয়া যায়। ডি. এইচ. লরেন্স অন্যভাবে বললেও গদ্যকবিতা যে অনুভূতির প্রত্যক্ষ স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশএই সিদ্ধান্তেই এসেছেন গদ্যকবিতার সমর্থকদের এই কৈফিয়ৎগুলির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা রচনার কৈফিয়ৎগুলির মিল বিশেষভাবেই আছে। কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়ে এই সাদৃশ্য দেখানো যেতে পারে। কবি এক জায়গায় লিখছেন"

"কারকে বেড়াভাঙা গদ্যের ক্ষেত্রে স্ত্রীস্বাধীনতা দেওয়া সাহিত্যসংসারের আলেকারিক অংশটা হালকা হয়ে তার বৈচিত্রের দিকে অনেকটা খোলা জায়গা পায়। কাব্য জোরে পা ফেলে চলতে পারে। সেটা সহরে নেচে চলার চেয়ে সব সময় যে নিন্দনীয় তা নয়। নাচের আসরের বাইরে আছে উঁ মনোহর, সেখানে জোরে চলাটাই মানায় ভালো কখনো ঘাসের উপর, কখনো কারের উপর দিয়ে।'

এই উক্তির মধ্যে কবি যে অভিপ্রায়ের কথা বলেছে - কবিতার সমর্থকদের কথিত 'নতুন সংগীত' ওই চিঠিতেই অন্যত্র কবি লিখছেন 'যে সংসারটা প্রতিদিনের, অথচ সেই প্রতিদিনকেই লক্ষ্মীরী চিরদিনের করে তুলেছে, যাকে চিরস্তনের পরিচয় দেবার জন্যে বিশেষ বৈঠকখানায় অলংকৃত আয়োজন করতে হয় না, তাকে কাব্য-শ্রেণীতেই গণ্য করি। অথচ চেহারায় সে গদ্যের মতো হতেও পারে। তার মধ্যে বেসুর আছে, প্রতিবাদ আছে, নানাপ্রকার বিমিশ্রতা আছে, সেই জন্যই চারিত্রশক্তি এই উক্তির মধ্যেও মালার্মে হিউমের চলতি জীবনের চাঞ্চল্যকে প্রকাশ করবার যে অভিপ্রায় তাই প্রকাশ পেয়েছে। ওই চিঠির আর-এক জায়গায় কবি বলছেন :

সপ্তপদীর বা চতুর্দশপদীর পদক্ষেপটা প্রতিদিন মানায় না। তাই বলেই প্রাত্যহিক পদক্ষেপটা অস্থানে পড়ে বিপদজনক হবেই এমন আশঙ্কা করি নে। এমনকি বাম দিক থেকে রুনুঝুনু মলের আওয়াজ গোলমালের মধ্যেও কানে আসে। তবু মোটের উপর বেশভূষাটা হল আটপৌরে। অনুষ্ঠানের বাঁধারীতি থেকে ছাড়া পেয়ে একটা সুবিধে হল এই যে, উভয়ের মিলনের মধ্যে দিয়ে সংসারযাত্রার বৈচিত্র্য সহজ রূপ নিয়ে স্কুল সূক্ষ্ম নানাভাবে দেখা দিতে লাগলো।'

এই উক্তির মধ্যে প্রাত্যহিকর্তা, ছন্দের ক্ষীণ, দূরশ্রুত আভাস ("বাম দিক থেকে রুনুঝুনু .) প্রকাশের ভাষায় আটপৌরে সহজ রূপ (spontaneity) ব্যক্তিগত মনোভাব প্রকাশের নানা বৈচিত্র্য (স্থূল সূক্ষ্ম নানাভাবে) - গদ্যকাব্য-সমর্থকদের উক্তির মধ্যেকার সব কটি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।`

'পুনশ্চ কাব্যের ভূমিকায় কবি বলেছেন :

গীতাঞ্জলির গানগুলি ইংরেজি গদ্যে অনুবাদ করেছিলাম। এই অনুবাদ কাব্যশ্রেণীতে গণ্য হয়েছে। সেই অবধি আমার মনে এই প্রশ্ন ছিল যে, পদ্যছন্দের সুস্পষ্ট ঝংকার না রেখে ইংরেজি গদ্য কবিতার মতোই বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কি না....

এই উক্তির মধ্যে 'a slighter and more hesitant rhythm:- ভোলেনের এই অন্বিষ্ট সত্যেরই আভাস পাওয়া যায়। কাজেই কোনো সন্দেহ নেই, গদ্যকাব্যের কবিদের তাদের কৈফিয়ৎগুলি তাকে প্রেরণা দিয়েছে, হয়তো প্রভাবিতও করেছে। ওয়াল্ট হুইটম্যান, এলিয়ট, এজরা পাউণ্ড, এমি লাওয়েল, এডুইন আর্লিংটন রবিনসন, অরিক জোনস ইত্যাদির গদ্যকবিতার তিনি অনুবাদ করেছেন। আর্থার ওয়েলি- চীনা কবিতাসংকলন গদ্যকাব্য সম্পর্কে তাকে নিঃসংশয় করেছে। ছাড়া বাইবেলের অনুবাদ, তার মধ্যেকার সলোমানের গান ডেভিডের পাখার কাব্যরসের কথা তিনি বলেছেন, এবং আমাদের দেশের উপনিষদ-সাহিত্যের গদ্যকাব্যরস সংস্কৃত গদ্যকাব্যও যে ব্যাপারে আদর্শ হতে পারে কথাও জানিয়েছেন। সমসাময়িক ইংরেজি কাব্য-সাহিত্যে ছন্দ পরীক্ষা বা ছন্দে স্বাধীনতা গ্রহণ করবার যে চেষ্টা সর্বক্ষণ চলেছে তার সম্বন্ধে কবি যে ওয়াকিবহাল থাকতেন তার প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে তার একটি চিঠি উদ্ধার করে। সে চিঠিতে তিনি লিখেছেন” :

ইদানীং দেখছি, গণ্য আর রাস মানছে না, অনেক সময় দেখি তার পিঠের উপর সেই সওয়ারটিই নেই যার জন্যে তার খাতির। ছন্দের বাঁধা সীমা যেখানে লুপ্ত সেখানা সংগত সীমা যে কোথায় সে তো আইনের দোহাই দিয়ে বোঝাবার জো নেই। মনে মনে ঠিক করে রেখেছি, স্বাধীনতার ভিতর দিয়েই বাঁধন ছাড়ার বিধান আপনি গড়ে উঠবে—–এর মধ্যে আমার অভিরুচিকে আমি প্রাধান্য দিতে চাই নে। নানারকম পরীক্ষার ভিতর দিয়ে অভিজ্ঞতা গড়ে উঠছে। সমস্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে একটা আদর্শ ক্রমে দাঁড়িয়ে যাবে। আধুনিক ইংরেজি কাব্যসাহিত্যে এই পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে।

গদ্যকবিতার উদ্দেশ্যগুলিকে স্পষ্ট করতে গিয়ে কবি একটি কথা বলেছেন যা উল্লিখিত গদ্যকাব্যের সমর্থকদের উক্তির মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য গুস্তাভ্ কাহন-এর 'নতুন সংগীত' কথাটিকে একটু বৃহত্তর অর্থে নিলে কবির সে কথাটিকেও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। সে হল 'পদ্যের বিশেষ ভাষারীতি' ত্যাগ করে প্রকাশের মধ্যে একটাবলিষ্ঠতা', 'দূরন্তপনা' 'পৌরুষ' আনবার চেষ্টা। কবি টবের কবিতা'কে রোপণ করতে চেয়েছিলেন মাটিতে। 'আভিজাত্যের সুশাসন' ভেঙে দূরত্ত নাচের জায়গা 'রে নিতে চেয়েছিলেন। ('শেষ সপ্তক', পঁচিশ নম্বর কবিতা) কবিতার কোমল-বনিতার রূপকে অগ্রাহ্য করে তাকে বীরাঙ্গনা রূপে সাজাতে চেয়েছিলেন। একটি চিঠিতে তিনি বলছেন :

গদ্যের প্রতি পদ্যের সম্মান রক্ষা করে চলা উচিত। পুরুষকে সুন্দরী রমণীর মতো ব্যবহার করলে তার মর্যাদাহানি হয়। পুরুষেরও সৌন্দর্য আছে, সে মেয়েদের সৌন্দর্য নয়এই সহজ কথাটা বলবার প্রয়াস পেয়েছি পরবর্তী কবিতাগুলিতে।*

অন্য আরেকটি চিঠিতে লিখছেন :

বক্ষ্যমাণ কাব্যে গদ্যটি মাংসপেশল পুরুষ বলেই কিছু প্রাধান্য যদি নিয়ে থাকে তবু তার কলাবতী বধু দরজার আধখোলা অবকাশ দিয়ে উকি মারছে, তার সেই ছায়াবৃত কটাক্ষসহযোগে সমস্ত দৃশ্যটি রসিকদের উপভোগ্য হবে বলেই ভরসা করেছিলুম।' কতকগুলি কবিতার এই বলিষ্ঠতা, মাংসপেশী-বহুলতা সত্যই লক্ষণীয়। তুলনার জন্য একই বর্ণনীয় বিষয়ের ওপর দুটি কবিতার উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি 'কল্পনা' কাব্যের বহু পরিচিত 'বর্ষশেষ' কবিতা, অপরটিপত্রপুটে -সংখ্যক কবিতা। ছন্দবদ্ধ কবিতাবর্ষশেষে রূঢ় রূপান্তর হল পত্রপুটের গদ্য-কবিতাটি। এই দুটি কবিতার মধ্যেকার প্রস্ফুটিত ছবিদুটির তুলনা করলে বোঝা যাবে, প্রথম কবিতাটির তুলনায় দ্বিতীয় কবিতাটিতে 'সংগীতের রসকে পুরুষের স্পর্শে ফেনায়িত উগ্রতা দেওয়া হয়েছে। এই পৌরুষের কথা বলতে গিয়ে কবি লিখছেন : '...গদ্যকে কাব্য হতে হবে। গদ্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কাব্য পর্যন্ত পৌঁছল না, এটা শোচনীয়। দেবসেনাপতি কার্তিকেয় যদি কেবল স্বর্গীয় পালোয়ানের আদর্শ হতেন তা হলে শুম্ভনিশুম্ভের চেয়ে উপরে উঠতে পারতেন না- বাংলাদেশের ময়ূরে-চড়া কার্তিকটিকে সম্পূর্ণ ভালবার চেষ্টা করো)অর্থাৎ লক্ষ্যভ্রষ্ট গদ্য কবির কাছে পালোয়ানরূপী কার্তি অথবা ময়ূরে-চড়া কার্তিক।

প্রকৃতপক্ষে গদ্যকাব্যের শক্তির প্রতীক হল 'বর্ষশেষ' কবিতার সেই কুমার— 'সদ্যোজাত মহাবীরযিনি হাস্যমুখে ধনুকে টান দিয়ে সুতীব্র ঝংকার তোলেন। কবির কথায়তাঁর 'পৌরুষ' যখন 'কমনীয়তা' সঙ্গে মিশ্রিত হয় তখনই তিনি দেবসাহিত্যে গদ্যকাব্যের সিংহাসনের উপযুক্ত হন।””

·        ছন্দেগুরু রবীন্দ্রনাথ : প্রবোধচন্দ্র সেন। পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য।

·        সাহিত্যচর্চা : বুদ্ধদেব বসু : ১৩৬১। 'বাঙলাছন্দ' প্রবন্ধ : পৃ. ১৩২- দ্রষ্টব্য।

·        Image and Experience : Graham Hough : 1960 এই বই-এর Free Verse প্রবন্ধ : পৃ. ৮৬ দ্রষ্টব্য।

·        Collected Essays, Papers of Robert Bridges : Oxford University Press 1930 7.821

·        Image and Experience : পৃ. ৮৭ এবং Collected Essays, Papers of Robert Bridges : ৪১-৪২ দ্রষ্টব্য।

·        এই প্রসঙ্গে বর্তমান লেখকের 'বাঙলা ছন্দের ক্রমবিকাশ', মহাজাতি প্রকাশক, ১৯৬২, পৃ. ৬৫-৬৭ দ্রষ্টব্য।

·        এই প্রসঙ্গে Graham Hough-এর Free Verse প্রবন্ধটির পৃ. ৮৭-৮৮ দ্রষ্টব্য।

·        ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আযৌবন পরিচিত। পরবর্তীকালে বহু আধুনিক কবির সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছেন তাঁদের কাব্যের মাধ্যমে যা ব্যক্তিগতভাবে। বহু আধুনিক কবিতার সংকলন তাঁর নিজস্ব সংগ্রহে ছিল। তার কিছু এখন বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারে আছে। সম্পর্কে পৃথক আলোচনা হতে পারে। [ এই প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে লেখা (১৯৭০) 'হুইটম্যান রবীন্দ্রনাথ' প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য। লেখক। ]

·        'পুনশ্চ' কাব্যের 'নাটক' কবিতার শেষাংশ স্মরণীয়।

·        লরেন্স New Poems (New York, 1920) এর ভূমিকায় এক জায়গায় বলেছেন : in free verse we look for the insurgent naked throb of instant moment.' Selected Literary Criticism, 1955, Page. 88.

·        ধূর্জটিপ্রসাদকে লেখা চিঠি। দেওয়ালি ১৩৩৯। রবীন্দ্র-রচনাবলী, একবিংশ খণ্ড, ১৩৫৬।

·        New Poems এর ভূমিকায় লরেন্স যে সব কথা বলেছেন তার অনেক কিছুর সঙ্গেই

·        রবীন্দ্রনাথের উক্তিগুলি মেলে। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন 'প্রাত্যহিকতা', তাকেই লরেন্স বলেছেন : 'The pure present' বা 'the instant" রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন সহজ রূপ লরেন্স তাকে বলেছেন : 'Spontaneous and flexible as a flame' রবীন্দ্রনাথ যেখানে বলেছেন : 'স্থুল সূক্ষ্ম নানাভাবে' লরেন্স বলেছেন সেখানে : 'That utterance rushes out without artificial from or artificial smoothness' i

·        শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষকে লেখা চিঠি। ২৮ আশ্বিন ১৩৪৩। রবীন্দ্র-রচনাবলী একবিংশ খণ্ড,

·        ধুর্জটিপ্রসাদকে লেখা চিঠি। ২৬ আশ্বিন ১৩৩৯। রবীন্দ্র-রচনাবলী, একবিংশ খণ্ড, ১৩৫৩। পৃ. ৪৪৮।

·        ধূর্জটিপ্রসাদকে লেখা চিঠি। দেওয়ালি ১০০৯। রবীন্দ্র-রচনাবলী, একবিংশ খণ্ড, ১৩৫৩। পৃ. 8201

·        'বর্ষশেষ' কবিতার প্রথম দুটি স্তবকের আংশিক উদ্ধৃতি দিচ্ছি : ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে ধেরে চলে আসে বাধাবন্ধনহারা গ্রামাস্তের বেণুকুঞ্জে নীলাঞ্জনছায়া সঞ্চারিয়া- হানি দীর্ঘধারা ...

ধূসর পাংশুল মাঠ, ধেনুগণ ধায় উর্ধ্বমুখে,

ছুটে চলে চাষি-

ত্বরিতে নামায় পাল নদীপথে ত্রস্ত তরী যত তীরপ্রান্তে আসি।

পশ্চিমে বিচ্ছিন্ন মেঘে সায়াহ্নের পিঙ্গল আভাস রাঙাইছে আঁখি

বিদ্যু-বিদীর্ণ শূন্যে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলে যায় উৎকণ্ঠিত পাখি।।

·        পত্রপুটের -সংখ্যক কবিতা থেকে তুলনার জন্য উদ্ধার করছি :

হেঁকে উঠলো ঝড়,

লাগল প্রচণ্ড তাড়া,

সূর্যাস্তসীমার রঙিন পাঁচিল ডিঙিয়ে

ব্যস্ত বেগে বেরিয়ে পড়ল মেঘের ভিড়,

বুঝি ইন্দ্রলোকের আগুন লাগা হাতিশালা থেকে

গাঁ গাঁ শব্দে ছুটছে ঐরাবতের কালো কালো শাবক শুঁড় আছড়িয়ে।

মেঘের গায়ে গায়ে পা দা করছে লাল আলো,

তার ছিন্নত্বকের রক্তলেখা। ইত্যাদি

·        ধূর্জটিপ্রসাদকে লেখা চিঠি। ১৭ মে ১৯৩৫। রবীন্দ্র-রচনাবলী, একবিংশ খণ্ড,১৩৫৪। ১৮. ‘বর্ষশেষ' কবিতায় আছে :

সদ্যোজাত মহাবীর, কী এনেছ করিয়া বহন'

অন্যত্র আছে : 'হে কুমার, হাস্যমুখে তোমার ধনুকে দাও টান।

 

0 Reviews