বিধি-বন্দি রাবণ

বিধি-বন্দি রাবণ

Size

Read more

 

বিধি-বন্দি রাবণ






বিধি-বন্দি রাবণ

মাইকেল মধুসুদন যখন মেঘনাদবধকাব্যের প্রথম সর্গটি লিখে ফেলেছেন তখন বন্ধু রাজনারায়ণকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন যে তাঁর খুবই ইচ্ছে হয়, গ্রিক পুরাণের অসাধারণ সৌন্দর্যময় অংশগুলিকে আমাদেরই পৌরাণিক কাহিনীর জগতে নিয়ে এসে দৃঢ় গভীরভাবে রোপণ করেন। আপাতত, মেঘনাদবধকাব্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তিকে নিজের খুশিমতো প্রয়োগ করতে তাঁর খুবই ইচ্ছে জাগছে, এবং বাল্মীকির কাছ থেকে যথাসম্ভব কম ঋণ করাই তাঁর পক্ষে ভালো বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তার পরেই বন্ধুকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে, এতে চমকে যাবার মতো কিছু নেই। মহাকাব্যের অহিন্দু চরিত্র নিয়ে অভিযোগ করতে হবে না বন্ধুকে। কারণ গ্রিক কাহিনী থেকে সরাসরি ধার করবেন না তিনি, তবে চেষ্টা করবেন, একজন গ্রিক যেমন করে লিখতেন সেইভাবে লিখতে।

একথা ঠিকই যে, বেশ কিছু গ্রিক দেবদেবী থেকে শুরু করে গ্রিক সাহিত্যের অখণ্ড সৌন্দর্যদৃষ্টি, পূর্ব সংস্কার-মুক্তি, মানবিক রসবোধ, ভারসাম্যময় ঋজুদৃষ্টি, এমনকী, কিছু গ্রিক বীরত্ব-পদ্ধতি সামাজিক সংস্কারকে পর্যন্ত মাইকেল মেঘনাদবধকাব্যের কাহিনীর হিন্দুসংস্কারের সঙ্গে চমৎকারভাবে মিশিয়ে নিতে পেরেছেন। এই মিশ্রণের সূত্রে তিনি ভাষারীতি, শব্দ শব্দবিন্যাস, ছন্দ, অলঙ্কার এবং বিষয়বস্তুকেও কতখানি যত্নের সঙ্গে দেশীয় করতে চেয়েছেন তার প্রমাণ তাঁর চিঠিপত্রে যথেষ্ট আছে।

কিন্তু উনিশ শতকের দুটি সংস্কৃতির সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মানবিক বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে রামায়ণ কাহিনীর আভ্যন্তরীণ মূল্যবোধের যে পরিবর্তন মাইকেল ঘটাতে চেয়েছিলেন তার মল কথাটি হলো, রাম এবং তাঁর বানরসৈন্যবাহিনীকে গৌণ কতরে রাবণের মহাত্ম্যকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া, যেহেতু রাবণের চরিত্র তাঁর মনকে উন্নত করেছে। এই নতুন মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতেই মেঘনাদবধের রাম রাবণএই দুটি পরস্পর-বিপরীত পক্ষকে মাইকেল নতুন 'রে বিন্যাস করার চেষ্টা করেছেন।

এই বিন্যাসের ক্ষেত্রে অসাধারণ দক্ষতায় গ্রিক দৈবের অমোঘ নিয়মকে মেনে মাইকেল রাবণ মেঘনাদের আত্মবিশ্বাস ব্যক্তিগত দক্ষতা দেখিয়েছেন গ্রিকদের হিরোয়িক কোড বা বীরত্ববিধি অনুযায়ী। অথচ আমাদের দেশীয় সংস্কারে সমকালীন মানবিকবোধে সেই দৈববন্দি মানুষের অহঙ্কারী বীরত্ব প্রকাশ মোটেই বিসদৃশ বলে ঠেকেনি। অন্তত সমকালীন কোনো সমালোচক এই রাম-রাবণের নতুন বিন্যাসকে তেমন তীব্রভাবে ধিক্কার দেননি।

কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে মনে হয়, যে দৈবকে বিরূপ দেখে মেঘনাদবধকাব্যের রাবণ শত্রুপক্ষ বিনাসে উদ্যোগী হয়েছেন, তা পূর্বনির্দিষ্ট দৈব বা বিধি অথবা রাবণের নিজেরই কর্মফল কি না, ব্যাপারে কবির একটু দ্বিধা ছিল এবং সেই দ্বিধার ফলেই রাবণ- মেঘনাদের সর্বনাশের ব্যাপারে মূল কারণ ব্যাখ্যায় তিনি পূর্বাপর সঙ্গতি রাখেননি। এই সঙ্গতি না থাকার ফলে বিধির কাছে রাবণ তাঁর পাপের মূল কারণ-সূচক যে প্রশ্নগুলি সমগ্র কাব্যব্যাপী বারবার করে গেছেন তার নৈতিক ভিত্তি কতখানি, সে সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়। প্রথম সর্গে বীরবাহুর পতনের পর গভীরভাবে আহত রাবণ বিলাপ করতে গিয়ে বলেছিলেন, “কি পাপ দেখিয়া মোর, রে দারুণ বিধি, / হরিলি ধন তুই'? আসন্ন বিপদের কথা ভেবে তিনি বলেছিলেন ; ‘বনের মাঝারে যথা সাখা দলে আগে / একে একে কাঠুরিয়া কাটি, অবশেষে / নাশে বৃক্ষে, হে বিধাতঃ দুরন্ত রিপু / তেমনি দুর্বল, দেখ, করিছে আমারে / নিরন্তর! হব আমি নির্মূল সমূলে / এর শরে!' এবং শাখাহীন- বৃক্ষ-রূপ রাবণ এবার 'কাঠুরিয়া শেষ মর্মান্তিক ঘা খাবেন এই আশঙ্কাতেই বোধ হয় নিজের পাপের স্বীকারোক্তি করে বলেছিলেন, 'হায় সূর্পনখা, / কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই রে অভাগী, / কাল পঞ্চবটীবনে কালকূটে ভরা / ভূজঙ্গে? কি কুক্ষণে (তোর দুঃখে দুঃখী) / পাবক শিখারূপিণী জানকীরে আমি / আনিনু হৈম গেহে? হায়, ইচ্ছা করে, / ছাড়িয়া কনক লঙ্কা, নিবিড় কাননে / পশি, মনের জ্বালা জুড়াই বিরলে!' এই উচ্চারণের মধ্যে রাবণের নিজকর্ম-দোষের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি ছিল, সর্বনাশের কারণটিকে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিলেন, এবং মনের জ্বালায় তিনি যে নৈতিক দিক থেকে ভীষণভাবে বিক্ষুব্ধ তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বীরবাহুর মৃত্যুতে চিত্রাঙ্গদা যখন শোকে- অভিমানে বিলাপ করেছেন রাবণের কাছে এসে, তখন রাবণ কিন্তু নিজের পাপকর্মের কথা একবারও উচ্চারণ করেননি। কেবল বলেছেন, ‘গ্রহদোষে দোষী জনে কে নিন্দে, সুন্দরী ? / হায় বিধি বশে, দেবি, সহি যাতনা / আমি!' শুধু এই কথা নয়, নিজের পাপকর্মের কথা অনুচ্চারিত রেখে পুত্র-পরাক্রমে যে বংশগৌরবই বেড়েছে চিত্রাঙ্গদাকে তা- বোঝাতে গেছেন। ফলে চিত্রাঙ্গদার মুখ থেকেই কঠিন কথাটি শুনতে হয়েছে রাবণকে : ‘কে, কহ, কাল-অগ্নি জ্বালিয়েছে আজি / লঙ্কাপুরে? হায় নাথ, নিজ কর্মফলে, / মজালে রাক্ষসকুলে, মজিলা আপনি!'

কিন্তু প্রথম সর্গে রাবণ ওই একবারই নিজের পাপকর্মের কথা বলেছেন এবং তার মর্মজ্বালায় জ্বলছেন বলে বনবাসী হতে চেয়েছেন। পরে মেঘনাদের সৎকার পর্যন্ত আর কখনোই তিনি নিজের কর্মদোষের কথা স্বীকার করেননি। সপ্তম সর্গে মেঘনাদের মৃত্যুর পর যখন তিনি যুদ্ধে যাচ্ছেন তখন পুত্রশোকে কাতর মন্দোদরী এসে রাবণের চরণে পড়লে রাবণ বলেছেন : 'বাম এবে রক্ষঃ-কুলেন্দ্রানি, / আমা দোঁহা প্রতি বিধি! তবে যে বাঁচিছি / এখনও, সে কেবল প্রতিবিধিৎসিতে / মৃত্যু তার!' রাক্ষসদের সামনেও বলেছেন, “কিন্তু দেবনরে পরাভবি, কীর্তিবৃক্ষ রোপিনু জগতে / বৃথা! নিদারুণ বিধি, এতদিনে এবে / বামতম মোর প্রতি ; তেঁই শুখাইল / জলপূর্ণ আলবাল অকাল নিদাঘে।' নবম সর্গে লক্ষ্মণ যখন নতুন প্রাণ পেলেন তখনও রাবণ বলেছিলেন, 'বিধির বিধি কে পারে খণ্ডাতে?” এবং মেঘনাদের চিতার সামনে রাবণ যে অন্তিম শোক প্রকাশ করেছেন তাতে বলেছেন, তাঁর আশা ছিল মেঘনাদের সামনেই তাঁর মৃত্যু হবে। মেঘনাদকে রাজ্যভার সমর্পণ 'রে তিনি মহাযাত্রা করবেন। কিন্তু বিধিবুঝিব কেমনে / তাঁর লীলা? ভাড়াইলা সে সুখ আমারে!' চতুর্থ সর্গে সীতার স্বপ্নের মধ্যে রাবণের মুখেও বিধির বিরূপতার কথাই শোনা গেছে। এবং প্রমীলাকে মেঘনাদের চিতায় আরোহণ করতে দেখে একটু নতুন কথা বলেছেন তিনি। সে হলো 'পূর্বজন্মফল'—নিছক বিধি নয়, নিজ কর্মদোষও নয়। সুতরাং রাবণের উক্তি থেকেই আমরা মেঘনাদ-রাবণের সর্বনাশের তিন রকম কারণ পাচ্ছি : কখনো নিজ কর্মদোষ, কখনো বিধি, কখনো পূর্বজন্মফল।

এখন মেঘনাদবধকাব্যের অন্যান্য চরিত্র রাবণের সর্বনাশের কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা দেখা যাক। দ্বিতীয় সর্গে দেখি, চন্দ্রদেব যখন শচীর সঙ্গে বসে আছেন তখন লক্ষ্মী এসে ইন্দ্রকে বললেন, রাবণের ভক্তিতে সেবাযত্নে তিনি বহুকাল স্বর্ণলঙ্কায় অবস্থান করছেন কিন্তুহায়, এতদিনে / বাম তার প্রতি বিধি। নিজকর্মদোষে, / মজিছে সংবশে পাপী ; তবুও তাহারে / না পারি ছাড়িতে, দেব! বন্দী যে, দেবেন্দ্র, / কারাগার-দ্বার নাহি খুলিলে কি কভু / পারে সে বাহির হতে?' কাজেই লক্ষ্মীর দৃষ্টিতে রাবণের নিজকর্মদোষে বিধি বাম হয়েছে। অবশ্য রাবণের ওপর তাঁর কর্মদোষের শাস্তি চাপাতে বিধিকে 'বাম' করবার জন্যে তিনিই নিজে এগিয়ে গেছেন প্রথম। ষষ্ঠ সর্গেও মায়াদেবীকে লক্ষ্মী রাবণের কর্মদোষের কথাই বলেছেন। ইন্দ্র গিয়ে উমাকে বলেছেন, 'পরম-অধর্মাচারী নিশাচর-পতি- দেবদ্রোহী! আপনি, হে নগেন্দ্রনন্দিনী, / দেখ বিবেচনা করি। দরিদ্রের ধন / হরে যে দুর্মতি, তব কৃপা তার প্রতি / কভু কি উচিত মাতঃ?' এখানে ইন্দ্রকেও দেখছি রাবণের পাপকর্মকেই ধিক্কার দিয়ে উমাকে রাবণের প্রতি কৃপা করতে বারণ করছেন। ইন্দ্রপত্নী শচীও বলছেন, ‘আপনি না দিলে দণ্ড, কে দণ্ডিবে দেবি, / পাষণ্ড রক্ষোনাথে?” শেষ পর্যন্ত সকলেরই সমবেত চেষ্টায় মহেশ্বর বললেন, 'পরমভকত মম নিকষানন্দন ; / কিন্তু নিজকর্মফলে মজে দুষ্টমতি। / বিদরে হৃদয় মম স্মরিলে সে কথা, / মহেশ্বরি! হায়, দেবি, দেবে কি মানবে ; / কোথা হেন সাধ্য রোধে প্রাক্তনের গতি! কাজেই দেখতে পাচ্ছি, লক্ষ্মী থেকে শুরু করে ইন্দ্র শচী উমা মহেশ্বর পর্যন্ত সকলেই বিধি বা প্রাক্তনের অন্তর্গত হয়েই বলেছেন, বিধি বাম এবং প্রাক্তনের গতিরোধ করার সাধ্য কারো নেই, কারণ, রাবণ নিজের কর্মফলেই তার সর্বনাশ আনছেন! যাই হোক, দেব-দেবী সকলেই কর্মফলের জন্যেই রুষ্ট হয়ে প্রাক্তনের অবধারিত গতিকে জানিয়ে দিচ্ছেন। অর্থাৎ দেব-দেবীর দৃষ্টিতে নিছক বিধি নয়, কর্মফলই বিরূপ বিধি হয়ে আসছে।

অন্যদিকে তৃতীয় সর্গে লক্ষ্মণ যখন মেঘনাদের সঙ্গে যুদ্ধে যাচ্ছেন তখন জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্রকে তিনি অভয় দিয়ে বলেছেন : 'অধর্ম কোথা কবে জয়লাভে? / অধর্ম-আচারী এই রক্ষঃ-কুলপতি ; / তার পাপে হতবল হবে রণ-ভূমে / মেঘনাদ ; মরে পুত্র জনকের পাপে।' এবং বিভীষণও লক্ষ্মণের কথাই সমর্থন করে বলেছেন, 'নিজ পাপে মজে, হায়, রক্ষঃ-কুলপতি!' এখানেও রাবণের কর্মদোষ বা পাপকর্মকেই দায়ী করা হয়েছে। জটায়ুও চতুর্থ সর্গে (সীতার পূর্বস্মৃতি রোমন্থনের মধ্যে) মৃত্যুর সময় রাবণকে বলে গেছেন : 'কে তোরে রক্ষিবে, রক্ষঃ? পড়িলি সঙ্কটে / লঙ্কানাথ, করি চুরি নারী রতনে?' ষষ্ঠ-সর্গে বিভীষণ মেঘনাদকে আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন, 'পরদোষে কে চাহে মজিতে?' -সমস্ত কথাই প্রমাণ করে রাবণ নিজকর্মদোষে তাঁর সর্বনাশকে ডেকে এনেছেন।

কিন্তু দেব-দেবী বা সাধারণভাবে মানব-মানবীর চোখে যদিও রাবণের সর্বনাশ রাবণেরই ডেকে-আনা, নিজের ভাগ্য তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন, তবু অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে রাবণের এই অন্যায়কেওপূর্বজন্মফল' বাপূর্বনির্দিষ্ট বিধি' বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ, রাবণের এই পাপও যেন আগে থেকেই বিধি-নির্দিষ্ট ছিল। অর্থৎ গ্রিক দৈব্যের মতোই এই অন্যায়েরও পূর্ব-নির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল যাকে ভারতীয় দৃষ্টিতে পূর্বজন্মের কর্মফল বলে ব্যাখ্যা করে আমরা সান্ত্বনা পাই। কর্মদোষে যে ভাগ্য বিরূপ হয় তার একটা কার্য-কারণ সম্পর্ক থাকে, কিন্তু কর্মদোষও যদি আগে থেকেই নির্দিষ্ট থাকে তাহলে মানুষের সমস্ত কর্মপন্থার ওপর আয়ত্তের অতীত এক শক্তির কথা ধরে নিতে হয়, যার হাতে মানুষ একেবারেই অসহায়। এইরকম অসহায় শক্তির হাতে রাবণ যে ক্রীড়নক তার প্রথম ইঙ্গিত পাই চতুর্থ সর্গে সীতার স্বপ্নদর্শনে বসুন্ধরার উক্তিতে : 'বিধির ইচ্ছায়, বাছা, হয়েছে গো তোরে / রক্ষোরাজ : তোর হেতু সবংশে মজিবে / অধম! ভার আমি সহিতে না পারি / ধরিনু গো গর্ভে তোরে লঙ্কা বিনাশিতে। / যে কুক্ষণে তোরে তনু ভূঁইল দুর্মতি / রাবণ, জানিনু আমি সুপ্রসন্ন বিধি / এতদিনে মোর প্রতি ; আশীযিনু তোরে।' বসুন্ধরার এই উক্তি থেকে মনে হয়, রাবণের সীতাহরণ যেন বিধির পূর্বনির্দিষ্ট বিধান। বিধানের কাছে রাবণ যেন অসহায়। এই চতুর্থ সর্গেই আরেকবার পূর্বনির্দিষ্ট বিধানেই যে সীতাহরণ হয়েছে এমন ইঙ্গিত রয়েছে সরমার উক্তিতে। বসুন্ধরার উক্তিকে সমর্থন করেই সরমা বলেছেন : 'কিন্তু সত্য যা কহিলা / বসুধা। বিধির ইচ্ছা, তেই লঙ্কাপতি / আনিয়াছে হরি তোমা : সবংশে মরিবে দুষ্টমতি।' প্রথম সর্গে রাবণ যে বলেছিলেন, 'কি কুক্ষণে পাবকশিখারূপিনী জানকীরে আমি আনিনু হৈমগেহে' – সেই 'কুক্ষণ' শব্দটির মধ্যেও হয়তো পূর্বনির্দিষ্ট বিধানের ইঙ্গিত থাকতে পারে। নবম সর্গে রাবণ যে দূতকে পাঠিয়েছেন রামের কাছে মেঘনাদের সৎকারের জন্য সময় চেয়ে, সেই দূতের মুখেও এই পূর্বনির্দিষ্ট বিধানের ইঙ্গিত আছে। অনেক মিনতি করে সে বলেছে : 'কুক্ষণে ভেটিলে দোঁহা দোঁহে রিপুভাবে। / বিধির নির্বন্ধ কিন্তু কে পারে খণ্ডাতে?' / যে বিধি, হে মহাবাহু, সৃজিলা পবনে / সিন্ধু- অরি ; মৃগ-ইন্দ্রে রিপু ; / খগেন্দ্র নাগেন্দ্র বৈরী ; তার মায়াছলে / রাঘব রাবণ-অরি- দোষিব কাহারে?' অর্থাৎ যে মৌলিক বা প্রাকৃতিক কারণে জড় জীবজগতে শাশ্বত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি, সেই শাশ্বত দ্বন্দ্বেরই একটি রূপ রাম-রাবণের শত্রুতা। লক্ষণীয় যে, রাবণ যেমন নিজের পাপকর্মের কথা খুবই কম বলেছেন, পূর্বজন্মের কর্মফলের কথাও বোধ হয় একবারেই বলেছেন, এবং অধিকাংশ সময়েই বিরূপ ভাগ্যের কথা বলে গেছেন, তেমনি অন্যদিকে, দেবদেবীরা রাবণের ঔদ্ধত্য পাপকর্মের কথা বারবার বলেছেন এবং অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে লক্ষ্মণ, বিভীষণ এবং জটায়ুও ওই পাপকর্মের কথাই পুনরাবৃত্তি করেছেন। কিন্তু বসুন্ধরার মুখেই অনায়ত্ত পূর্বনির্দিষ্ট সেই অপ্রতিবিধেয় বিধানেরই প্রথম স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে, সরমার মুখে তার সমর্থন আছে এবং শেষ সর্গে রাবণের দূতের মুখে সেই অপ্রতিবিধেয় বিশ্ববিধানের স্বরূপটি পরিষ্কার হয়েছে। প্রথম থেকেই অনায়ত্ত শক্তির হাতে রাবণ যে অসহায় ক্রীড়নক একথা বারবার রাবণের মুখে বলালে বোধ হয় রাবণের প্রতিশোধ-সংকল্পের জোর কমে যায় ভেবেই মাইকেল অনায়ত্ত শক্তির কথা আভাসে তাঁর মুখে বলিয়েছেন। এমনকী, নিজের কর্মদোষের কথাও একবারই বলিয়েছেন তাঁর মুখে, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনের জ্বালার কথাও। বসুন্ধরা, সরমা এবং দূতের মুখে তিনবার মাত্র সেই অনায়ত্ত শক্তির কথা বলিয়ে হয়তো রাবণের বীরোচিত সংকল্প আশু কর্তব্যকেই বড় 'রে মাইকেল দেখাতে চেয়েছেন। এবং, একেবারে শেষ সময়ে, মেঘনাদের চিতায় প্রমীলাকে উঠতে দেখেইপূর্বজন্মফল' বলে সমস্ত চেষ্টার ব্যর্থতায় রাক্ষসলক্ষ্মীর উদ্দেশে রাবণকে দিয়ে হাহাকার করিয়েছেন। ইসকাইলাসের নাটক আগামেমনন-এর সূচনায় ট্রয়ের সর্বনাশের আভাস থাকা সত্ত্বেও তো আগামেমননের কর্মদোষ দেখিয়ে 'চরিত্রই নিয়তি' এই কথা প্রমাণিত হয়েছে। পূর্বনির্দিষ্ট নিয়তির বিধান থাকা সত্ত্বেও যেমন চরিত্রের কর্মদোষ দেখাবার অদ্ভুত প্যারাডক্ প্রাচীন গ্রিক জীবনদৃষ্টির বৈশিষ্ট্য ঠিক সেই দৃষ্টিভঙ্গি রাবণের পরিণতির মধ্যেও কাজ করছে, 'পূর্বজন্মফল' বলে তাকে মাইকেল দেশীয় সাজ পরাবার যতই চেষ্টা করুন না কেন। এক জন্মেই কর্মদোষ ঘটিয়ে তো দেবতারা তাকে শাস্তি দিয়ে দিলেন। অন্যদিকে প্রধানত বিরূপ বিধির কথা বলে বলেই রাবণ আত্মীয় স্বজনের মৃত্যুর 'প্রতিবিধিৎসার' বীরোচিত পড়াই করে শূন্য স্বর্ণলঙ্কায় ফিরলেন। তাঁর প্রতিশোধ প্রতার মূলে কোনো নৈতিক সমর্থন ছিল না বলেই তা নিছক প্রতিশোধ স্পৃহা। রাবণের স্রষ্টা একটু বেশি elevated হয়েছিলেন বলেই প্রতিশোধ স্পৃহাই তাঁর অস্ত্র। নইলে হয়তো বিশ্ববিধানের হাত থেকে রাবণকে মুক্ত করে 'চরিত্রই নিয়তি'—এই বাক্যটির তাৎপর্যে মাইকেল অন্য মাত্রা আনতে পারতেন।

 

 Read More:

বিধি-বন্দি রাবণ:

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/-%20.html

রামায়ণের রূপান্তর : মাইকেলের বিবরণে  বিন্যাস

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20%20%20%20.html

গদ্যছন্দ  রীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20.html

রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20.html

বহুবর্ণময় রামায়ণী প্রতীক : সোনার হরিণ

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/blog-post_19.html

মেঘদূত  নব মেঘদূত : রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব পাঠ

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20%20%20%20%20.html

যক্ষের বিদীর্ণ সত্তা: মেঘদূত

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20%20.html

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Read More:

বিধি-বন্দি রাবণ:

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/-%20.html

রামায়ণের রূপান্তর : মাইকেলের বিবরণে  বিন্যাস

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20%20%20%20.html

গদ্যছন্দ  রীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20.html

রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতা

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20.html

বহুবর্ণময় রামায়ণী প্রতীক : সোনার হরিণ

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/blog-post_19.html

মেঘদূত  নব মেঘদূত : রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব পাঠ

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20%20%20%20%20.html

যক্ষের বিদীর্ণ সত্তা: মেঘদূত

https://bengalisirpanskura.blogspot.com/2024/02/%20%20%20%20.html

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Reviews