যক্ষের বিদীর্ণ সত্তা: মেঘদূত

যক্ষের বিদীর্ণ সত্তা: মেঘদূত

Size

Read more

 

যক্ষের বিদীর্ণ সত্তা: মেঘদূত



যক্ষের বিদীর্ণ সত্তা: মেঘদূত

অলকাপুরী থেকে রামগিরিএই অনতিক্রমণীর দূরত্ব দীর্ঘ বিরহ যে যক্ষের মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছেই, উপরন্তু সেই মানসিক যন্ত্রণাকে নিছক স্বগতোক্তিতে প্রকাশ করছে না। আরেক জনের মাধ্যমে করতে হচ্ছে। এমন একজন যে স্বেচ্ছাবিহারী কামরূপ মেঘ, যাকে রামগিরি থেকে অলকায় পৌঁছে সেই বিরহযন্ত্রণার খবরটুকু দিতে হবে। শুধু নিজের কষ্টও নয়, কণ্ঠাশ্লেষপ্রণয়িনীর জীবন রক্ষার জন্যে সে ব্যাকুল হয়েছে। তাই যক্ষ যে ভালো আছে সে খবরটুকু (স্বকুশলময়ী বার্তা) দিতে পারলেও যক্ষপ্রিয়া সান্ত্বনা পাবে আশা তার হয়েছে। কিন্তু এতো তার দাম্পত্যগত স্বার্থচিন্তা। মেঘকে দিয়েই এই স্বার্থ সিদ্ধি করতে হবে। কাজেই যক্ষকে একই সঙ্গে স্বার্থান্বেষী পরমনোরঞ্জনী হতে হয়েছে। কখনো সে নিজের স্ত্রীর কষ্টের কথা বলছে বা বলতে বাধ্য হচ্ছে। কখনো সেই কষ্ট চেপে রেখে দীর্ঘ পথযাত্রিক মেঘকে তুষ্ট করতে হচ্ছে। এবং লক্ষ্য করতে হবে, এই মনস্তুষ্টিতে যক্ষ একই সঙ্গে নিজের পীড়িত মানসিকতাকে প্রক্ষেপও করে ফেলেছে, কখনো সংযত হয়ে তাকে মেঘের সন্তুষ্টিতে মন দিতে হয়েছে। বক্তব্য এই সন্তুষ্টির কাজে যক্ষ এমন সব কথা বলেছে যা মেঘের পক্ষে সুখকর, যক্ষের পক্ষে কষ্টকর। অনেক ক্ষেত্রে সে বোধহয় লক্ষ্যচ্যুত, মেঘকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে সে যেসব রমণীয় দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছে, কী প্রাকৃতিক, কী মানবিক, সেসব দিকে তার নিখুঁত পর্যবেক্ষণ, কৌতূহল বা রসবোধের কথা ভাবলে অন্ততঃ সেই মুহূর্তে তাকে খুব পত্নীগতপ্রাণ বলে তো মনে হয় না। মেঘের স্বভাবের কথা ভেবে তার দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে বা তাকে সন্তুষ্ট করবার জন্যে দেখাতে যক্ষ যে পারিপার্শ্বিক দৃশ্যে নিবদ্ধ হয়েছে তাতে মেঘের সঙ্গে তার ব্যক্তিত্ব তো মিশে গেছেই, উপরন্তু মনে হয়েছে, যক্ষ শুধু পত্নীগতপ্রাণ নয়, সে সাধারণভাবে সৌন্দর্যরসিক এবং দেহজ কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে তার জুড়ি নেই। কিন্তু যে মুহূর্তে তার মনে হয়েছে, এসব সৌন্দর্য মেঘের পক্ষে তৃপ্তিকর কিন্তু তাকে এক জায়গায় আটকে না থেকে পৌঁছোতে হবে তার স্ত্রীর কাছে, তখনই সে সচেতন স্বার্থান্বেষীর মতো বলে উঠেছে, এখানে থামলে তো চলবে না। মেঘকে তো পৌঁছোতে হবে অলকায়যেখানেকল্যাণীযক্ষপ্রিয়া 'বহুবিগণনে' (শ্লোক ৪৮) দিন কাটাচ্ছে নিষ্কলুষ হয়ে। এই যে মেঘের ওপর নিজের ব্যক্তিত্ব আরোপ, মেঘের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য-আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করা এবং পর মুহূর্তেই মেঘের তুষ্টি থেকে সরে এসে নিজের লক্ষ্যে স্থির হওয়ার চেষ্টাআত্মনৈবাবলম্বে, আত্মস্থ হচ্ছি এই ভাষাবিদীর্ণ সত্তাতেই যক্ষের টেনশন। এই টেনশন পূর্বমেঘকে উত্তর মেঘের তুলনায় নাটকীয়তার দিক থেকে অনেক বেশি গভীর মাত্রা দিয়েছে।

প্রথমে তো আশ্লিষ্টসানু মেঘকে দেখে বিরহী যক্ষ কামার্ত হয়েছে। কিন্তু তাকে সে কষ্ট চাপতে হয়েছে মেঘের প্রশস্তি করে। তার বংশ গৌরব, প্রকৃতিপুরুষ রূপে আত্মমর্যাদা, তার বিচিত্ররূপ পরিগ্রহণের ক্ষমতা, তার তাপ জুড়নো জলবর্ষী ক্ষমতা ইত্যাদির কথা বলতে হয়েছে। অনুপুঙ্খভাবে বলতে হয়েছে মেঘ দেখে চূর্ণ কুন্তল সরিয়ে পথিকবধূর অশান্ত হবার কথা, প্রবাসী স্বামী আর প্রোষিতভর্তৃকার ব্যাকুলতার কথা। সেই সূত্রে নিজের অভিশপ্ত জীবন পত্নী বিচ্ছিন্নতার কথা, নিজের পরাধীন বৃত্তির কথা। মেঘদর্শনের আশ্বাস নিজের হতাশাএই দুই বিপরীত চিন্তাকে পাশাপাশি রাখতে হয়েছে যক্ষকে তাই যক্ষের পক্ষে শুধু বিরহ নয়, এই পরস্পর বিরোধী ভাবনাকেও ধরে রাখতে হয়েছে। (শ্লোক ) এই বিরোধী ভাবনাই মেঘদূতের মৌলিক গঠন-চরিত্রটি তৈরি করেছে। কামার্ত যক্ষ মেঘের পথকে শুভলক্ষণ চিহ্নিত দেখিয়েছে। অনুকূল বাতাস বামে চাতকের ডাক। অন্যদিকে গর্ভাধানের ঔৎসুক্যে উল্লসিত বলাকার পক্তিও তার দৃষ্টিসুখ মেটাবে। এখানে একই সঙ্গে মেঘকে তুষ্ট করতে হয়েছে এবং মিলন সুখের তৃপ্তিতে যক্ষ নিজেকে প্রক্ষিপ্তও করেছে। কখনো মনে হয়েছে পত্নী যদি ভুলে গিয়ে থাকে, বা তার সর্বনাশ হয়ে থাকে তাহলে মেঘকে পাঠিয়ে লাভ কি? তাই তাকে বলতে হয়েছে, মেঘ গিয়ে তার পত্নীকে দিবসগণনায় তৎপর দেখবে, যক্ষের আশাবৃত্তেই সে ফুলের মতো বেঁচে আছে। পরমুহূর্তে মনে হয়েছে, নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির কথাই সে বলছে। তাই তাকে আবার বলতে হয়, মেঘের গুরুগর্জনে পৃথিবী কন্দলীকুসুমে পূর্ণ হয়ে শস্যশালিনী হবে, তার পৌরুষ সার্থক হবে গর্জনে উল্লসিত মানসযাত্রী হংসেরা মৃণাল-মুখে আকৈলাস তার সঙ্গী থাকবে। বন্ধু রামপদচিহ্নিত পবিত্র উন্নত রামগিরিকে আলিঙ্গন করে সে চলুক। এখন থেকে যক্ষকে নিজের বিরহকথা একটু উহ্য রাখতেই হয়। আগে পথের কথা বলতে হয়, তারপর নিজের খবর (মার্গং তাবচ্ছৃণু কথয়স্তৎ-প্রয়াণানুরূপং সন্দেশং মে তদনু)

এখন থেকে আশ্বাস নয়, পথের বর্ণনাতেও যক্ষকে মনোযোগ দিতে হয়েছে। বার্তাটি রইল তার অন্তগূঢ় ঘন ব্যথার মতো। কিন্তু পথের বর্ণনাতেও ওই ঘন ব্যথার ছাপ যে থেকে যাচ্ছে যক্ষের টেনশনের সেইটি প্রমাণ। কখনো তাকে নিরপেক্ষ থেকেই বলতে হচ্ছে মেঘকে পাহাড়ের ওপর থেকে উঠতে দেখলেই সিদ্ধাঙ্গনারা ভাববে, বাতাসে বুঝি গিরিশৃঙ্গ উড়ে গেল। কিংবা উত্তরে অলকার দিকে যেতে যেতে দিগৃহস্তীদের হস্তাবলেপ তাকে এড়াতে হবে। কিংবা ইন্দ্রধনু শোভিত মেঘকে ময়ূরপুচ্ছশোভিত গোপবেশধারী বিষ্ণুর মতো মনে হওয়ার কথা। শস্যসম্পদের জন্যে গ্রামবধূদের উৎকণ্ঠিত অপেক্ষার সরল আয়ত দৃষ্টিতে মেঘসৌন্দর্য পানের কথা, সানুমান আম্রকূটে ক্লান্তি দূরীকরণের কথা। এই আম্রকূটের বর্ণনায় যক্ষের মানসিকতার প্রক্ষেপ আছে। আম্রকূটের একটিমাত্র শিখরে কৃষ্ণমেঘ যেন উন্নত স্তনের শ্যামল বৃত্ত। এদৃশ্য ধরাতলের মানুষের পক্ষে পুরো উপভোগ্য নয়, দেব-দম্পতিরই প্রেক্ষণীয়। বোঝাই যায়, মেঘের প্রশস্তি করতে গিয়ে তাকে শারীরিক সৌন্দর্যের উপরকরণ করে তার দেবভোগ্যতার আড়ালে যক্ষের নিজেরই কাল্পনিক উপভোগ চলছে এর পরের শ্লোকেও যক্ষের কামনার প্রক্ষেপ আছে। আম্রকূটের যে কুঞ্জে মেঘ বিশ্রাম নেবে সে কুঞ্জে হয়তো বনচরবন্ধুদের দ্বারা সম্পৃক্ত সুখের তৃপ্তির রেশ থেকে গেছে। আবার সেই মুহূর্তেই তার মনে হয়েছে, মেঘকে তো স্থির থাকতে দেওয়া যাবে না। তাই সে বলছে, তস্মিন্মুহূর্তং স্থিত্বা' জলবর্ষণে হাল্কা হয়ে সে দ্রুতগতিতে বিন্ধ্যপাদে বিশীর্ণা রেবা বা নর্মদার বিচিত্র রেখাবিন্যাস সে লক্ষ্য করেছে।

বর্ষণে নর্মদার শক্তি বাড়িয়ে তার মদধারাসিও জম্বুকুঞ্জপ্রথিহত জল আবার মেঘ যেন পান করে গৌরবান্বিত হয়। নইলে হালকা থাকলে বাতাস লক্ষ্যচ্যুত করবে। লক্ষ্য যে অলকা। মেঘকে সন্তুষ্ট করবার মুহুর্তেই লক্ষ্যচ্যুত হবার আশঙ্কায় যক্ষ তার মানসিক চাপকেই প্রমাণ করেছে। তারপর আবার পথের কথা। ভিজে মাটির গন্ধে উদ্ভিন্ন কন্দলী খেতে খেতে হরিণেরা সে পথ দেখাবে। প্রথম ফোটা কদম্ব ফুল দেখতে দেখতেও তারা ছুটবে। এতে একই সঙ্গে মেঘকে রম্যদৃশ্য দেখানো হলো, আবার মেঘকে রম্যতার কারণ হিসাবেও প্রশস্তি করা হলো কিন্তু পরের শ্লোকে দেখি মেঘকে যে দৃশ্যে দেখানো হয়েছে তাতে দৈহিক মিলনের ইঙ্গিত। মেঘের গর্জনে প্রিয়সহচরীদের স্বয়ংগ্রহ ত্বরিত আলিঙ্গন সুখমুগ্ধ সিদ্ধদের দেখতে দেখতে মেঘ পথ চলবে। এদৃশ্য মেঘের পক্ষে আনন্দের, স্ত্রীবিচ্ছিন্ন যক্ষের কল্পনার ছবিও বটে। এখানে যক্ষ মেঘসত্তায় মিলেছে মিথুন কল্পনায়। পরের শ্লোকে দেখি, যক্ষ আবার স্বসত্তায় ফিরে এসে মেঘকে বলছে, মৎপ্রিয়ার্থ, যিয়াসোঃআমার প্রিয়ার জন্যে যেতে ইচ্ছুক তুমি ককুভ সুরভিতে আমোদিত পাহাড়ে কালক্ষেপ করে ফেলেছো। অতএব কথমপি ভবান্ গত্তমাশু ব্যবস্যেৎ, তাড়াতাড়ি যেতে চেষ্টা করবে, এই প্রার্থনা। এইভাবে যেতে যেতে যখন উজ্জয়িনী এসে গেছে তখন যক্ষ মেঘকে বলছে, তুমি উজ্জয়িনীর সৌধরূপ উৎসঙ্গে প্রণয়-বিমুখ হয়ো না কারণ সেখানকার পৌরাঙ্গনাদের বিদ্যুৎচকিত চঞ্চল কটাক্ষের সৌন্দর্য উপভোগ করে নিতে পারলে মেঘ লোচনৈর্বঞ্চিতঃ হবে। এই ভোগের উপকরণ দিয়ে অভুক্ত যক্ষ তার তৃষ্ণা মিটিয়েছে মেঘের ভোগোপকরণ সাজিয়ে। বিরহীর পক্ষে অন্যের জন্যে এই কাল্পনিক ভোগ্য সঞ্চয় নিশ্চয় কষ্টের। এইভাবেই নির্বিন্ধ্যা এসে পড়েছে বিহঙ্গ চন্দ্রহারে সজ্জিতা নির্বিন্ধ্যা এঁকে বেঁকে চলেছে দর্পিতা বর্তনাতি হয়ে। বক্ষের রসটুকু নিতে হবে। কেননা এই নাভি প্রদর্শনের বিভ্রমই নারীর প্রথম প্রিয়বচন। এখানে যক্ষ-মেঘ যৌথ সত্তা। কিংবা বেণীভূত প্রতনুসলিলা বিরহিণীর সিন্ধুর দৃশ্যেও যক্ষ তার বিরহিণী প্রিয়ার কাল্পনিক ছবি প্রক্ষেপ করেছে। প্রক্ষেপ করেছে প্রার্থনা- চাটুকার প্রিয়তমের মতো শিপ্রার সুরত গ্লানিহরণী হাওয়ার মধ্যে, কিংবা গন্ধবতীর বুক- ভরা পদ্মপরাগ জলক্রীড়ারত যুবতী-মানসিক্ত হাওয়ার মধ্যে। অথবা, 'মহাকালমন্দিরে চামরৈঃক্লান্তহস্তাঃ" পতিতাদের দেহে নখক্ষেতের মতো সুখকর জলকণার মধ্যে। মেঘকে উজ্জয়িনীর ভীরু অভিসারিকাদের অন্ধকারে পথ দেখাতে বলেছে, কারণ স্নিগ্ধ বিদ্যুৎসঞ্চার করে মিলনের সহযোগিতা করাই তো তার কাজ। যক্ষের পক্ষেও সেই কাজেই তো মেঘ চলেছে। কিন্তু এতো অন্যের উপকার। তাই পরমুহূর্তেই মনে হয়েছে নিজের অভীষ্ট সিদ্ধির কথা। সেইজন্যে সে স্বসত্তায় বা স্বার্থচিন্তায় ফিরে এসে আবার মেঘকে বলেছে অন্ধকারে অভিসারিকাদের পথ দেখাবার পর ভবনবলভিতে রাত কাটিয়ে দৃষ্টে সূর্যে পুনরপি ভবান বাহয়েদধবশেষত্সূর্য উঠলে বাকি পথটুকু শেষ করতে হবে।অধবশেষম্' বলে উৎসাহও দেওয়া হয়েছে এইভাবে রামগিরি থেকে আবার রেবা বেত্রবতী নির্বিন্ধ্যা, সিন্ধ, শিপ্রা, গম্ভীরা-কে উপলক্ষ্য রেখে কামনার মোক্ষধাম অলকায় পৌঁছে দেওয়া হলো মেঘকে। শেষ শ্লোকে মেঘের চোখে মিলন যেমন বহুবার দর্শনেও অম্লান, তেমনি যক্ষের বিরহকামনার প্রণয়ী কৈলাসের উৎসঙ্গে অস্তগঙ্গা দুকূল স্বাধীনভর্তৃকা অলকাকে দেখানো হল। মানসিক তৃপ্তিও বটে।

অলকা পর্যন্ত যাত্রাপথের বর্ণনায় যক্ষের মানসিকতার তিনটি স্তর লক্ষ করি। প্রথমত যক্ষের অভিশপ্ত বিরহবেদনা মিলনোৎকণ্ঠা, দ্বিতীয়ত মেঘকে দূত করে দূতের মনস্তুষ্টির জন্যে তার যাত্রাপথের রমণীয় বর্ণনা, যে বর্ণনার কোনো কোনো কখনো মেঘের মনস্তুষ্টির জন্যে নিরপেক্ষভাবে বলা, আবার যে বর্ণনার কোনো কোনো অংশে কামার্ত যক্ষের সত্তা একই সঙ্গে মেঘের মানসিক তৃপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নিজেরও মানসিক তৃপ্তি ঘটিয়েছে। মেঘের সত্তা কখনো পৃথক কখনো যক্ষের নিজের সত্তায় লীন। তৃতীয়ত, মিলনোৎকণ্ঠার জন্যেই যক্ষ শুধু মেঘকে নিজের সত্তায় একাত্ম করে নি, তাকে নিরপেক্ষভাবে স্তুতিও করে নি, বরং একান্ত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে মেঘের সামনে লোভনীয় উপকরণ সাজিয়ে তাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে অলকার পথে হরগৌরীর পাদচারণের সোপান হয়ে কিংবা সুরযুবতীদের ঘর্মলব্ধ হয়েও। পথ পাথেয়ের এই বহুমূল্য অভিজ্ঞতাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে নিজের বিরহ যন্ত্রণাকে চেপে রেখে। তাই মাঝে মাঝে তার নিজেরই ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে।

উত্তর মেঘে যক্ষ আপাতত অনেকটা শান্ত। কারণ ধৈর্যচ্যুতির কারণ অনুপস্থিত। কাজেই মেঘের প্রশস্তি আর অলকা তার সুন্দরীদের বর্ণনা। বিস্ময়ের রোমাঞ্চ আছে, কিন্তু ত্বরিতগতি-হবার টেনশন নেই। কেবল যক্ষপ্রিয়ার সংলগ্ন হতে চলেছে বলেই অলকা হয়ে উঠেছে অক্ষুণ্ণ যৌবন। যেখানে আনন্দই চোখের জল, ইষ্টযোগসাধ্য কামনার তাপ ছাড়া যেখানে দুঃখ নেই, প্রণয়-কলহ ছাড়া বিচ্ছেদ নেই, যৌবনের উর্ধ্বে কোনো বয়স নেই। সেই সূত্রেই অলকার চঞ্চল নারীদের বালি আর মণি নিয়ে খেলা কিংবা স্ত্রী-পুরুষের কামান্দ্রতার ছবি। নারীদের লজ্জারোগের আনন্দিত ছবি। কিন্তু এসব বর্ণনাতে বিদগ্ধ রসিক যক্ষই যে মেঘলীন হয়ে আছে, তা হয়তো অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু এখন থেকে যক্ষের মনে একটু সম্ভাব্য বিপদের ভয় ক্রিয়াশীল। তাই অলকার লঘুমেঘ যক্ষদেব বিমানের গবাক্ষের পথে ঢুকে তাদের ছবিগুলি ভিজিয়ে দিয়ে সম্রস্ত হয়ে পালিয়ে যাবার ছবি। পরোক্ষে, অপেক্ষাকৃত ভারি খাতানামা পুস্করাবর্তকের বংশধর, মর্যাদাসম্পন্ন দূত মেঘের পক্ষে কাপুরুষদের মতো কামাচার যে যক্ষ অবশ্যই আশঙ্কা করে না, এই ইঙ্গিত হয়তো আছে। অলকার যথেচ্ছ ভোগসম্ভার সঙ্গীত-নৃত্যের আয়োজন, অভিসারিকাদের লজ্জামুক্তির চিহ্ন, সম্ভোগ পরিশ্রান্ত যক্ষ-মিথুন, বারাঙ্গনাদের সঙ্গে আলাপী ধনী কামীরা, চতুর নারীদের বিলাসবিভ্রমে অদৃশ্য মদনের সক্রিয়তা এসবই যক্ষ মেঘকে উৎসাহ দেবার জন্যে যেমন বলেছে তেমনই এসব অনন্ত যৌবন অলকার দৃশ্য একদিকে মেঘের পক্ষে লোভনীয় অন্য দিকে বিচ্ছিন্ন যক্ষের পক্ষেও মানসিকভাবে তৃপ্তিকর। কিন্তু যক্ষের গৃহে পৌঁছতেই আর মেঘকে সন্তুষ্ট করতে হয়না তেমনভাবে। সে মানসিক চাপও কেটেছে। এখন নূতন আর একটি ভাবনা, যাকে বলতে পারি উৎকণ্ঠা। যক্ষগৃহের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ রক্তাশোকের চঞ্চল কিশলয়ের হাতছানি কিংবা বন্ধুল ফুলের মদির গন্ধ, ফুটন্ত অশোকের প্রিয়াপদাঘাত কামনা কিংবা বকুলের মুখমদিরা পানের আকাঙ্ক্ষা যে দুটি কামনাই যক্ষের পুরোপুরি রয়েছে। এসব বর্ণনাই পরোক্ষে প্রমাণ করে যক্ষের মনে মিলনের মধুর সম্ভাবনার স্বপ্ন খুবই তীব্র সৃষ্টিশীল। অসাধারণ সৃষ্টিশীলতা বলাই উচিত। কারণ মেঘ যেরূপে যক্ষপ্রিয়াকে দেখবে তার বর্ণনায় অসাধারণ মাত্রা জ্ঞান রয়েছে। তন্বীশ্যামা ইত্যাদি রূপরেখার বর্ণনায় শিল্পীর মানসিক স্থৈর্য অবশ্যই প্রমাণিত। নইলে যক্ষপ্রিয়া যে যুবতী বিষয়ে বিধাতার আদিতম সৃষ্টি-সৃষ্টিরাদ্যের ধাতুঃ' একথা বলার মতো মহৎ শিল্পী-জনোচিত নিরাসক্তি যক্ষের থাকত না। কিন্তু বাস্তব তো শিল্পীকে এই ধ্যানস্তর থেকে নামিয়ে আনেই। তাই পরের শ্লোকেই দেখি, ঘোর কেটে আসছে উৎকণ্ঠায়। তাই তৎক্ষণাৎ তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে : দূরীভূতে ময়ি সহচরে চক্রবাকীমিব একাম্, দূরে চলে গেছি বলে সে একা, চক্রবাকীর মতো একা। বিরহে বিরহে গুরুতর দিনগুলো কেটে গেছে বলে সেই গাঢ়োৎকণ্ঠা প্রিয়া এখন নিশ্চয় শীতে বিশীর্ণ পদ্মের মতো হয়ে গেছে। যক্ষের মনে যে প্রিয়া এতক্ষণ ছিল বিধাতার আদিতম যুবতী সে বাস্তবে এখন বিমদিত পদ্ম। এই বৈপরীত্যই উত্তর মেঘের নতুন মাত্রা, স্বপ্নসম্ভোগের পর প্রিয়ার শরীরে প্রবল রোদন উষ্ণনিশ্বাসের ফলে স্নানচ্ছবি চন্দ্রের দৈন্য। হয়তো সে একমনে পূজো করছে যক্ষেরই কুশল কামনা করে ; কিংবা কাঠের ফলকে যক্ষেরই বিরহ শীর্ণ ছবি আঁকতে যাচ্ছে আর চোখের জল ধুয়ে যাচ্ছে সে ছবি বারবার। কিংবা খাঁচার সারিকার কাছে যক্ষের নামটি শুনতে চাইছে। কিংবা মলিন বসনে বীণা কোলে নিয়ে নিজের লেখা যক্ষনামাঙ্কিত গানটির সুর ভুলে যাচ্ছে। কিংবা দেহলীতে ফুল দিয়ে বিরহের শেষ কটি মাসের দিন গুনছে আর অবসরে স্বপ্নসম্ভোগ করছে। এই সব মনোভাব বর্ণনায় দূতরূপী মেঘকেশুদ্ধাচারীকিংবা নিজের স্ত্রীকেসাধ্বী' বলার মধ্যেও অবশ্যই একটা গোপন আতঙ্ক থেকে যায়। উৎকণ্ঠার এও এক মাত্রা। কিন্তু জাতীয় গোপন ভয়ের চেয়েও ক্রমশ প্রিয়ার বিরহদীর্ণ চেহারাটিই যক্ষের মন জুড়ে বসেছে। যে প্রিয়ার সুগঠিত শরীরের বর্ণনায় ইতিপূর্বে উচ্ছ্বসিত বা ভোগকল্পনায় উদ্দীপ্ত হয়েছে তার মুখে যখন শুনি মানসিক কষ্টে ক্ষীণা, বিরহশয্যায় একপাশে শয়ানা, পুবদিকে আকাশে এক কলা চাঁদের মতো যক্ষপ্রিয়া পড়ে আছে। যে রাত্রি যক্ষের সঙ্গে তার ইচ্ছানুরূপ সঙ্গমে কেটে যেতো সে রাত্রি অশ্রুজলে এখন বিরহনিমগ্ন।বিরহিনীর' দীর্ঘ রাত্রি এখন কাটে না, প্রিয়তমের স্বপ্ন দেখাও বোধহয় সম্ভব নয়, যে রাত্রি বিনিদ্র কাটে তাতো স্বপ্নসম্ভব হতেই পারে না। বিরহের প্রথম দিনটি থেকে যে একবেণী হয়ে আছে তা এতদিনে জমাট জটাভারে পরিণত। শাপের অবসানে হয়তো যক্ষকেই সেই বেণী খুলতে হবে। সেই ক্ষীণ দুর্বল দেহটি দেখে করুণারচিত্ত মেঘকে জল ফেলতেই হবে। মেঘের যাত্রাপথে নারীর যে সৌন্দর্যলক্ষণ শুনে যক্ষ বেশ তারিফ করে বলেছিল মেঘকে উৎসাহ দেবার জন্যে, এখন নিজের প্রিয়ার মধ্যে সেই সৌন্দর্যের উপকরণগুলির অভাবই যক্ষের তীব্র জ্বালার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুদিকের চূর্ণ কুন্তলে অপাঙ্গ প্রসার এখন রুদ্ধ, চোখে তার কাজল নেই,ভূবিলাসও সে ভুলে গেছে। মদিরা নেই,

কিন্তু যক্ষপ্রিয়ার এই বিদীর্ণ বিরহিণীর চেহারা কি যক্ষের কামনাকে একেবারেই জুড়িয়ে দিতে পেরেছে? পারেনি। পারেনি বলেই মনে করি, অলকা 'কামনার মোক্ষধাম' নয়। কামনার মুক্তি ঘটলেই তো সৃষ্টি ফুরিয়ে যাবে। উত্তর মেঘে তাই যক্ষকে প্রথমেই আপাতত শাস্ত বলেছি। মূলত তার মনের গভীরে সেই মিলন-কামনা, প্রিয়ার সঙ্গে অন্যপুরুষের সংসর্গ-ভীতি, বিরহদীর্ণ প্রিয়ার কথা ভেবে তীব্র বেদনাসবই আছে। উপরন্তু প্রিয়ার ভোগোদ্দীপ্ত শরীরের কল্পনা থেকে বিরহখিন্না মূর্তিতে, সম্পূর্ণ বিপরীত কল্পনাতে, অবনমনের ছবিও পাই। অবনমন একদিক থেকে বাস্তবস্বীকৃতি। এই স্বীকৃতিতে আনন্দর আছে। যক্ষের বিরহেই তো প্রিয়ার এই 'কলামাত্র শেষ' অবস্থা। সে অবস্থা তারই সতীত্বের প্রমাণ। কিন্তু ভোগকল্পনাদীপ্ত যক্ষ কি প্রিয়ার এই অপাঙ্গ প্রসারহীন, ভূবিলাসহীন ক্ষীণ তনুর কথা ভেবে কামনা থেকে মুক্তি পেয়েছে? পায় নি। বিরহদীর্ণা প্রিয়ার আড়ালে সেই স্ফুটিত যৌবনা প্রিয়াকে সে ভুলতে পারে নি এখনও। তাই আবার যক্ষকে মেঘলীন হয়ে বলতে শুনি : তুমি দেখবে তার বাম উরু কাঁপছে। কাঁপাটা শুভলক্ষণ। সেই সজল-সতেজ উরুদেশ কদলীর মধ্যভাগের মতো গৌরবর্ণ। ওই উরুদেশ সম্ভোগাতে আমার হাতে নিত্য বিমর্দিত হতো। কামের উত্তেজনায় কত নখক্ষত পড়েছে তাতে। আজ আট মাস বাদে সেই ক্ষতগুলি হয়তো মিলিয়ে আসছে আরো জাগরণে সে যদি স্বপ্নসম্ভোগ করে তবে মেঘ যেন একটু অপেক্ষা করে শেষ যাম পর্যন্ত। যক্ষের প্রেম যে কতখানি কারুণ্যে স্নেহে কমনীয় হয়ে উঠেছে তা এখানে বোঝা যায়। মেঘের আচরণে এতটুকু আঘাত বা আকস্মিক চমক যাতে না থাকে সে ব্যাপারে যক্ষ তাকে সচেতন করে দিয়েছে। প্রথমেই মেঘকেঅবিধবা’ ‘স্বামীর প্রিয় বন্ধু' ইত্যাদি বলে যক্ষপ্রিয়াকে আশ্বস্ত করতে হবে, আশ্বস্ত করতে হবে মেঘের ভূমিকার কথা বলেসংযোজন কর্তার ভূমিকা, প্রোষিতভর্তৃকার সঙ্গে প্রবাসী বিরহীর যে মিলন ঘটিয়ে দেয়। কারণ, যক্ষ বুঝিয়েছে মেঘকে, স্বামীর প্রিয় বন্ধুর কাছে পাওয়া স্বামীর কুশলবার্তা স্বামীসঙ্গমের চেয়ে সামান্য মাত্র কম। প্রিয়াকে বোঝাতে হবে, একই রকমের কাতর, উৎকণ্ঠ, গাঢ়তপ্ত, দীর্ঘশ্বাসে উষ্ণ যক্ষপ্রিয়ার অঙ্গাঙ্গী হতে চাইছে। যে প্রিয়ার মুখস্পর্শলাভের জন্যই স্পষ্ট কথাকে অস্পষ্ট করে কানে কানে বলতো, সে এখন দূরবর্তী অদৃশ্য থেমে মেঘকে নেহাৎই মাধ্যম করে নিজের কথাই শোনাচ্ছে। মেঘকে এই কথাই শোনাতে হবে যে, প্রিয়ঙ্গুলতায়, চকিত হরিণীপ্রেক্ষণে, চাঁদের লাবণ্যে, ময়ূরের কলাপে, ছোট নদীর ঢেউয়ে প্রিয়ার অঙ্গাভাস, দৃষ্টি, লাবণ্য, কেশরাশি, ভূবিলাস পাওয়া ঠিকই যায়। কিন্তুএকত্রসেই প্রাণময় সত্তাটিকে সর্বত্র পাওয়া যায় না। একে কি যক্ষের কামনামোক্ষ বলা যায়? এতো সমগ্র শরীরী সত্তাটির জন্যে অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা। তাই যক্ষকে বলতে শুনি :হন্তৈকস্মিন্ রুচিদপি তে চণ্ডি সাদৃশ্যমস্তি' এই উপলব্ধির পরে যক্ষের মিলনাসক্তি প্রিয়ার সমগ্র রূপের জন্যে কাঙাল হয়েছে। প্রকৃতির মধ্যে যে প্রিয়াকেঅখণ্ডভাবে পায়নি তাকে পেতে চেয়েছে ছবি এঁকে পূর্ণরূপ দিয়ে। কিন্তু সে পূর্ণাবয়বটিও চোখের জলে ধুয়ে গেছে। অগত্যা স্বপ্নসম্ভোগ, শূন্যে বাহুপ্রসারণ, আর তাই দেখে বনদেবীর কারুণ্যের অশ্রুপতন। তখন নিরুপায় হয়ে, পরিপূর্ণ চেতনা নিয়ে উত্তরের হাওয়াকে আলিঙ্গন করে মানসসম্ভোগ চলে। পূর্বমেঘের সেই কামার্ত যক্ষের চেতনা- অচেতন ভেদলোপের পুনরাবৃত্তি এখানে। যে অবস্থা বিরহিনী প্রিয়ার হয়েছে বলে যক্ষের ধারণা, সে অবস্থা যে তারও হয়েছে এটা দূতের মাধ্যমে বলা দরকার। তাই মেঘকে বলতে হবে, যক্ষের রাত কাটে না, দিনও কাটে না। বিরহ তাকে নিরাশ্রয় করেছে। দূতকে শুধু নিজের দুঃখ বিরহের কথা বলতে বলতে যক্ষের আবার মনে হয় সে বড় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। তাই মেঘকে 'বাগ্বিদগ্ধ' 'লে তার ওপর ভার দিয়ে যক্ষ যে নিশ্চিত্ত একথাও একই সঙ্গে বোঝাতে হয়। প্রিয়ার কাতরতা কল্পনা এবং নিজের কাতর অবস্থার কথা প্রিয়াকে জানানোর এই অন্তহীন চেষ্টা শেষ পর্যন্ত যক্ষকে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে গেছে যে, খানিকটা আত্মস্থ হবার চেষ্টা না করলে বিচ্ছিন্ন স্বামী-স্ত্রী দুজনের পক্ষেই অমঙ্গল। কাজেই মনকে শক্ত করতে হবে, ভাবতে হবে দুঃখ কেটে যাবে। সংসারে মানুষের ভাগ্য তো চক্রনেমির মতো ওঠা-নামা করে। এটা ওঠা-নামাকে মেনে নিয়েই আমাদের দুঃখকে অতিক্রম করবার আশা করতে হয়। তাই আর 'টি মাস কাটিয়ে এই বিরহ সময়ে যে-সব ভোগবাসনার পরিকল্পনা করা গেল তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে।

কিন্তু আত্মস্থ যক্ষের এই ধৈর্য প্রতীক্ষার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ একটা ভয় তাকে ব্যাকুল করে তুলেছে। সে ভয় প্রিয়ার কাছে দূরের বিশ্বাসযোগ্য কোনো পরিচয়পত্র দিতে না পারার ভয়। প্রিয়া তো দূতকে প্রবঞ্চক ভাবতে পারে। কাজেই মেঘের হাতে খাঁটি দৌত্যের অভ্রান্ত প্রমাণের হাতিয়ারটি যক্ষকে তুলে দিতে হয়। দাম্পত্য জীবনের একান্তই ব্যক্তিগত একটি ঘটনা। কণ্ঠলগ্ন নিদ্রিতা প্রিয়া তাকে জেগে উঠে এক-রাত্রিতে বলেছিল, 'আমি স্বপ্নে দেখলুম তুমি অন্যের সঙ্গে বিহার করছো' এই গোপনীয় ঘটনাটি দূতের অভিজ্ঞান হিসেবে যথেষ্ট হবে। কিন্তু ভয় আরও আছে। অভিজ্ঞান দেওয়া গেল তো এলো অপবাদের ভয়। যক্ষের অনুপস্থিতিতে দুজনের অপবাদ রটনায় যক্ষপ্রিয়া স্বামীকে অবিশ্বাস করতে পারে। তাই যক্ষকে আবার বলতে হয়, বিরহেই প্রার্থিত বস্তু সত্যিকারের ঘনীভূত প্রেমে পরিণত হয়। প্রিয়া এখন সেই ঘনীভূত প্রেমেরই মানবী মূর্তি। তাই মেঘের উপর প্রিয়াকে বিশ্বাস জাগাবার গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে যক্ষকে বলতে হয় প্রিয়ার অভিজ্ঞান দিয়ে আশ্বস্ত করে তার জীবন বাঁচাতে হবে। কাজেই ভয়ের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত অধৈর্য এসে আবার মিশেছে। এতো বিচিত্র ভয় ভাবনা শঙ্কা, অধৈর্যময় যে প্রেমের জ্বালা, তাকে বহন করার দৌত্য দিয়ে তাকে সাধু মহৎ বলে তুষ্ট করতে হয়। বলতে হয়, কাজেই মহতের মহত্ত্ব প্রমাণিত হয়। অনুচিত স্বার্থ সিদ্ধির প্রার্থনা করে যক্ষ যে স্বেচ্ছাচারী মেঘের গতিপথকে অলকার পথে চালিত করতে চাইছে জন্যেও সে ক্ষমা চেয়েছে। করুণাময় বিগলিত চিত্ত বলে মেঘের কৃষ্ণরূপের স্তুতি করেছে, বিদ্যুতের সঙ্গে চিরকাল অবিচ্ছিন্ন থাকবার সৌভাগ্য কামনা করেছে। এই কাকুতি মিনতির পেছনে যে যন্ত্রণা অধৈর্য তাকে নিয়ত বিদীর্ণ করেছে, এক-আধ মুহূর্তের আত্মস্থ হবার সংকল্প এনে সে বিদীর্ণ সত্তাকে সে চাপা দিতে পারে নি।

কাজেই পূর্বমেঘে বিরহদীর্ণ যক্ষ মেঘের পথ পাথেয়কে অভাবনীয় আকর্ষণে ভরিয়ে তুলেও যেমন শেষ পর্যন্ত মেঘকে তাড়না করে নিয়ে গেছে অলকার পথে তীব্র সঙ্গ- সংকল্পের আবেগে, উত্তরমেঘে সেই তাড়না নেই বটে, কিন্তু নতুন করে এসেছে স্ত্রীর সতীত্ব নষ্ট হবার গোপন আশঙ্কা, স্ত্রীর বিরহদীর্ণ দুরবস্থার (যে অবস্থা যক্ষের তীব্র ভোগকামনার বৈপরীত্যে সত্যিই করুণ) কল্পনায় বিষণ্ণতা, নতুন করে প্রিয়াসঙ্গ সুখের তীব্র ইচ্ছা, প্রকৃতির মধ্যে বিভিন্ন দৃশ্যে প্রিয়ার খণ্ডখণ্ড রূপাভাসে অতৃপ্তি, অখণ্ড চিত্ররূপে তাকে পূরণ করার ব্যর্থ চেষ্টা, ক্ষণিকের জন্যে আত্মস্থ হবার চেষ্টা, দূত মেঘকে স্ত্রী অস্বীকার করতে পারে এই আশঙ্কা, এবং শেষত, স্ত্রীকে বিশ্বাস করিয়ে তার কাছ থেকে কুশলবার্তা আনিয়ে নেওয়ার জন্যে মেঘের কাছে করুণ মিনতি যক্ষকে শেষ পর্যন্ত তীব্র টেনশনের মধ্যে রেখে দিয়েছে। কাজেই ভাবে-অনুভাবে বহু বর্ণময় যক্ষের প্রেম প্রিয়াকল্পনায় নিয়তই সৃষ্টিশীল, তার টেনশনই তাকে স্রষ্টা করে তুলেছে। মেঘদূতের জন্ম বিকাশ-বিন্যাস এই স্রষ্টারই হাতে-গড়া।"

 

 

 


0 Reviews