Read more
বাংলা সাহিত্যে সুররিয়ালিজম
বাংলা সাহিত্যের কোন কবিকেই সুররিয়্যালিজমের কবি বলে মেনে নেওয়া যায় না। অথচ সুররিয়্যালিজমের প্রভাব কোন কবিতাতেই নেই—আধুনিক বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এমন কোন কবিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই ভাবাদর্শ জীবনানন্দের বহু কবিতাতেই ছায়াপাত ঘটিয়েছে, তবু তাঁকে ফরাসী কবি আঁদ্রে ব্রেতো বা লুই আরাগঁ বা পল এলুয়ার মত সুররিয়্যালিষ্ট কবি বলে চিহ্নিত করা যায় না, যেমন যায় না বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়-কে। অথচ এঁরা প্রত্যেকেই কোন না কোন সময়ে কোন একটি বিশেষ কবিতার ক্ষেত্রে সুর রিয়্যালিজমের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছেন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাস্তবতাবাদ বা ডাডাবাদের যতই পরাবাস্তববাদের ঝোড়ো হাওয়া কল্লোলযুগ ও তৎপরবর্তী বা দের জগতে প্রবেশ করেছে। কবি জীবনানন্দ দাস এমনই একজন কবি। ‘কবিতার কথা' প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “আমি বলতে চাই না যে, কাব্যের সঙ্গে জীবনের কোন সম্বন্ধ নেই, সম্বন্ধ রয়েছে কিন্তু প্রসিদ্ধ প্রকটভাবে নেই। সৃষ্টির ভিতর মাঝে মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়, এমন বর্ণ দেখা যায়, এমন আঘ্রান পাওয়া যায়, এমন মানুষের বা এমন অমানবীয় সংঘাত লাভ করা যায়—কিম্বা প্রসূত বেদনার সঙ্গে পরিচয় হয় যে, মনে হয় এই সমস্ত জিনিষই অনেকদিন থেকে প্রতিফলিত হয়ে কোথায় যেন ছিল।”
এই চিন্তা বা এই ভাব পরাবাস্তববাদীদের, অথচ জীবনানন্দের কবিতাতে রয়েছে এই ভাবের প্রতিফলন। তিনি আপাত অসঙ্গত বহু প্রতীক, উপমা বা চিত্রব্যবহার করেছেন যা, বাস্তব, অবাস্তব, স্বপ্ন কল্পনার স্তর হতে উঠে এসে স্বপ্ন ও কল্পনাময় এক জগৎ সৃষ্টি করে। ঘোড়া, হাঁস, পেঁচা, ইঁদুর, হরিণ প্রভৃতি প্রতীকের মধ্য দিয়ে রহস্যময়তার জগৎসৃষ্টি করেছে।
“মে।মের আলোয় আজ গ্রন্থের কাছে বসে—অথবা ভোরের বেলা নদীর ভিতরে অমরা যতটা দূর চলে যাই—চেয়ে দেখি আরো কিছু আছে তারপরে।
অনির্দিষ্ট আকারের পানে উড়ে হরিয়াল আমারো বিবরে ছায়া ফেলে। ঘুরোনো সিড়ির পথ বেয়ে যারা উড়ে যায় ধবল মিনারে কিম্বা যারা ঘুমন্তের মতো জেগে পায়চারি করে সিংহদ্বারে,
অথবা যেসব থাম সমীচীন মিস্ত্রির হাত থেকে উঠে গেছে বিদ্যুতের তারে তাহারা ছবির মতো পরিতৃপ্ত বিবেকের রেখায় রয়েছে অনিমেষ। ” ( আবহমান তাঁর ‘বালতা সেন' কাব্য গ্রন্থের ‘বেড়াল' কবিতায় কবি পাঠককে নিয়ে গেছেন মগ্ন
চৈতন্যের আপাত অসংলগ্ন ভাবনার রাজ্যে।
‘হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান রঙের সূর্যের নরম শরীরে শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে, তারপর অন্ধকারকে ছোট ছোট বলের মতো থাবা
দিয়ে লুপে আনল সে
সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল।”
কিংবা অভিনব প্রতীকের সাহায্যে কবিতায় প্রকাশ যন্ত্রযুগের করুণ আর্তি,
হশ্বের ভিতরে বুঝি—ফাল্গুনের জোৎস্নার ভিতরে
দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে
হরিণেরা, রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়
বাতাস ঝাড়িছে ডানা—মুক্তা ঝরে যায।
(হরিণেরা)
‘বোধ’ কবিতায় বাস্তব ও কল্পনার খেয়ায় স্বপ্নীল রহস্যময় জগৎসৃষ্টি হয়েছে, যেখানে পাঠকমাত্রেই বিস্ময়বিমুঢ়।
“মাথার ভিতরে/স্বপ্ননয়-প্রেম নয়-কোন এক বোধ কাজ করে। / আমি সব ছেড়ে । আমার প্রাণের কাছে আসি,/ বলি আমি এই হৃদয়েরে/সে কেন জলের মত ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়।। অবসাদ নাই তার?/নাই তার শক্তির সময়?/ কোনদিন ঘুমাবেনা? ধীরে স্তরে থাকবার স্বাদ/ পাবে নাকি?”
সুর রিয়্যালিজমের লক্ষণ ভাবে স্পষ্ট প্রতীয়মান জীবনানন্দের বহু উদ্ধৃত ‘ঘোড়া’ কবিতায়।
“আমরা যাইনি মরে আজো—তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়, মহীনের ঘোড়া গুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে, প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন—এখনও ঘাসের লোভে চরে পৃথিবীর কিমা করে ডাইনামো'র পরে।
আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে এক ভিন রাত্রির হাওয়ায়, বিষণ্ণ খড়ের শব্দ ঝরে পড়ে ইস্পাতের কলে,
চায়ের পেয়ালা কষা বেড়াল ছানার মতো—ঘুমে খেয়ো কুকুরের অস্পষ্ট কবলে
হিম হয়ে ন'ড়ে গেল ওপাশের পাইস রেস্তরাঁতে, প্যারাফিন লণ্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে,
এই সব ঘোড়াদের লিওলিথ স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।”
সুররিয়্যালিজম
ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বলেছেন যে সুররিয়ালিজম হল “অচেতন স্তরে বন্দী সুরধিগম্য সত্তাকে রূপ দেবার প্রবণতা” – এখানেও সেই প্রবণতাই বিদ্যমান।
জীবনানন্দের 'বনলতা সেন' কাব্য গ্রন্থেই পরাবাস্তব বাদের আধিক্য বেশী। এই ভাবধারা ‘বনলতা সেন' কবিতায় যেমন আছে, তেমনি আছে শ্যামলী, অন্ধকার, সুচেতনা, সুরঞ্জনা, নগ্ন নির্জন হাত–প্রভৃতি কবিতায়।
কবি ইন্দ্ৰিয়াতীত অভিব্যঞ্জনায় নিমগ্ন থাকলে, আমরা তাঁকে সুররিয়্যালিষ্ট বলি। কিন্তু কবিরা তো অনুভূতির জগতের লোক, তাই কখনও কখনও তাদের কবিতা অন্তচেতনাকে স্পর্শ করে। যেমন করেছে বিষ্ণু-দের কিছু কবিতায়।
“ঘুম নয়, ঘুমের কিনারে, / যেখানে বালির নীলাচল ভাঙে মহানীলিমায়। শরীরের প্রায় পাড়ে/প্রায় বুঝি মানসের যুক্ত সীমানায়/
অথবা আকাশভেদী অথচ আকাশ নয়, চূড়ায় চূড়ায়/শরীরের সাড় ঘেঁষে নিরুদ্দেশ পানে পাড়ে ঘোরা।
ঘোরা কিংবা ওড়া, যেন ছিল, বাজ,/গগনভেড বা যেন সোনালি ঈগল/ শিকারের খোঁজে নয়, স্বভাবে তৃপ্তিতে ভাসা/দুইডানা মেলে দেওয়া, যেন শুদ্ধ পিলু বা
খাম্বাজ।
যেন-জীবনের সমস্ত শিকল, যা কিছু বিকার/সব কিছু ফেলে দেওয়া, পূর্ণ সব আশা ও
হতাশা”।
(স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত)
‘মানসের যুক্ত সীমানা' বলতে মগ্ন চৈতন্যের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন কবি। অপর একটি কবিতা ‘রাত্রি হয় দিন'। এ রয়েছে অচেতন সত্তার উত্তরণ।
“দুটি সত্তা, ভিন্ন রাজ্য দিনের আলোয়,/ সীমান্ত হারায় রাত্রে, ঘনিষ্ঠ আঁধারে/ একটি শয্যার প্রান্তে দুটি অসীমের/তখন; কুলান হয় গরম হিমেল / ভিন্ন বিবেচনা দেখা গেছে বারে বারে / তবুও কী অসহায় দময়ন্তী—নল। যেন বা এরাও, অঙ্গে বিগলিত চীর / মনের হরিষে কিংবা বিষাদে অস্থির/ সুর রিয়্যালিজমের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়-এর কবিতায়। তাঁর বহু কবিতাই এই ভাবাদর্শের প্রভাবে প্রভাবান্বিত, তবে স্পষ্ট ছাপ পড়েছে 'জরাসন্ধ', 'প্রভুনষ্ট হয়ে যাই’, ‘সুন্দর এখানে একা নয়’, ‘ঈশ্বর থাকেন জলে’, ‘সোনার মাঝি খুন করেছি' প্রভৃতি কবিতায় ৷
“পচা ধানের গন্ধ, শ্যাওলার গন্ধ, ডুবো জলেতে চোকো মাছের আঁশগন্ধ সব আমার অন্ধকার অনুভবের ঘরে সারিসারি তোর ভাঁড়ারের নূন মশালার পাত্র
হলো মা। আমি যখন অনঙ্গ অন্ধকারের হাত দেখিনা, পা দেখিনা, তখন তোর জরায় ভর করে এ আশায় কোথায় নিয়ে এলি।”
(জরাসন্ধ)
এ অন্ধকার বাস্তবের নয়—কল্পনার, সচেতনের নয় অবচেতনের, চর্যাপদের সান্ধভাষার মতই এর ভাষাও আলো আঁধারি—বিচ্ছিন্ন, অসংলগ্ন ভাব—মগ্নচৈতন্যের অস্পষ্টতা একে ঘিরে সৃষ্টি করেছে সঙ্কেত—যার ইঙ্গিত স্পষ্ট, কিন্তু অর্থ দুরূহ।
সুররিয়্যালিজমের ছাপ পড়েছে প্রেশেন্দ্র মিত্রের কিছু কবিতায়, আলোক রঞ্জন দাশগুপ্ত এবং জয় গোস্বামীর কিছু কবিতাও এই ঘরাণ ।
বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিসিজম
বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিসিজম প্রসঙ্গে প্রথমেই স্মরণে আসে প্রাক চৈতন্যযুগের সা.স্বতার্ঘ্য বড়ু চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন'-এর পৌরাণিক সংস্কৃতি ও লোকাশ্রয়ী ভাবনার দ্বৈত স্বরসঙ্গতির কথা। রাধাকৃষ্ণের উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্যে নাটকীয় দ্বন্দ্ব সৃজন, নিরপেক্ষ কবিমানস এবং স্মরণীয় সমাজে কামকলার প্রভাব বর্ণনায় চন্ডীদাস ক্লাসিকপন্থী। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করে এ কাব্যে পুরাণ, ভাগবত, জয়দেব ইত্যাদির প্রভাব যেমন বর্তমান, তেমনই প্রভাব পড়েছে সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক রীতিনীতি, প্রবাদ ও প্রবচনের। আঙ্গিক প্রকরণেও সংস্কৃত চিন্তা ও লোকচেতনার সমন্বয় ঘটেছে। পয়ারের বিচিত্র উপস্থাপনায়, প্রাচীন সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রের আনুগত্যে, এবং এপিক সিমিলির মতো জয়দেবও পুরাণ থেকে আহুত কবিপ্রসিদ্ধি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে অনেকাংশেই ক্লাসিক মর্যাদায় ভূষিত করেছে।
মধ্যযুগীয় ক্লাসিকলক্ষণ দৃষ্ট হয় মঙ্গল কাব্যের বিভিন্ন ধারায়। নারায়ণ দেবের 'মনসা মঙ্গল' কাব্য আঙ্গিকগত অসংলগ্নতা সত্ত্বেও ভাবকল্পনায় দৃঢ় নিবদ্ধ ও সংহতিপূর্ণ। তিনি তাঁর পদ্মা পুরাণে ধর্মের ভিতরেও মানবাত্মার সুখ দুঃখের সন্ধান করেছেন, অত্যাচারিত তবু অপরাজিত মানববীর্যের সুস্পষ্ট চিত্র এঁকেছেন এবং চরিত্রায়ণেও মহিমাস্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল আদিম পৌরুষকে উদ্ভাসিত করেছেন। মুকুন্দরামের 'অভয়ামঙ্গল' কাব্য শিল্পবোধ ও চারুত্ব
ক্ল্যাসিসিজম
সৃষ্টিতে, জীবনদর্শনের নানাবিধ ইঙ্গিতে, আখ্যানভাগ নির্মাণ ও চরিত্রচিত্রণে এবং ঘটনামুখ্য আবর্তনে ও সংলাপ বৈচিত্র্যে ক্লাসিক লক্ষণাক্রান্ত। তাঁর কাব্যে চিন্তার কৌলিন্য ও ভাষার ঈশিত্ব এবং আশাবাদী জীবনদর্শন গুহায়িত উপন্যাসের সুপ্ত বীজ।
রাঢ়ে, জাতীয় কাব্য ধর্মমঙ্গল। এতে ঐতিহাসিক উপাদান সামান্যই এবং সেই সামান্য উপাদানকে আশ্রয় করে লোককল্পনা পল্লবিত। মহাকাব্যিক vastness এবং grandeur नা থাকায় ধর্মমঙ্গল মহাকাব্য হয়নি, কিন্তু মহাকাব্যের উপযোগী বীররসের উপাদান ও যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনা আছে।
সংস্কৃত রাগাণ ও মহাভারত প্রাচীন মহাকাব্য এবং সেই অর্থে ল্ডে ক্লাসিক পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু কৃত্তিবাসের রামায়ণ' ও কাশীদাসের 'মহাভারত'-কে সঠিকভাবে বাংলাভাষায় সংস্কৃত রামায়ণ বা মহাভারতের অনুবাদ বলা যায় না। এ দুটিই মূলত শূলের ভাবানুবাদ। বাল্মীকির রামায়ণে দশরথের সত্যাশ্রয়ী বিষণ্ণতা ও স্নেহব্যাকুলতা, কৈকেয়ীর স্বার্থপরতা এবং ঈর্ষাপরায়ণতা, ভরতের ত্যাগ ও তিতিক্ষা, লক্ষ্মণের বলিষ্ঠতা ও পৌরুষ, রামচন্দ্রের ন্যায় ও নীতিপরায়ণতা, বীরত্ব এবং কর্মকুশলতা, সীতার ব্যক্তিত্ব, ধৈর্য ও ভারতীয় নারীর আদর্শবাদ চরিত্র মহিমায় সমুজ্জ্বল। অন্যদিকে কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামচন্দ্র প্রেমের দেবতা বিষ্ণুর incarnation বা অবতার, ভক্তপ্রাণ ও দয়ালু। লক্ষ্মণ উদ্ধৃত, ভরত নিষ্প্রাণ আদর্শবাদী, দশরথ স্ত্রৈণ ও দুর্বলচিত্ত, সীতা পতিপরায়ণা বঙ্গবন্ধু। কোনো চরিত্রই স্বাতন্ত্র্যে ও বলিষ্ঠতায় উজ্জ্বল নয়। বাল্মীকি যেখানে সত্যম শিবম সুন্দরম'-এর জয়গানে পারিবারিক আদর্শবোধ, ন্যায়-নীতি তথা ভক্তির মহিমা এবং মানবতাবাদের বিজয় পতাকা উত্তোলিত করেছেন, কৃত্তিবাস সেক্ষেত্রে গার্হস্থ্য ধর্মকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
সেক্ষেত্রে কাশীদাসী মহাভারত মহাভারতের অমৃতপূর্ণ ঘটকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে, বাঙালিকে পথ দেখিয়েছে অমৃতলোকের। কাহিনী বর্ণনায় কিছু পার্থক্য থাকলেও নীতিকথার আক্ষরিক অনুবাদে, পৌরাণিক পরিমন্ডল সৃষ্টিতে রস ও ধ্বনির পারম্পর্য রক্ষায় তিনি অনেকটাই মূলানুগ। এসবই ধ্রুপদী কাব্যের লক্ষণ।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সার্থক ক্লাসিক কাব্য রচয়িতার নাম শ্রীমধুসূদন এবং ক্লাসিক কাব্যটির নাম 'মেঘনাদ বধ'। ইলিয়াড়, ওডেসি, রামায়ণ ও মহাভারতকে বলা হয় epic of growth বা original epic 'মেঘনাদ বধ' সে ধরনের মহাকাব্য নয়। এ মহাকাব্য ভার্জিল। টাসো, দান্তে, মিল্টন, কালিদাস, ভারবি, মাঘ এবং শ্রীহর্ষ রচিত মহাকাব্যের অন্তর্গত। একে বলা হয় epic of art বা Literary epic। এগুলি মূল মহাকাব্য থেকে গৃহীত কোনো এক বিশেষ অংশ। অলঙ্কারের বাহুল্যে এবং বর্ণনার ছটায়, ব্যক্তিগত প্রতিভার কুশলতায় এবং বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে এই ধরনের মহাকাব্য শিক্ষিত ও মার্জিত রুটিন পাঠকের জন্য উদ্দিষ্ট।
'মেঘনাদ বধ'-এর নয়টি সর্গে আছে মোট তিনদিন দুইরাত্রির কাহিনী। বীরবাহুর মৃত্যুতে শোকের মধ্য দিয়ে গ্রন্থারম্ভ এবং সমাপ্তিও মেঘনাদের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার মাধ্যণে। এ মহাকাব্যের নায়ক রাবণ ও মেঘনাদ। এই দুই চরিত্রের পরিকল্পনার পিছনে গ্রীক অদৃষ্ট তত্ত্ব বা নিয়তিবাদ এবং শেক্সপিয়রের কর্মতত্ত্ববাদ—উভয় আদহি কার্যকরী। রাবণের পরিণামের জন্যে দায়ী কে?—তার স্বকৃতকর্ম না নেমেসিস নামধারী দুয়ে নিয়তি? রাবণ নিজে শুনে করেন যে তাঁর পরিণামের জন্য নিয়তিই দায়ী তাঁর নিজের কোনো পাপবোধ নেই। এটা নিঃসন্দেহে ক্লাসিক। কিন্তু মহাকাব্যের পরিণাম অশ্রুজল। ট্রাজিক রস করুণ রসসাগরে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত। আসলে রাবণ চরিত্র অঙ্কনে মধুসূদন মিল্টনের শরণাপন্ন হয়েছেন। মিল্টনের 'প্যারাডাইস লস্ট'-এর শয়তানের আদলে তিনি রাবণ চরিত্র এঁকেছেন, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঊনবিংশ শতকীয় প্রেরণা—যে প্রেরণায় ঘরকুনো, সদাসন্তুষ্ট বাঙালি জাহান্নমের আগুনে বসিয়া 'হাসি পুষ্পের হাসি’—হাসতে চেয়েছিল। মেঘনাদ চরিত্র পরিকল্পনাতেও এই বোধ কাজ করেছে। ভারতীয় পুরাণকে তিনি গ্রীক ও রোমান আদর্শের দৃষ্টিতে দেখেছেন। দেবদেবীরা ভারতীয় ঐতিহ্য পরম্পরার নয়—তারা মানুষের মতোই দ্বেষ, ঈর্ষাও কলহে ব্যাপৃত। ভারতীয় ঐতিহ্যে দেবতারা কখনওই মানুষের সমপর্যায়ভুক্ত নন। গ্রীক বা রোমান প্রভাব এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, কাব্যারম্ভে তিনি হোমার, ভার্জিল, টাসো, দান্তের কাছ থেকে ঋণের কথা স্বীকার করেছেন। প্রথম সর্গ থেকে শেষ পর্যন্ত দু-একটি সর্গ ব্যতীত সর্বত্রই এই পাশ্চাত্য গ্রীক ও রোমান প্রভাব দৃষ্ট হয়। প্রমীলার চরিত্রে টাসো'র আবির্ভাব (La Gerusalemme)-এর ছায়া ১ম সর্গে যেমন আছে, তেমনই মেঘনাদেও আছে রাইনান্ডোর প্রভাব। প্রেতলোকের বর্ণনা ভার্জিলের ঈনিডকে স্মরণ করিয়ে দেয়। অবশ্য মিল্টনীয় প্রভাবও এতে আছে। ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় ইলিয়াড ২৪ সর্গের সঙ্গে মেঘনাদ বধের শেষ সর্গের তুলনা করে এই প্রভাবের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ৭ম খণ্ড)।
লিরিক বাঙালির স্বাভাবিক কাব্যপ্রবণতা হলেও মধুসূদন চেয়েছিলেন ক্লাসিকের আবরণে বীররসের গান গাইতে; তিনি সচেতনভাবে প্রস্তুত থেকেও মহাকাব্যের বিশাল অবয়বকে অশ্রুসাগরে নিমজ্জিত করেছেন। কারণ, রাবণের জীবনকথা যে তাঁরই জীবনকথা। শ্রদ্ধেয় অসিতবাবু যাকে বলেছেন 'নির্জন নিঃশব্দ কাব্যমূর্তি । তাই মেঘনাদ বধে ক্লাসিকের আবরণের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে লিরিকের মূর্ছনা।
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বৃত্রসংহার (১৮৭৭)-কে মহাকাব্য বলা হয়। বিষয় নির্বাচনে মৌলিকতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘স্বর্গোদ্ধারের জন্য নিজের অস্থিদান এবং অধর্মের জন্য বৃত্রর সর্বনাশ—যথার্থ মহাকাব্যের বিষয়। ক্লাসিক রীতি অনুসরণ করে Poetic Justice-কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ইন্দ্র, বৃত্রাসুর, ঐন্দ্রিলা, রুদ্রপীড় প্রমুখ চরিত্র নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। প্রণম্য দেবপদে ভক্তি, শ্রদ্ধা তপর্ণ যেমন ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারী, তেমনই আছে মাতৃভূমি রক্ষায় তৎপর দানবদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম। এ সবই ক্লাসিক রীতি। নবীন চন্দ্র সেনের 'ত্রয়ী' মহাকাব্য — ‘রৈবতক-কুরুক্ষেত্র-প্রভাস'। রৈবতকে সূচনা, কুরুক্ষেত্রে বিকাশ এবং প্রভাসে সমাপ্তি। তিন খন্ড কাব্য তিনটি লীলার সমন্বয়। প্রথমে আছে আদিলীলা, দ্বিতীয়ে মধ্যলীলা এবং শেষেরটিতে অন্তিম লীলা। ভাবতারা শ্রীকৃষ্ণ এ মহাকাব্যের নায়ক। বিষয়বস্তু নিঃসন্দেহে ক্লাসিক। ধর্ম, বিজ্ঞান ও ইতিহাস চেতনার সমন্বয়ে প্রাচীন আদর্শবাদ ‘আর্য-জাগৃতি' ঘটনার ক্রমাবর্তনে মানবমহিমার মহাস্বর্গে উপনীত। ভাগবত গীতা, মহাভারত, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণ চরিত্র' প্রভৃতি পূর্বাপর ও প্রাচীন ঐতিহ্যজাত ভাবপ্রেরণাকে তিনি ইউরোপীয় রেনেসাঁর মানবতাবাদী মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন। রচনারীতির ক্লাসিক সংযম লিরিকের উচ্ছ্বাসে অনেক ক্ষেত্রেই বাঁধনহারা। মহাকাব্যের যুগ শেষ, শেষ হয়েছে আখ্যান কাব্যেরও। এ যুগ ছোটো কবিতার। প্রাচীন ক্লাসিক রীতির ছাপ বহনকারী কবিতা প্রারই রচিত হয় না, হলেও তা ব্যতিক্রমী। মোহিতলাল মজুমদারের ‘পান্থ' কবিতাটিও এ ধরনের ব্যতিক্রমী উদাহরণ। শোপেন হাওয়ার-এর দুঃখবাদ ও নারীবিদ্বেষী মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে 'পান্থ’রূপী মোহি লাল কল্লোলে আত্মঘোষণা করে বললেন,
“সুন্দরী সে প্রকৃতিরে জানি আমি মিথ্যা সনাতনী সত্যেরে চাহি না তবু সুদূরের করি আরাধনা”। কখনও বা হইটম্যানের মতোই দৃঢ় প্রত্যয়ী কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “সত্য শুধু কামনাই—মিথ্যা চির মরণ-পি-লা- দেহহীন, স্নেহহীন, অশ্রুহীন বৈকুণ্ঠ স্বপন যমদ্বারে বৈতরিণী, সেথা নাই অমৃতের আশা
ফিরে ফিরে আসি তাই, ধরা করে নিত্য আমন্ত্রণ।”
এ দৃঢ়প্রত্যয়ী কণ্ঠ, এই আত্মঘোষণা—ক্লাসিক কবির জীবন দর্শন।
0 Reviews