কবির প্রেরণা : Inspiration of the Poet

কবির প্রেরণা : Inspiration of the Poet

Size

Read more

 


কবির প্রেরণা : Inspiration of the Poet


কবির মনে ভাব, আবেগ ও অনুভূতির উদ্ভব হয় যখন তিনি কোন এক বিশেষ বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। শব্দ, ইমেজ, অলঙ্কার, ছন্দ এবং স্টাইলের মধ্য দিয়ে যে কবিতা তিনি রচনা করেন, তার সবটাই যে সজ্ঞান প্রচেষ্টা এবং শিল্পমনস্কতা (Conscious effort and craft) এমনটা তারা অনেকেই মানতে চান না। তাঁরা মনে করেন যে কবিতার অনুভূতি যতই প্রত্যক্ষ হোক না কেন, এর মধ্যে এমন অনেক সত্য আছে যা অন্য জগত হতে আগত। যাঁরা ধর্মবোধ ও আধ্যাত্মিক চেতনা সম্পন্ন তাঁরা বলেন এ এমন এক দৈবীপ্রেরণা যা বিশেষ জনের কাছে বিশেষ মুহূর্তে উপস্থিত হয়। সুপার হিউম্যান গুণবিশিষ্টতার মধ্যে ঐশ্বরিক অবদানই শেষ কথা। এই অবদান ব্যতিরেকে যে কেউ দক্ষ হতে পারে, কিন্তু প্রতিভা সম্পন্ন হয় না। প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তিরা (যার মধ্যে কবিও আছেন) দৈব নির্দিষ্ট কোন বিশেষ কাজ করার জন্যই ঈশ্বর প্রেনিত দূতের মত ধরাধামে আসেন। (The breath of the god or God blown into the recipient Poet who becomes the vehicle of godhead)

পাশ্চাত্যে হেলেণিক ও হেব্রাইক কালচার হতে আগত ধারা খ্রিশ্চান ধর্মের মধ্যে পরিমার্জিত হয়েছে এবং সেই ধারাই রূপান্তরিত হয় আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে। এ যুগেও এমন অনেকেই আছেন যাঁরা মনে করে। সৃষ্টি কর্মে সজ্ঞান প্রচেষ্টার অধিক এমন একটা ক্ষমতার প্রভাব বর্তমান যার বুদ্ধির দ্বারা কোন ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। মহাকবি হোমার তাঁর মহাকাব্যে দেবদেবীদের সাহায্য প্রার্থনা করেছেন (Invocation) এবং অমর মহাকাব্য সৃজনে ‘Musc'-এর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করতো ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণে কবি এমন এক তুরীয় আনন্দলোকে (transcendent ecstasy or frenz: ) প্রবেশ করেন যা ‘Poetic madness' অভিধায় চিহ্নিত করা হয়। ওডিসি মহাকাব্যে (22.347.- 48) গায়ক ফেমিয়াস স্বীকারোক্তি করেছে যে ঈশ্বর তার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত বলেই সে দেবতার ভূমিকায় তাঁর মহিমা কীর্তন করে (and methinks I sing to thee as a god) / হেসিয়ড, পিন্ডার, থিয়োক্রেটাস সকলেই দৈবী শক্তির কথা বলেছেন। প্লেটো তাঁর 'Bon'- এ বলেছেন যে লোহা যেমন চুম্বকের দ্বারা চুম্বকায়িত হয়, কবিও সে রকম দৈবী প্রেরণার দ্বারা অনুপ্রাণিত হন (as Iron filings become magnetized by the magnet, so the Poet is inspired through divine power)। সক্রেটিসও আয়নকে একই কা বলেছেন। 'শক্তি' শিল্পকর্মের দক্ষতা নিরপেক্ষ এক দৈবী শক্তি। প্লেটোর শিষ্য আরিস্টেটিন। গুরুর কথাই মেনে নিয়েছেন (Poetics : el etoric 3.7)। তবে এ ব্যাপারে নিরাসক্ত হয়েই তিনি এর একটা ‘organic explanation' নি 'the four humors'-এর মাধ্যমে।

ভার্জিল, দান্তে, ওভিড, মিল্টন প্রমুখ মহাকবিরাও দৈবী প্রেরণার কথা উল্লেখ করেন। অনেকেই এই স্মরণকে আনুষ্ঠানিক বলে করেন। তবে মহাকাব্যের বিশালতা অতিক্রমণের দুঃসাধ্যতা স্মরণ করেই তাঁরা হয়তো দৈবী প্রেরণার কথা বলে থাকবেন। তবে সমালোচক ...longinus তাঁর 'Theory of sublime'-এ 'divinity'-র কথা উল্লেখ করেছেন। Cicero তাঁর সমালোচনা গ্রন্থে বলেছেন 'no nan was ever great without divine Inspiration'। হেব্রাইক পোয়েটিক্সে কবিকে প্রফেটের সমতূল্য জ্ঞান করা হয়েছে এবং খ্রীস্টানধর্মে গ্রীক ও রোমান Muse, দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছে।

কিন্তু এ সবই মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণা। আধুনিক যুগে আধুনিক বিজ্ঞানের জয়য এবং অষ্টাদশ শতকে গনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ জাত প্রভাবে প্রেরণা বা inspiration-এর ধারণাটাই বদলে গিয়ে subconscious mind-এর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। Psychology এবং Psychoanalysis পদ্ধতি অনুসারে এর প্রবক্তারা দাবি করেন যে পূজন প্রক্রিয়ার (Creative activity) মূলে রয়েছে unconscious এবং subconscious- এর টানাপোড়েন। Freud ও তাঁর Psychological criticism-এ একথা প্রমাণ করেছেন। এছাড়াও সমাজবাদীও মার্কসবাদী সমালোচকেরা বলেন যে ভৌগলিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের দ্বারা কবিতার উপকরণ সমূহ নিয়ন্ত্রিত হয় এবং কবির প্রেরণা বা উদ্দীপনা সেই নিয়ন্ত্রণ হতে উদ্দীপকের দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়। যাইহোক, অষ্টাদশ শতাব্দীর নিওক্লাসিসিস্টরা দৈবী প্রেরণাকে নস্যাৎ করে—কবির প্রেরণাকে enthusiasm বলে দাবী রলেও উনবিংশ শতকে রোমান্টিক কবিতার পথিকৃৎরা কবির প্রেরণার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং পরোক্ষভাবে দৈবী প্রেরণাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এডওয়ার্ড ইয়ং তাঁর 'Conjectures of original composition'-এ, কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর The Recluse এর উপসংহারে, কোলরিজ তাঁর কবিতা 'Kubla Khan' এর উদ্ভব সম্পর্কে, পো এর ‘Poetic principle'-এ, ইমার্সসন এর ‘The poet' কবিতায় এবং শেলীর ‘Defence of poetry' এবং 'ode to the west wind' কবিতায় এবং টমাস বাট কে লেখা কবি ব্লেকের চিঠিতে দৈবী প্রেরণার কথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। শেলী তাঁর ‘Defence of Poetry'-তে স্পষ্টই বলেছেন, 'Poetry is indeed something divine'। তিনি আরও বলেছেন 'The power arises from within'। ব্লেকও এমনই বলেছেন, 'I have written this poem from immediate dictation, 12or sometimes 20 or 30 lines at a time without premeditation and even against my will' এমনকি কবি মিল্টন তাঁর 'Paradise Lost'-এ যে Muse-এর কথা বলেছেন তা সম্ভবত 'a source of enlightenment' Protestant C inner light Ten Command- ments' হতে প্রাপ্ত Moses-এর উদ্দীপনার সঙ্গে সমতুল্য। তবে শেলী Prometheus t hound'-এর ভূমিকায় Mythology of Romanticism-কে inspiration বলেছেন এবং ব্লেকও স্বীকার করেছেন যে 'witheat practice nothing can be accomplished' | Craft বা শিল্পশৈলী কিছুটা অভ্যাসজাত যাকে হোরেস বলেছেন 'the labor of thefile'। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রচেষ্টায় কৌশল আয়ত্বকরণ, শিক্ষা ও স্মরণশক্তি। প্রেরণা এসবেরই ফলশ্রুতি তা কবির মনে আসে অস্পষ্ট একটা ধারণার মত হয়ে, যা কবির মনের অর্ন্তদৃষ্টিতে সুন্দররূপে ফুটে ওঠে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এই কথাটাই বলেছেন কবিতার মাধ্যমে, 'They flash upon the inward eye এবং তা হল 'Bliss of Solitude | অবশ্য রোমান্টিকেরা মনে করতেন যে প্রেরণা তাদের কাছেই আসে যারা জিনিয়াস। এই জিনিয়াসরা শুধুমাত্র Talented-ই নয়, আরও একটু মর্যাদা প্রত্যাশী। হ্যাজলিট ও চার্লস ল্যাম্ব Genius ও Talented এই দুটি বিষয়ের উপর আলোচনাও করেছেন।

হেগেলের দার্শনিক তত্ত্ব, মার্কসবাদীদের বিশ্লেষণ এবং মনস্তাত্ত্বিকদের মনস্তত্ত্বমূলক ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে পরবর্তীকালে যে সুররিয়ালিজম তত্ত্ব গড়ে উঠেছে, তাতে বলা হয়েছে যে কবির প্রেরণা তাঁর অবদমিত বাসনার মধ্য হতে উদ্ভূত হয়। এই অবদমিত বাসনা হল কবির স্বপ্রকাশের ইচ্ছা, বিভিন্ন স্মৃতি ও জীবনের স্বপ্ন— এসবের একটা মিশ্রণ। এই মিশ্রণকে পর্যালোচনা করলেই কবি বা সমালোচক যে কেউই প্রেরণার মূলীভূত কেন্দ্রবিন্দুটিকে ধরতে পারবেন। সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যে সামাজিক মানুষ রূপে কবির মানসজগতে যেসব দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়, সেই দ্বন্দ্বও কবিমনে প্রেরণার সঞ্চার করে। সুররিয়্যালিষ্টদের সঙ্গে রোমান্টিকদের পার্থক্য একটাই। রোমান্টিকেরা যাকে দৈব বলে চালাতেন, সুররিয়্যালিষ্টরা তার বৈজ্ঞানিক ও মনস্তত্বমূলক ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই কবি রবীন্দ্রনাথ ও কোলরিজ উভয়েই প্রেরণা সম্পর্কে প্রায় এক ধরণের বিবৃতি দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতির পাতায় প্রভাত সঙ্গীতের অন্তর্গত ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' কবিতার জন্ম মুহূর্তের বর্ণনায় বলেছেন যে সদর স্ট্রীটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি যখন সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করছিলেন সেই সময় 'এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল। দেখিলাম, একটি অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন, আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত। আমার হৃদয়ের স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদন ছিল তাহা এক নিমেষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল'।

কোলরিজ ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগেই একটি গ্রন্থের 'কুবলা খান' অধ্যায় পাঠ করছিলেন। ঘুমের মধ্যেই তিনি কুবলা খান-এর প্রাসাদ সম্পর্কিত দু-তিনশো পংক্তির কবিতা রচনা করে ফেলেছেন। স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে চুয়ান্ন পংক্তি লেখার পরই তাঁকে কর্মান্তরে যেতে হয়। তাই অবশিষ্ট পংক্তিগুলো আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। মুররিয়্যালিষ্টরা এর একটা ব্যাখ্যা করেছেন। স্বপ্নের ঘোরে তিনি কবিতার যেটুকু লিখেছেন তা নিজ্ঞান স্তরের কাজ যা জাগ্রত চেতনার দ্বারা বিঘ্নিত হয়েছে। জাগ্রত চেতনায় প্রেরণার স্বপ্রকাশের রেশ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

কবির মনে এইসব স্বপ্ন, দ্বন্দ্বের আবেগ, স্মৃতি কখন যে প্রেরণা রূপে আবির্ভূত হবে, তার কোন বাধা ধরা নিয়ম নেই। কোন নিয়মনীতি ও প্রচলিত পথ ধরে প্রেরণা আসা

যাওয়া করে না। তাই জীবনানন্দ বলেছেন,

'তুমি কাজ করে যাও, ওগো শক্তি, তোমার মতন

আমারে তোমার হাতে একাকী দিয়েছি আমি ছেড়ে।'—অনেক আকাশ/ধূসর পাণ্ডুলিপি

প্রেরণা তাই ‘Less systematic, less direct or simply occasional'। ফ্রয়েড ‘external divinity'-কে 'internal Psyche' পর্যায়ে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা সত্ত্বেও 'the mystery of the process of Production itself was not thereby lessened'. বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না—এমন অনেক কিছুই থেকে যায়—যাকে দৈব বা অলৌকিক বলা ছাড়া উপায় নেই।


0 Reviews