শিশুপাল বধ

শিশুপাল বধ

Size

Read more

  শিশুপাল বধ

শিশুপাল ছিলেন চেদি বংশের রাজা দম ঘোষ এবং বসুদেব ও কুন্তীর বোন শ্রুতস্রবার পুত্র। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভায় যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের সময় বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শিশুপাল দুর্ব্যবহার এবং অপমানজনক কথাবার্তা বলেছিলেন। তাঁর অপরাধ যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন শ্রীকৃষ্ণ সুদর্শন চক্র দিয়ে শিশুপালকে বিনাশ করেন। চেদি রাজ্যের রাজা হওয়ার কারণে শিশুপাল চৈদ্য নামেও পরিচিত ছিলেন। শিশুপাল এবং তার মাসতুতো ভাই দন্তবক্র উভয়ে ছিলেন শ্রীবিষ্ণুর গোলকধামের দুই দ্বাররক্ষী যথাক্রমে জয় ও বিজয়। যাঁদের মর্ত্যলোকে তৃতীয় এবং শেষ জন্ম বলে বিশ্বাস করা হয়।

মহাভারতের সভাপর্বে ৩৫-৪৫তম অধ্যায়ে শিশুপাল বৃত্তান্ত আলোচিত আছে। শিশুপাল যখন চেদি বংশে জন্মেছিলেন তখন তার তিনটি চক্ষু ও চারটি হাত ছিল। জন্মানোর পর থেকেই এই শিশু গাধার মতো চিৎকার করতো। তার এই অদ্ভুত আচরণ দেখে আত্মীয়-স্বজন সকলে শিশুপালকে পরিত্যাগ করার কথা ভাবছিলেন। তখন আকাশ থেকে দৈববাণী শোনা গেল— “ভয় পেয়ো না, নিশ্চিন্ত মনে এই বালককে লালন-পালন কর।”

এই কথা শুনে শিশুপালের মা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। তিনি করজোড়ে বলতে লাগলেন— “যিনি এই কথাগুলি বললেন, তিনি স্বয়ং ঈশ্বর, দেবতা বা আর যেই হোন, আমি তাঁকে প্রণাম জানাই। সেইসঙ্গে তাঁর কাছে এটিও জানতে চাই, আমার পুত্রের মৃত্যু কার হাতে হবে ?”

তখন দ্বিতীয়বার দৈববাণী শোনা গেল— “যার ক্রোড়ে উঠলে তোমার পুত্রের অতিরিক্ত দুটি হাত খসে পড়বে। এবং তৃতীয় চক্ষুটি বিলুপ্ত হবে, তার হাতেই তোমার পুত্রের মৃত্যু ঘটবে।”

দৈববাণীটি খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবী জুড়ে রাষ্ট্র হয়ে গেল । এমন বিচিত্র-দর্শন শিশুকে 

সমগ্র ত্রিলোকে পূজনীয় । তাই এত প্রধান-প্রাজ্ঞ ব্যক্তি এই সভায় থাকা সত্ত্বেও আমরা শ্রীকৃষ্ণের পূজা করে গর্ববোধ করছি। আমি আমার সুদীর্ঘ জীবনে অনেক বড় বড় বিদ্বান-পণ্ডিতদের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাঁদের কাছ থেকে পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের দিব্য গুণাদির বর্ণনা শুনেছি। ব্রাহ্মণদের মধ্যে যিনি জ্ঞানবৃদ্ধ, তিনি পূজার্হ। ক্ষত্রিয়দের মধ্যে যিনি শক্তিমান, তিনি পূজনীয়, বৈশ্যদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে ধনী তিনি সম্মাননীয় এবং শুদ্রকূলে সবচেয়ে বয়স্ক বা প্রবীণ ব্যক্তিই পূজা পাওয়ার যোগ্য হন।

শ্রীকৃষ্ণ পূজিত হওয়ার পেছনে যে কারণগুলি আছে তা আর কার আছে ? তিনি বেদবেদাঙ্গে পারঙ্গম এবং শ্রেষ্ঠ মহাবলী। তিনি একাধারে ঋত্বিক, গুরু, স্নাতক, আত্মীয়-সম্বন্ধী এবং প্রিয় পাত্র। কৃষ্ণই বিশ্ব চরাচরের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় কর্তা। মন, বুদ্ধি, মহত্ব ইত্যাদি পঞ্চভূত শ্রীকৃষ্ণের মধ্যেই অধিষ্ঠিত। চন্দ্ৰ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, দিক- সমূহ সবই কৃষ্ণে প্রতিষ্ঠিত। বেদ চতুষ্টয়ের অগ্নিহোত্র। ছন্দের গায়ত্রী, মনুষ্যদের রাজা, নদীর সাগর, নক্ষত্রমণ্ডলীর চন্দ্র, তেজঃ পদার্থের আদিত্য, সমস্ত পর্বতের সুমেরু, বিহঙ্গ জাতির গরুড় প্রভৃতির মুখ হলেন কৃষ্ণ। ”

বৈশম্পায়ন বললেন— “মহাবলী ভীষ্ম এভাবে শ্রীকৃষ্ণের স্তুতি করে ক্ষান্ত হলেন । তখন সহদেব বললেন, ‘কেশব পরাক্রমী, বলশালী। আমরা তাঁর অর্চনা করেছি। তাঁকে যিনি সহ্য করতে পারেন না, তাঁকে আমি গ্রাহ্য করি না। যাঁরা বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ তাঁরা সকলে কৃষ্ণের বন্দনা করেন।”

নারদ ঋষি তখন বললেন- “যাঁরা পদ্ম-পলাশ-লোচন শ্রীকৃষ্ণকে পূজা করা পছন্দ করেন না, তাঁরা জীবনৃত, নরাধম। তাঁদের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে নেই।”

এদিকে কৃষ্ণ পূজিত হচ্ছেন দেখে সুনীথনামা নামে এক বীর পুরুষ ক্রোধোন্মত্ত হয়ে উপস্থিত রাজাদের উদ্দেশে বললেন— “আমি আগে সেনাপতি ছিলাম। এখন যাদব ও পাণ্ডবদের মূলোৎপাটন করার জন্য এখুনি তাদের যুদ্ধে আহ্বান করছি।”

সেই সুযোগে চেদিরাজ শিশুপাল অন্যান্য রাজাদের যজ্ঞের ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য উৎসাহ দিতে লাগলেন। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক বা কৃষ্ণ পূজা যাতে না হয় তার জন্য বিক্ষুব্ধ রাজাদের সংঘবদ্ধ করতে লাগলেন। সভা মধ্যে তখন হঠাৎ যেন একটা যুদ্ধের আবহ তৈরি হলো। যজ্ঞ সম্পন্ন করতে গিয়ে হঠাৎ করে তখন কেমন যেন ছন্দ পতন। এমন পরিস্থিতি দেখে যুধিষ্ঠির বিচলিত হলেন। তিনি প্রাজ্ঞ ভীষ্মকে বললেন— “হে পিতমহ! এই যজ্ঞানুষ্ঠান হঠাৎ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। এখন আমার কি করা উচিত। দয়া করে বিধান দিন।”

ভীষ্ম বললেন— “যুধিষ্ঠির! ভয় পেয়ো না। কুকুর কখনো সিংহকে হত্যা করতে পারে না। সিংহ ঘুমিয়ে থাকলে কুকুরের দল জড় হয়ে যেমন চীৎকার করে তেমনি বৃষ্ণিসিংহ বাসুদেবের সামনে এরা চীৎকার করছে। সিংহের ন্যায় অচ্যুত (শ্রীকৃষ্ণ) যতক্ষণ না জেগে উঠছেন ততক্ষণ চেদিরাজ এই রাজাদের সিংহ ভেবে তাতানোর চেষ্টা করছেন। আমার বিশ্বাস নারায়ণ শিশুপালের এই তেজ অচিরেই হরণ করবেন। শিশুপাল সহ এই সব অর্বাচীন রাজাদের মতিচ্ছন্ন হয়েছে।”

ভীষ্মের এইসব চেদি-বিরোধী কথা শুনে শিশুপাল বললেন— “ভীষ্ম রাজাদের এইভাবে ভয় দেখিয়ে তোমার লজ্জা হচ্ছে না। জানি, তুমি বৃদ্ধ হয়েছো, তাই বলে তোমার কুলে কলঙ্ক লাগাবে ? এখানে বহু প্রবীণ ব্যক্তি আছেন, তাঁদের সামনে তোমার ধর্মসঙ্গত কথাবার্তা বলা উচিত। তুমি অবিবেচকের মতো অহঙ্কারী এই কৃষ্ণের জয়গান করছো ? এর ফলে তোমার জিভ কেন শত-টুকরো হচ্ছে না ? যাকে সামান্য বালকেরাও ঘৃণা করে, তুমি জ্ঞান-বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সেই গোপালের প্রশংসা করছো ? ও যদি বাল্যকালে কোনো পাখি (বকাসুর), ঘোড়া (কেশী) কিংবা কোনো বলদকে (বৃষভাসুর) বধ করে থাকে— তাতে গর্বিত হওয়ার কি আছে ? ও যদি কোনো অচেতন গাড়িকে (শকটাসুর) পা দিয়ে উল্টে দিয়ে থাকে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ও নাকি উই ঢিবির মত একটি (গোবর্ধন পর্বত) পর্বতকে সাতদিন ধরে তুলে রেখেছিল— তা কি এমন বিস্ময়কর কোনো ঘটনা ? তবে হ্যাঁ, ঐ পর্বতের উপর সাতদিন ধরে ঐ পেটুক যে ভুরিভোজন করেছিল তা শুনে রাখাল বালকেরা পর্যন্ত অবাক হয়েছিল। ঐ দূরাত্মা কংসের অন্ন খেয়ে বড় হয়েছে, কিন্তু প্রতিদান হিসাবে তাকে বধ করে হিসাব মিটিয়েছে। এমন অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে পূজা করা তোমার মানায় না।

হে কুরুকুলাধম ভীষ্ম! তুমি অধার্মিক, তাই তোমাকে কিছু উপদেশ দিচ্ছি, মন দিয়ে শোনো।

সাধু ব্যক্তিরা উপদেশ দিয়ে থাকেন যে- স্ত্রী, গোরু, ব্রাহ্মণ, অন্নদাতা এবং আশ্রয়দাতার উপর আক্রমণ বা আঘাত করা উচিত নয়। তা যদি হয়, তুমি এবার বিচার কর এই স্ত্রী’হত্যাকারী (পুতনা) ও গোহত্যাকারীকে কিভাবে পূজা করা যায় ?

তোমার কথাবার্তা অসহ্য হলেও তোমাকে বিশেষ দোষ দিতে চাই না। তুমি আসলে একজন স্তাবক ও চাটুকার । অধার্মিক এবং বিপথগামী। তুমি যাদের মন্ত্রী এবং কৃষ্ণ যাদের পূজনীয় সেই পাণ্ডবেরা যে দূষিত ও মন্দ স্বভাবের হবে তাতে সন্দেহ কী ? তুমি ধর্মের নামে যে সব অধর্ম করেছো তা অত্যন্ত মন্দরুচির পরিচয়। ধর্মাত্মা কাশীরাজের কন্যা অন্যের প্রতি অনুরক্তা ছিলেন। তুমি তাকে জোর করে হরণ করেছিলে কোন যুক্তিতে ? তোমার ভ্রাতা সৎ ছিলেন, তাই তিনি তোমার হরণ করা কন্যাকে কামনা করলেন না। তুমি এমনই ধার্মিক যে তোমার সামনেই তাঁদের গর্ভে অন্যের দ্বারা সন্তান গর্ভস্থ হয়েছিল। হে ভীষ্ম! তুমি ভেবো না যে তুমি ব্রহ্মচর্য নিয়েছিলে বলে এমনটি হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, তুমি যে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেছিলে তা মোহবশত, এবং ক্লীবত্বের মতো। তুমি দেখাতে পারবে যে তোমার দ্বারা সত্যি সত্যি কোনো উন্নতি সাধিত হয়েছে ? ইষ্ট সাধনা, দান-ধ্যান, অধ্যয়ন, যজ্ঞানুষ্ঠান— এগুলি পুত্রলাভের ফলে যে পুণ্য অর্জিত হয় তার ষোলো ভাগের একভাগও নয়। অপুত্রক ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত যে কোনো শুভ অনুষ্ঠানই বিফলে যায়।”

শিশুপাল এতক্ষণ ভীষ্মকে আক্রমণ করার পর এবার কৃষ্ণকে উদ্দেশ করে তার তির্যক বাক্যবাণগুলি ছুঁড়তে লাগলেন। তিনি পুনরায় বললেন— “জরাসন্ধ একজন মহাবলী রাজা ছিলেন। তিনি কৃষ্ণকে দাস বলে তাঁকে হত্যা করেন নি। কিন্তু এই কৃষ্ণ জরাসন্ধকে হত্যা করার জন্য ভীম ও অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রটি করেছিল, তা কি যথার্থ ছিল ? এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, তোমার পরামর্শে পাণ্ডবরা কর্তব্যচ্যুত হচ্ছে। আর তা হবে না-ই বা কেন, তোমার মতো নপুংসক কোনো বুড়ো যদি তাদের পরামর্শদাতা হয়, তাহলে এমনটি হতে বাধ্য।”

এতক্ষণ পর্যন্ত দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেন শিশুপালের এই তির্যক মন্তব্যগুলি শুনছিলেন। কিন্তু এখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। তাঁর চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। সভায় উপস্থিত সকলে দেখলেন যে, তিনি প্রলয়কালীন কালের মতো দাঁতে দাঁত ঘষছেন। এবং শিশুপালকে আক্রমণ করতে উদ্যত হচ্ছেন। তা দেখে পিতামহ ভীষ্ম ভীমকে বাধা দিলেন।

কিন্তু শিশুপাল তাতেও নিজের অবস্থান থেকে এতটুকু সরলেন না। একইভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি তখন হেসে ভীষ্মকে বললেন— “ওকে ছেড়ে দাও । সবাই দেখবে যে ও আমার ক্রোধের আগুনে পতঙ্গের মতো পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।” যাইহোক, পিতামহ ভীষ্ম শিশুপালের কথায় আর কান দিলেন না । ভীমকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিরস্ত করলেন।

এতকিছু করেও যখন শ্রীকৃষ্ণকে হেয় প্রতিপন্ন করা গেলো না, তখন শিশুপাল বাসুদেবকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করলেন। তিনি প্রকাশ্য সভায় 'যুদ্ধং দেহি' মনোভাব নিয়ে বললেন- “হে জনার্দন! আমি তোমাকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করছি। এসো, তুমি ও পাণ্ডবদের একসঙ্গে যমালয়ে পাঠাই। ওহে কৃষ্ণ! তুমি রাজা নও। তুমি একজন

দাস। তুমি পূজা পাওয়ার অযোগ্য। পাণ্ডবেরা যোগ্য রাজাদের বাদ দিয়ে তোমার পূজা করেছে। তাই আমার মতে এই দুর্বলচিত্ত অনভিজ্ঞ পাণ্ডবদেরও বধ করা উচিত। এই বলে শিশুপাল ক্রোধের বশে তর্জন গর্জন করতে লাগলেন।”

শিশুপালের কথা শেষ হলে পাণ্ডবগণের সামনে উপস্থিত নৃপতিদের উদ্দেশে মধুর ভাবে শ্রীকৃষ্ণ বললেন— “হে রাজন্যবর্গ! এই দুরাত্মা আমাদের আত্মীয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সঙ্গে চিরকাল চরম শত্রুতা করে আসছে। আমি যখন প্রাগজ্যোতিষপুরে গিয়েছিলাম সেই সময় সুযোগ বুঝে এই নরাধম দ্বারকা নগরীকে আগুন জ্বালিয়ে দগ্ধ করেছিল। ভোজরাজ যখন রৈবতক পর্বতে বেড়াতে গিয়েছিলেন, এই দুর্মতি তার লোকজনদের নিয়ে সেখানে গিয়েছিল। রাজার অনেক সঙ্গী-সাথীদের হত্যা করা ছাড়াও বেশ কয়েকজনকে বেঁধে নিজের রাজধানীতে নিয়ে এসেছিল। আমার পিতা যখন অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন এই পাষণ্ড তখন যজ্ঞ পণ্ড করার জন্য যজ্ঞের অশ্বটি অপহরণ করেছিল। যদুবংশীয় তপস্বী বক্রর পত্নী যখন সৌরদেশ যাচ্ছিলেন, এই পাপাচারী তখন তাঁকে বলপূর্বক অপহরণ করেছিল। তাঁর বোন ভদ্রা যখন করুষরাজের জন্য তপস্যা করেছিল, এই দুরাত্মা ছলনার দ্বারা নিজের রূপ পরিবর্তন করে তাঁকে হরণ করেছিল।

দীর্ঘদিন যাবৎ এই পশ্বাধম একটানা পাপকর্ম করে চলেছে। আমি কেবল পিসিমার কথা স্মরণ করে এখনও পর্যন্ত নীরবে মুখ বন্ধ করে সব অপকর্ম সহ্য করে চলেছি। কিন্তু আজ এই প্রকাশ্য সভায় উপস্থিত গুণীজন সহ নৃপতিবর্গের সামনে আমাকে এই পাষণ্ড যেভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করল, তা এক কথায় ক্ষমার অযোগ্য। মূঢ়মতি শিশুপাল যমালয়ে যাওয়ার জন্য এক সময় রুক্মিণীকেও প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু অপাত্রের বেদ শোনার ইচ্ছা যেমন বিফলে যায়, তেমনি এর সেই অভিলাষটিও অপূর্ণই থেকে গেছে।”

তখন সভায় উপস্থিত সকলে একবাক্যে শিশুপালের নিন্দা করতে লাগলেন। চেদিরাজ শিশুপাল এরপর অট্টহাস্য করতে করতে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন- “হে মাধব! তুমি এই জনপূর্ণ সভায় রাজাদের সামনে রুক্মিণীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে নিজেকে কি লজ্জায় ফেললে না ? তুমি ছাড়া এমন কোন অভিমানী পুরুষ আছে যে নিজের স্ত্রী'কে অন্যপূর্বা (স্ত্রী যদি পূর্বে অন্য কোনো পুরুষের বাগদত্তা হয়, বা অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ স্থির হয়েও যদি পরে বাতিল হয়) বলে স্বীকার করে ? তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে আমাকে যদি ক্ষমা করতে পারো, করো। তবে এটা জানবে তুমি আমার প্রতি ক্রুদ্ধ বা প্রসন্ন যাই হও, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”করেছিলে কোন যুক্তিতে ? তোমার ভ্রাতা সৎ ছিলেন, তাই তিনি তোমার হরণ করা কন্যাকে কামনা করলেন না। তুমি এমনই ধার্মিক যে তোমার সামনেই তাঁদের গর্ভে অন্যের দ্বারা সন্তান গর্ভস্থ হয়েছিল। হে ভীষ্ম! তুমি ভেবো না যে তুমি ব্রহ্মচর্য নিয়েছিলে বলে এমনটি হয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, তুমি যে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেছিলে তা মোহবশত, এবং ক্লীবত্বের মতো। তুমি দেখাতে পারবে যে তোমার দ্বারা সত্যি সত্যি কোনো উন্নতি সাধিত হয়েছে ? ইষ্ট সাধনা, দান-ধ্যান, অধ্যয়ন, যজ্ঞানুষ্ঠান— এগুলি পুত্রলাভের ফালে যে পুণ্য অর্জিত হয় তার ষোলো ভাগের একভাগও নয়। অপুত্রক ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদিত যে কোনো শুভ অনুষ্ঠানই বিফলে যায়।”

শিশুপাল এতক্ষণ ভীষ্মকে আক্রমণ করার পর এবার কৃষ্ণকে উদ্দেশ করে তার তির্যক বাক্যবাণগুলি ছুঁড়তে লাগলেন। তিনি পুনরায় বললেন— “জরাসন্ধ একজন মহাবলী রাজা ছিলেন। তিনি কৃষ্ণকে দাস বলে তাঁকে হত্যা করেন নি। কিন্তু এই কৃষ্ণ জরাসন্ধকে হত্যা করার জন্য ভীম ও অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রটি করেছিল, তা কি যথার্থ ছিল ? এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, তোমার পরামর্শে পাণ্ডবরা কর্তব্যচ্যুত হচ্ছে। আর তা হবে না-ই বা কেন, তোমার মতো নপুংসক কোনো বুড়ো যদি তাদের পরামর্শদাতা হয়, তাহলে এমনটি হাতে বাধ্য।”

এতক্ষণ পর্যন্ত দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেন শিশুপালের এই তির্যক মন্তব্যগুলি শুনছিলেন। কিন্তু এখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। তাঁর চক্ষু রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। সভায় উপস্থিত সকলে দেখলেন যে, তিনি প্রলয়কালীন কারোর মতো পাতে পীত পরছেন। এবং শিশুপালকে আক্রমণ করতে উদ্যত হচ্ছেন। তা দেখে পিতামহ ভীষ্ম চীনকে বাধা দিলেন।

কিন্তু শিশুপাল তাতেও নিজের অবস্থান থেকে এতটুকু সরলেন না। একইভাবে স্থির তার পাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি তখন হোসে ভীমকে বললেন- “ওকে ছেড়ে দাও। সবাই দেখাবে যে ও আমার ক্রোধের আগুনে পতঙ্গের মতো পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।” যাইহোক, পিতামহ ভীষ্ম শিশুপালের কথার আর কান দিলেন না। ভীমকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিরন্ত করালেন।

এতকিছু করেও যখন শ্রীকৃষ্ণকে হেয় প্রতিপন্ন করা গেলো না, তখন শিশুপাল বাসুদেবকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করলেন। তিনি প্রকাশ্য সভায় 'যুদ্ধং দেহি মনোভাব নিয়ে বললেন- “হে জনার্দন! আমি তোমাকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করছি। এসো, তুমি ও পাণ্ডবদের একসঙ্গে যমালয়ে পাঠাই। ওহে কৃষ্ণ! তুমি রাজা নও। তুমি একজন দাস। তুমি পূজা পাওয়ার অযোগ্য। পাণ্ডবেরা যোগ্য রাজাদের বাদ দিয়ে তোমার পূজা করেছে। তাই আমার মতে এই দুর্বলচিত্ত অনভিজ্ঞ পাওবাদেরও বধ করা উচিত। এই বলে শিশুপাল ক্রোধের বশে তর্জন গর্জন করতে লাগালেন।”

শিশুপালের কথা শেষ হালে পাণ্ডবগণের সামনে উপস্থিত নৃপতিদের উদ্দেশে মধুর ভাবে শ্রীকৃষ্ণ বললেন- “হে রাজন্যবর্গ। এই দুরাত্মা আমাদের আত্মীয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সঙ্গে চিরকাল চরম শত্রুতা করে আসছে। আমি যখন প্রাগজ্যোতিষপুরে গিয়েছিলাম সেই সময় সুযোগ বুঝে এই নরাধম মারকা নগরীকে আগুন জ্বালিয়ে দদ্ধ করেছিল। ভোজরাজ যখন রৈবতক পর্বতে বেড়াতে গিয়েছিলেন, এই দুর্নীতি তার লোকজনদের নিয়ে সেখানে গিয়েছিল। রাজার অনেক সঙ্গী-পরে হত্যা করা ছাড়াও বেশ কয়েকজনকে বোঁরে নিজের রাজধানীতে নিয়ে এসেছিল। আমার পিতা যখন অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন এই পাব তখন যজ্ঞ পণ্ড করার জন্য যজ্ঞের অহটি অপহরণ করেছিল। যদুবংশীয় তপস্বী বর পত্নী যখন সৌরাদেশ যাচ্ছিলেন, এই পাপাচারী তখন তাঁকে বলপূর্বক অপহরণ করেছিল। তাঁর বোন ভা যখন করুণারাজের জন্য তপস্যা করেছিল, এই দুরাত্মা ছলনার যাত্রা নিজের রূপ পরিবর্তন করে তাঁকে হরণ করেছিল।

দীর্ঘদিন যাবৎ এই পহাধন একটানা পাপকর্ম করে চলেছে। আমি কেবল পিসিমার কথা স্মরণ করে এখনও পর্যন্ত নীরবে মুখ বন্ধ করে সব অপকর্ম সহ্য করে চলেছি। কিন্তু আজ এই প্রকাশ্য সভায় উপস্থিত গুণীজন সহ নৃপতিবর্গের সামনে আমাকে এই পাষণ্ড যেভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করল, তা এক কথায় ক্ষমার অযোগ্য। মুচমতি শিশুপাল যমালয়ে যাওয়ার জন্য এক সময় রুক্মিণীকেও প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু অপাত্রের বেদ শোনার ইচ্ছা যেমন বিফলে যায়, তেমনি এর সেই অভিলাষটিও অপূর্ণই থেকে গেছে।"

তখন সভায় উপস্থিত সকলে একবাক্যে শিশুপালের নিন্দা করতে লাগলেন। চেদিরাজ শিশুপাল এরপর অট্টহাস্য করতে করতে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন- “হে মাধব! তুমি এই জনপূর্ণ সভায় রাজাদের সামনে রুক্মিণীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে নিজেকে কি লজ্জায় ফেললে না ? তুমি ছাড়া এমন কোন অভিমানী পুরুষ আছে যে নিজের স্ত্রী কে অন্যপূর্বা (স্ত্রী যদি পূর্বে অন্য কোনো পুরুষের বাগদত্তা হয়, বা অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ স্থির হয়েও যদি পরে বাতিল হয়) বলে স্বীকার করে ? তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে আমাকে যদি ক্ষমা করতে পারো, করো। তবে এটা জানবে তুমি আমার প্রতি রুদ্ধ বা প্রসন্ন যাই হও, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”ভগবান মধুসূদন, এরপর শিশুপাল বধের জন্য তার সুদর্শন চক্রটিকে স্মরণ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেটি তাঁর হাতে চলে এলো। তখন নৃপতিদের উদ্দেশে তিনি পুনরায় বললেন— “হে মহীপালগণ, আপনারা শুনে রাখুন, এই শিশুপালের মা পূর্বে আমার কাছে অনুরোধ করেছিলেন যে, আমি যেন তাঁর পুত্রের একশত অপরাধ ক্ষমা করি। আমি সেই অনুসারে তাঁকে কথা দিয়েছিলাম। এতদিন তা যত্নের সঙ্গে মেনে এসেছি। কিন্তু আজ তার একশত অপরাধ পূর্ণ হলো। তাই তাকে আর ক্ষমা নয়। আমি আপনাদের সকলের সামনে তাকে সংহার করছি।”

এই বলে অরাতিদমন মধুসূদন সুতীক্ষ্ণ চক্র দিয়ে শিশুপালের মাথা কেটে ফেললেন। দেখতে দেখতে সেই দেহ চক্রবিদ্ধ হয়ে ভূপাতিত হলো। উপস্থিত রাজারা সেই দৃশ্য দেখে বিস্মিত হলেন। জনার্দনের এই অলৌকিক কর্মকাণ্ড দেখে তাঁরা বাক্যহারা হলেন। কেউ কেউ এই কাজটির প্রকাশ্যে প্রশংসা করে কৃষ্ণের স্তব গান করলেন। কেউ আবার মনে মনে ক্রুদ্ধ হয়ে উদাসীন থাকলেন।

যাইহোক, যুধিষ্ঠিরের তৎপরতায় এরপর ভীমসেনের উদ্যোগে শিশুপালের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরে মহারাজ যুধিষ্ঠির শিশুপালের পুত্রকে চেদিরাজ্যের সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন।


0 Reviews