Read more
মহামুনি অগস্ত্যের অলৌকিক কর্মকাণ্ড
মহাত্মা অগস্ত্য মিত্রাবরুণের পুত্র ছিলেন পরম তেজস্বী, শ্রেষ্ঠ ঋষিদের মধ্যে অন্যতম । তাঁর জীবন নানান অলৌকিক কর্মকাণ্ডে ভরা। তিনি ভয়ংকর অসুর বাতাপিকে ধ্বংস করে ব্রাহ্মণদের স্বস্তি দিয়েছিলেন। তেমনি বিন্ধ্য-পর্বতের বাড়-বাড়ন্ত রোধ করে জগতের মঙ্গল করেছিলেন। একসময় ভয়ংকর দৈত্য কালকের এবং তার সহচরদের অত্যাচারে দেবতা এবং অন্যান্য মুনি-ঋষিদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। এই অসুরেরা সমুদ্রের গভীরে আশ্রয় নিয়েছিল বলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন দেবতাদের অনুরোধে মহাতপা অগস্ত্য মহাসাগরের সমস্ত জল পান করে কালকের ও তার সঙ্গী সাথীদের লোকচক্ষুর সামনে আনতে সাহায্য করেছিলেন। দেবতারা তারপর ঐ ভয়ংকর অসুরদের বিনাশ করতে পেরেছিলেন। এভাবে অগস্ত্যের জীবনকথা হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এবং বিস্ময়সৃষ্টিকারী।
ঋষি অগস্ত্য বেদের একজন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। ঋকবেদে কথিক আছে যে, ইনি মিত্র অর্থাৎ তেজোময় সূর্য ও বরুণের পুত্র। ঋষিশ্রেষ্ঠ অগস্ত্যের মহিমা প্রচুর। রাম বনবাসকালে যখন অগস্ত্যের আশ্রমে উপস্থিত হয়েছিলেন, তিনি তখন রামকে বৈষ্ণব ধনু, ব্রহ্মাস্ত্র এবং অক্ষর তৃণ দান করেছিলেন। তাঁর পরামর্শেই রাম গোদাবরী তীরে পঞ্চবটী বনে কুটির নির্মাণ করে বসবাস করছিলেন। রাজা নহুষ যখন দেবরাজ ইন্দ্রের স্ত্রী শচীকে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, ঋষি অগস্ত্য সেক্ষেত্রে নহুষকে শুধু নিরস্ত করেন নি, তাঁকে অভিশাপ দিয়ে তাঁর অগ্রগতি রোধ করেছিলেন। এছাড়াও তাঁর অলৌকিক বহু কর্মকাণ্ড আছে যা, জগতকে বহু সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ করেছিল। আলোচ্য গল্পে তারই কিছু মণিমুক্তা পরিবেশিত হলো।
গল্পটি মহাভারতের বনপর্বে ৯৭-১০৪তম অধ্যায়ে পাওয়া যায়।
ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে মুনিবর লোমশ মহর্ষি অগস্ত্যের অলৌকিক কর্মকাণ্ডময় জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলি বলতে গিয়ে বললেন- “সত্যযুগে
কালকের নামে যুদ্ধবাজ একদল অসুর ছিল। তারা বৃত্রাসুরকে তাদের অধিপতি বানিয়ে দেবতাদের উপর সর্বাত্মক আক্রমণ করেছিল। দেবতারা এই আকস্মিক আক্রমণে বেসামাল হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। দেবতাদের এভাবে উদ্ভ্রান্তের মতো দেখে শ্রী ব্রহ্মা তখন বললেন— “হে দেবগণ! আপনারা কেন আমার কাছে এসেছেন, তার কারণ আমি জানি। কিন্তু বৃত্রাসুরকে বধ করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তবে কিভাবে তাকে বিনাশ করা যাবে তার উপায় আমি আপনাদের বলছি, আপনারা সেইভাবে এগিয়ে চলুন। দধীচি নামে এক মহাতেজা উদার মহর্ষি আছেন। আপনারা তাঁর স্তুতিগান সহ বর প্রার্থনা করে বলবেন যে, আপনি জগতের মঙ্গলের জন্য আপনার শরীরের অস্থিগুলি প্রদান করুন। তিনি সেগুলি দিলে তা দিয়ে ছ কোণা এক ভয়ংকর বজ্র নির্মাণ করবেন। ঐ বজ্র প্রয়োগ করে বৃত্রাসুরকে বধ করা সম্ভব হবে।”
পদ্মযোনি ব্রহ্মার উপদেশ এবং আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে দেবতারা এরপর সরস্বতী নদীর অপর পারে দধীচি মুনির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। আশ্রমটি নানান সুশোভিত গাছপালা ও ফলফুলে পরিপূর্ণ, যা আক্ষরিক অর্থে দেবপুরীর মতো মনে হয়। মুনিবরের যথাযোগ্য স্তুতিগান ও অর্চনাদি করে দেবতারা প্রজাপতি ব্রহ্মার উপদেশ মত তাঁর কাছে অভীষ্ট বর প্রার্থনা করলেন।
মুনি দধীচি সত্যি-সত্যি উদার ও মহানুভব এক ঋষি। তিনি দেবতাদের প্রার্থনা শুনে প্রসন্ন চিত্তে বললেন- “হে অমরগণ! আমি নিজের প্রাণ দিতে মোটেই কুণ্ঠিত নই। সেই কারণে আমার অস্থিসকল জগতের কাজে এখনই অর্পণ করছি।”
এইবলে মুনিবর মন ও ইন্দ্রিয় সংযমের দ্বারা তখনই প্রাণত্যাগ করলেন। এরপর মুনিবরের প্রাণহীন দেহ থেকে দেবতারা সকল অস্থি সংগ্রহ করে বিশ্বকর্মার কাছে গেলেন এবং তাঁর কাছে বজ্র নির্মাণের অনুরোধ রাখলেন। বিশ্বকর্মা এরপর কাল- বিলম্ব না করে এক ভয়ংকর বজ্র নির্মাণ করে দেবরাজ ইন্দ্রকে বললেন- “হে পুরন্দর! এই ভীষণ বজ্রাস্ত্র প্রয়োগ করে আপনি বৃত্রাসুরকে সংহার করুন। তারপর নিশ্চিন্ত মনে রাজ্য শাসনে তৎপর হোন।”
বিশ্বকর্মার আশ্বাসবাণী শুনে দেবরাজ তখন সঙ্গী দেবতাদের নিয়ে স্বর্গ ও মর্ত্য জুড়ে বৃত্রাসুর বাহিনীর উপর প্রবল আক্রমণ শুরু করলেন। দেবতাদের এই আকস্মিক আক্রমণকে ব্যর্থ করার জন্য ভয়ংকর কালকেয় অসুরেরা নানান প্রাণঘাতী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তারা বৃত্রাসুরকে ঘিরে একাধিক সুরক্ষা বলয় তৈরি করে যুদ্ধ
শুরু করলো। যুদ্ধের এই পর্বে দেব সেনাবাহিনী অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ভয়ংকর বিক্রম ও তেজের সঙ্গে অসুর সংহার করতে লাগলেন। তাঁদের পরাক্রম ও রণচাতুর্য দেখে বৃত্রাসুর ক্রোধে সিংহনাদ করতে লাগল। তার হুঙ্কারে আকাশ, বাতাস, ত্রিভুবন দশদিক কেঁপে উঠলো। ইন্দ্রও সুযোগ খুঁজতে খুঁজতে উপযুক্ত সময়ে সেই ভীষণ বজ্রাস্ত্রটি বৃত্রাসুরের উপর প্রয়োগ করেলন। সেই অস্ত্রের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা বৃত্রাসুরের ছিল না। মুহূর্তের মধ্যে ঐ কালান্তক দৈত্যের প্রাণহীন দেহ এমনভাবে ভূপতিত হলো, যেমনটি পূর্বকালে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর হাত থেকে মন্দার পর্বত পতিত হয়েছিল। বাস্তবে বৃত্রাসুর নিধন সত্যি-সত্যি যে সম্ভব হয়েছে তা, দেবরাজ ইন্দ্র বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। দেবতারা সেই ভীষণাকার দৈত্যের প্রাণহীন, নিথর দেহ বারবার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে তবেই দেবরাজকে বললেন। তখন তিনি অসুর সংহার বিষয়ে আশ্বস্ত হলেন। স্বস্তি অনুভব করলেন।
দেবপক্ষে বৃত্রাসুর সংহার সকলকে চমৎকৃত ও আনন্দিত করেছিল। সকল দেবতা তখন দেবরাজ পুরন্দরের স্তুতি-গান করতে লাগলেন। অনেক দেবতা আবার তখন হীনবল অসুর সৈন্য বা তার নিকটজনদের নির্বিচারে সংহার করতে শুরু করলেন। ফলে দৈত্যকুল অনন্যোপায় হয়ে মাছ-হাঙ্গর ও অন্যান্য জলজ প্রাণী-পরিপূর্ণ সমুদ্র
জলে আত্মগোপন করলো।
কিভাবে এর প্রতিশোধ নেওয়া যায় ? কিংবা, দেবতাদের অহংকার কিভাবে খর্ব করা যায় ? – তার পন্থা-পদ্ধতি নিয়ে তখন তারা ভাবতে শুরু করলো। এরপর বিস্তর চিন্তাভাবনার পর তারা এই সিদ্ধান্তে এলো যে, সকল শক্তির উৎস হলো তপস্যা বা সাধনা। মুনি-ঋষিরা এই কাজেই নিজেদের সারা জীবন উৎসর্গ করে থাকেন। তাই তাদের সাধন-তপস্যা যদি বন্ধ করে দেওয়া যায় তাহলে জগৎ হীনবল হয়ে পড়বে। তাই প্রতিশোধ নিতে হলে পৃথিবীতে যত মুনি-ঋষি-তপস্বী-ধর্মাত্মা আছেন, তাঁদের বধ করতে হবে। তাঁদের মৃত্যু হলেই জগৎ শক্তিহীন ও দুর্বল হয়ে পড়বে। এইভাবে এক ভয়ংকর কূট-কৌশলের ভাবনা তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ সাগর জলে বসবাসকারী বিজিত দৈত্যদের ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় হিসাবে শেষ পর্যন্ত গৃহীত হলো।
লোমশ মুনি পুনরায় বললেন- “হে রাজন! এরপর কালকেয়গণ সাগরের জলে আশ্রয় নিয়ে ত্রিভূবন বিনাশে সচেষ্ট হলো। আক্রমণের সময় হিসাবে তারা রাত্রির অন্ধকারকে বেছে নিলো। তারা সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এসে আশেপাশের মুনি-ঋষিদের আশ্রম এবং তীর্থস্থানগুলিতে অতর্কিতে আক্রমণ ও সংহারলীলা চালাতে শুরু করলো। তাদের অত্যাচারের আঁচ বশিষ্ঠাশ্রম, চ্যবনাশ্রম, ভরদ্বাজ-আশ্রম প্রমুখ কীর্তিমান
পুণ্যাত্মাদের জ্ঞান-চর্চা তীর্থগুলিকে অচিরে ধূলিস্যাৎ করে দিল। দিকে দিকে তাদের অত্যাচার এমনভাবে বাড়তে থাকলো যে, চতুর্দিক তখন মুনি-ঋষিদের অস্থি-কঙ্কালে ভরে উঠলো।
এইভাবে কিছুদিন চলার পর পৃথিবীতে মুনি-ঋষিদের যাগ-যজ্ঞ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। ধর্মাত্মারা প্রাণ ভয়ে সবসময় আত্মগোপন করতে বাধ্য হলেন। কেউ কেউ নির্জন পার্বত্য গুহায়, কেউ আবার সমুদ্র থেকে বহু দূরে, নির্জন গোপন স্থানগুলিতে পালিয় গেলেন। এরই মধ্যে অনেক বীর পুরুষেরা সেই সব কালকেয়দের খুঁজে বের করতে তৎপর হলেন। কিন্তু যেহেতু তারা তখন মহাসাগরের জলে লুকিয়ে থাকতো, তাই তাদের খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো।
দেবতাগণ এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে একসময় দেবরাজ ইন্দ্রের পরামর্শ মতো ভগবান শ্রীমন্নারায়ণের শরণাপন্ন হলেন। তাঁকে ভক্তি অর্থে শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানিয়ে বললেন- “হে জগৎ প্রভু। আপনি এই জগতের পিতা, প্রতিপালক। আপনার কৃপায় এই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। ইতিপূর্বে এই সৃষ্টি বহুবার দুরাত্মাদের অত্যাচারে বিপন্ন হয়েছে। কিন্তু আপনি তাকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার ও রক্ষা করেছেন। তা করতে গিয়ে কখনো বরাহ রূপ, কখনো নরসিংহ রূপ, কখনো আবার বামন রূপ ধারণ করে আপনি আপনার মহিমা দেখিয়েছেন।
হে মধুসূদন । আপনি সকল কালে সকল প্রাণীর রক্ষা কর্তা। ত্রিলোকের কল্যাণের জন্য আজ আমরা আপনার কাছে সমবেত হয়েছি। এই বিপদ থেকে দেবতা, সাধারণ প্রজা এবং দেবরাজ ইন্দ্রকে রক্ষা করুন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করছি কে, বা কারা, যেন রাত্রে এসে ব্রাহ্মণদের ওপর নির্বিচারে হত্যালীলা চালাচ্ছে। আপনি জানেন ব্রাহ্মণরা না থাকলে জগতের যত শুভ-চিন্তা, শুভ-শক্তি অচিরেই বিলুপ্ত হবে। এই জগৎ এক ভয়ংকর নরকে পরিণত হবে।”
দেবতাদের কাতর আর্জি শুনে শ্রীমন্নারায়ণ বললেন- “হে দেবগণ! সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া ব্রাহ্মণ ও প্রজাকুলের উপর রাত্রিকালীন প্রাণঘাতী আক্রমণ সম্পর্কে আমি অবহিত আছি। বৃত্রাসুরের মৃত্যুর পর তার অনুগামী কালকেয়— দৈত্যরা এই সংহার লীলা চালাচ্ছে। তারা রাতের অন্ধকারে সমুদ্র গর্ভে থেকে গোপনে বেরিয়ে এসে তাদের অপকর্মগুলি করছে বলে কোন কিছুই প্রকাশ্যে আসছে না। ভয়ংকর কুমীর ও হাঙর অধ্যুষিত অঞ্চলে থাকার কারণে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা যাচ্ছে না। তাই আপনাদের উচিত এই মহাসমুদ্রকে শুষ্ক করা। আর এই কাজ একমাত্র মহামুনি অগস্ত্যের
পক্ষেই করা সম্ভব। তিনিই পারবেন সমুদ্রকে শুষ্ক করতে। সমুদ্র শুষ্ক হলে দুরাচারী দৈত্যদের সংহার করা সহজেই সম্ভব হবে। তাই আমার পরামর্শ হলো, আপনারা ঋষিশ্রেষ্ঠ অগস্ত্যের কাছে গিয়ে এই কাজে তাঁর সহায়তার জন্য প্রার্থনা করুন।”
শ্রীবিষ্ণুর পরামর্শমত দেবগণ তখন অগস্ত্য মুনির আশ্রমে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন মহাত্মা মিত্রাবরুণের সন্তান পরম তেজস্বী ঋষিশ্রেষ্ঠ অগস্ত্য অন্য ঋষিদের মাঝে বসে আছেন। তাঁকে দর্শন করে দেবগণ তাঁর স্তুতি বন্দনা করে বললেন- “হে ভগবান। আপনি পূর্বে রাজা নহয যখন ইন্দ্রকে বিতাড়িত করে দেবলোকের অধীশ্বর হয়ে সকলকে বিরক্ত করেছিলেন, সেই জগৎ-কণ্টক রাজাকে আপনি বিতাড়িত করে ইন্দ্রকে তাঁর সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। পর্বতরাজ বিন্ধ্যাচল সূর্যের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে যখন ক্রমশ মাথা উঁচু করছিলেন যাতে সূর্য দক্ষিণাবর্তে না যেতে পারেন; সেই সময় আপনার কৃপায় শাস্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আপনি সব সময় সকলের ইচ্ছাপূরণ করেন। আমরাও এখন আপনার শরণাপন্ন হয়েছি, দীনভাবে আপনার কৃপা পেতে চাইছি।”
বিন্ধ্যাচল কি কারণে তপনের প্রতি রুষ্ট হয়েছিলেন, সে নিয়ে যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলে মহামুনি লোমশ বললেন- “মহারাজ! সূর্য প্রতিদিন উদয় ও অস্তাচলে যাওয়ার সময় সুমেরু পর্বতকে প্রদক্ষিণ করতেন। তা দেখে বিন্ধ্যাচল একদিন বললেন- সূর্যদেব! আপনি প্রত্যহ যেভাবে সুমেরুকে প্রদক্ষিণ করেন, আমাকেও তেমনি প্রদক্ষিণ করুন।” প্রত্যুত্তরে সূর্যদেব বললেন- “আমার যাত্রাপথ আমি ঠিক করি না। জগতের সৃষ্টিকর্তা আমার এই যাত্রাপথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।”
সূর্যদেবের কথায় বিন্ধ্যাচল মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। বরং সূর্য ও চন্দ্রের যাত্রাপথে অন্তরাল তৈরি করার জন্য বিন্ধ্য হঠাৎ উচ্চতা বাড়াতে লাগলেন। তাঁর এই শিরোখানে বিচলিত হয়ে সকল দেবতা এসে পর্বতরাজকে নিরস্ত হতে অনুরোধ জানালেন। কিন্তু বিন্ধ্য তাঁদের কথায় কর্ণপাত করলেন না; যেভাবে বাড়ছিলেন, সেভাবেই বাড়তে থাকলেন। তখন দেবতাগণ অগস্ত্যাশ্রমে এসে মুনিবরকে সকল ঘটনা খুলে বললেন- “হে দ্বিজোত্তম! শুধুমাত্র ক্রোধের বশে বিন্ধ্যাচল সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রের গতিপথ রোধ করার এক ভয়ংকর সংকল্প নিয়েছে। আমরা সকলে তাঁকে ক্ষান্ত হতে অনুরোধ জানিয়েছি। কিন্তু তিনি অনড় আছেন। হে মহর্ষি! আমাদের বিশ্বাস এখন আপনিই পারেন তাঁকে প্রশমিত করতে। দয়া করে এর বিহিত করুন।”
দেবতাদের কাতর প্রার্থনা শুনে মহাতপা অগস্ত্য কালবিলম্ব না করে বিন্ধ্যাচলের
কাছে পৌঁছালেন। বললেন- “হে ভূধরবর। বিশেষ কারণে আমকে এখন দক্ষিণাবর্তে যেতে হবে। তাই তুমি আমাকে যাওয়ার জন্য পথ করে দাও। আর হ্যাঁ, আমি যতক্ষণ না ফিরে আসছি, ততদিন এভাবেই আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকো। বলা বাহুল্য, বিন্ধ্যাচল মুনিবরকে মাথা নুইয়ে সেই যে পথ করে দিলেন, তা আর তোলার সুযোগ তাঁর কোনো দিন হল না। কারণ মহাতপা অগস্ত্য সেই পথে আর ফিরে আসেন নি। এভাবেই 'অগস্তযাত্রা', অর্থাৎ অন্তিমযাত্রা রূপে সেই ঘটনা প্রবাদ বাক্যে ঠাঁই পেল। যাইহোক, এরপর দেবতাদের প্রার্থনা শুনে মুনিপ্রবর অগস্ত্য বললেন- “হে দেবগণ! আপনারা কি কারণে আমার কাছে এসেছেন, তা খুলে বলুন।”
দেবতারা তখন বললেন- “হে মহাত্মন। আপনি তো জানেন দুরাত্মা কালকেয়রা এখন সমুদ্রগর্ভে লুকিয়ে থাকে। রাতের অন্ধকারে সংগোপনে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে শত-সহস্র মুনি-ঋষি-মহাত্মাদের প্রাণ হরণ করছে। তাদের সংহার করার জন্য আপনি এই সাগরকে জলশূন্য করে দিন। আপনিই পারেন দেবতাদের এইকাজে একমাত্র সহায় হতে।”
ঋষি অগস্ত্য তখন বললেন- “ঠিক আছে। আমি আপনাদের সাহায্য করবো। জগতের মঙ্গলের জন্য সমুদ্র জলশূন্য করে দেব।”
এরপর মহামুনি সমুদ্রের তীরে এসে ধীরে ধীরে সমুদ্রের জল পান করে নিলেন। সমুদ্র জলশূন্য হলে দেবতাগণ বীর বিক্রমে নানারকম দিব্যাস্ত্রাদির সাহায্যে কালকেয়দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দেবতাদের এই আকস্মিক আক্রমণে দৈত্যকুল দিশেহারা হয়ে পড়লো। ইতিমধ্যে দেবতাদের মুহুর্মুহু অস্ত্রাঘাতে বহু দৈত্য যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা গেল। অনেকে আবার মুনিদের তপঃপ্রভাবে শক্তিহীন ও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লো। ক্রমে সকলে বিনষ্ট হতে থাকল। তার মধ্যে অল্প কিছু দৈত্য প্রাণভয়ে ভীত হয়ে পালিয়ে পাতালে গিয়ে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর ঋষি অগস্ত্যের এই অলৌকিক কর্মকাণ্ড দেখে ইন্দ্রাদি সহ সকল দেবতা তাঁর স্তব-স্তুতি করতে লাগলেন । বললেন- “হে লোকহিতৈষি! আপনি আমাদের ত্রাতা, বিধাতা, সবার কর্তা। আপনার কৃপায় দেবলোক ও নরলোক এক ভয়ংকর বিপদ থেকে রক্ষা পেল। এখন আমাদের অনুরোধ আপনার পান করা জল সমুদ্রগর্ভে ফিরিয়ে দিয়ে তাকে পরিপূর্ণ করুন।
মহর্ষি প্রত্যুত্তরে বললেন- “হে দেবগণ! সেই বারিরাশি আমি ইতিমধ্যে হজম করে ফেলেছি। আমার পক্ষে সেই জল আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আপনারা বিকল্প পথ ভাবুন।”
মহর্ষির কথায় দেবতাদের মধ্যে নিদারুণ হতাশা ও বিষণ্ণতা নেমে এল। সমবেত সকলে তখন চিন্তা করতে করতে বিষ্ণুকে সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মলোকে গেলেন। এবং ভগবান পদ্মযোনিকে সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন।
দেবতাদের আবেদন শুনে ব্রহ্মা বললেন- “আপনারা নিজ নিজ স্থানে ফিরে যান। আজ থেকে বহুবছর পরে রাজা ভগীরথ তাঁর পূর্বপুরুষদের উদ্ধাদের জন্য চেষ্টা করবেন। তখন সমুদ্র পুনরায় জলপূর্ণ হবে। এখন এ নিয়ে আর কোন কিছু না ভেবে বাড়ি যান। ভবিষ্যতে মর্ত্যলোক পুণ্যসলিলে পরিপূর্ণ হবে। সকলের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে।”
0 Reviews