ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কথা

ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কথা

Size

Read more

 ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির কথা

সাক্ষাৎ ব্রহ্মার সঙ্গে তুল্য মহাতপা, বিভাণ্ডক মুনি ছিলেন অত্যন্ত শুদ্ধচিত্ত এবং একজন তেজস্বী পুরুষ। কিন্তু দৈবক্রমে তিনিও একদিন উর্বশীকে দেখে স্নান করার সময় সংযম হারিয়ে ফেলেন। কামার্ত হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর জলের মধ্যেই বীর্য স্খলন হয়। এবং সেই জল খেয়ে একটি হরিণী গর্ভবর্তী হয়ে পড়ে। আসলে ঐ হরিণী ছিলেন অভিশাপ গ্রস্তা স্বর্গের এক দেবকন্যা। দৈব নির্দেশ এই ছিল যে, হরিণীটি একজন মুনিপুত্র প্রসব করে তবেই মুক্তিলাভ করবে। এইভাবে ঐ হরিণীর গর্ভে বিভাণ্ডক মুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের জন্ম হয়। বলাবাহুল্য, পিতার ন্যায় ঋষ্যশৃঙ্গও ছিলেন অত্যন্ত খ্যাতিমান, একজন সাধক- তপস্বী। তিনি জন্মাবধি তাঁর পিতা ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে দেখেন নি, বা চিনতেনও না। যাইহোক, এরপর বিধির নিয়মে সেই ঋষি কিভাবে অন্যতম ঋষিশ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁর দ্বারা যে সব অলৌকিক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হয়ছিল, সেইসব বিষয়ই আলোচ্য গল্পটির উপজীব্য।

এই সংক্রান্ত মূল আলোচনাগুলি মহাভারতের 'বনপর্বে ১০৯-১১২-তম অধ্যায়ে সংকলিত আছে।

বিভিন্ন মুনি-ঋষিদের গল্প বলতে বলতে মহর্ষি লোমশ বললেন- “হে ভরত নন্দন! এই পবিত্র জলধারাটি হ'ল কৌশিকী নদী। এর সামান্য দূরে মহাত্মা বিশ্বামিত্রের রমণীয় আশ্রম দেখা যাচ্ছে। ওখানে আবার বিভাণ্ডক (কাশ্যপ) মুনির আশ্রমও রয়েছে। সংযতেন্দ্রিয় মহামুনি ঋষ্যশৃঙ্গ তাঁর সন্তান। এই আশ্রমকে পুণ্যাশ্রমও বলা হয়। ভগবান ঋষ্যশঙ্গের তপস্যার এমনই মহিমা যে, একবার ঘোর অনাবৃষ্টির সময় তিনি বর্ষা আনিয়ে দিয়েছিলেন। সেই তেজস্বী ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির জন্ম হয়ছিল মৃগীর গর্ভে। তিনি লোমপাদ রাজ্যে একটি অদ্ভূত কাণ্ড করেছিলেন। তাঁর কৃপায় ঐ রাজ্যে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই কারণে সবিতা যেমন ব্রহ্মার হাতে তাঁর তনয়া সাবিত্রীকে সম্প্রদান করেছিলেন, তেমনি রাজা লোমপাদ তাঁর কন্যা শান্তাকে ভগবান ঋষ্যশৃঙ্গের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।”

যুধিষ্ঠির তখন প্রশ্ন করলেন— “ভগবান! কাশ্যপ পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের জন্ম কিভাবে হরিণীর গর্ভ থেকে হয়েছিল, তা জানতে ইচ্ছা করছে। মানুষের সঙ্গে পশুর যৌন সংসর্গ শাস্ত্র-বিরুদ্ধ, মর্যাদা হানিকরও। এক্ষেত্রে তা কিভাবে হয়েছিল ? দেবরাজ ইন্দ্র কি কারণে সামান্য এই বালকের ভয়ে বৃষ্টি ঘটিয়েছিলেন ? শুনেছি রাজকন্যা শান্তা অতীব সুন্দরী ছিলেন, তা সত্ত্বেও তিনি কেন এই হরিণাকৃতি ঋষিকে স্বামী রূপে বরণ করেছিলেন ? -দয়া করে যদি বলেন ?”

লোমশ মুনি প্রত্যুত্তরে বললেন- “মহর্ষি বিভাণ্ডক (কাশ্যপ) বাল্যকাল থেকে মহাহ্রদে কঠোর তপস্যা করছিলেন। বহুকাল পরে একদিন উর্বশীকে দেখে তাঁর বীর্য স্খলন হয়। এবং ঐ অবস্থায় তিনি স্নান করেন। ঐ সময় একটি হরিণী তৃষ্ণার্ত হয়ে জলপান করতে এসে জলের সঙ্গে ঐ বীর্যও খেয়ে ফেলে। তাতেই হরিণীর গর্ভ সঞ্চার হয়। বলাবাহুল্য, ঐ হরিণী পূর্বে এক দেবকন্যা ছিলেন। ভগবান ব্রহ্মা তাঁকে বলেছিলেন— ‘তুমি মৃগী হয়ে জন্মাবে এবং সন্তান প্রসবের পর তুমি অভিশাপ-মুক্ত হবে।' তাই বিধির অমোঘ বিধান অনুসারে মহাত্মা ঋষ্যশৃঙ্গের জন্ম হরিণীর গর্ভেই হয়েছিল। তাঁর মাথায় একটি শিং ছিল, তাই তাঁর নাম হয় 'ঋষ্যশৃঙ্গ'। মহাতপা ঋষ্যশৃঙ্গ জন্ম থেকেই তপস্যা-মগ্ন ছিলেন। বনেই বাস করতেন। নিজের বাবা ছাড়া আর কাউকে দেখেন নি। চিনতেনও না। তাঁর অন্তঃকরণ ছিল বিশুদ্ধ, ব্রহ্মচর্য্য-সমৃদ্ধ।

সেই সময় দশরথের বন্ধু লোমপাদ অঙ্গদেশের রাজা হয়েছিলেন। তিনি জেনে বুঝে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং পুরোহিতদের প্রতি অত্যাচার করতেন। এই কারণে ব্রাহ্মণেরা তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন। তা জানতে পেরে সহস্রলোচন (ইন্দ্ৰ) তাঁর রাজ্যে বৃষ্টি বন্ধ করে দিয়ে প্রজাদের দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেন। রাজা লোমপাদ তখন প্রাজ্ঞ-তপস্বী ব্রাহ্মণদের ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন- “হে ব্রাহ্মণগণ! কিভাবে রাজ্যে বৃষ্টি ঘটানো যায়, তার উপায় বলুন।”

পণ্ডিত ব্রাহ্মণেরা তা শুনে নিজেদের মত করে উপায় বলছিলেন, তার মধ্যে একজন মুনি রাজাকে বলেছিলেন- “হে রাজেন্দ্র! ব্রাহ্মণরা আপনার প্রতি রুষ্ট হয়ে আছেন। তার প্রতিকার করুন। আর ঋষ্যশৃঙ্গ নামে এক সরল, বিনয়ী, আজন্ম বনবাসী ঋষি আছেন। তিনি কখনো নারীমুখ দেখেন নি। তাঁকে আপনার রাজ্যে নিয়ে আসুন। আমার বিশ্বাস, তিনি রাজ্যে প্রবেশ করা মাত্রই বৃষ্টি শুরু হবে।”

এরপর রাজা লোমপাদ নিজের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত হিসাবে ব্রাহ্মণদের কাছে গেলেন। এবং তাঁদের ক্ষোভ দূর করলেন। প্রজাগণ তা শুনে সবিশেষ আনন্দিত হ'লো। তারপর তিনি তাঁর মন্ত্রীদের ডেকে ঋষ্যশৃঙ্গকে কিভাবে তাঁর রাজ্যে আনা যায় তার পরামর্শ করতে লাগলেন। এইভাবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর রাজা তাঁর রাজ্যে যত সুন্দরী-বুদ্ধিমতী বারবণিতা ছিল তাদের ডেকে আনানোর আদেশ দিলেন । কিছুপরে বারবণিতারা এলে লোমপাদ বললেন- “বারবণিতাগণ! ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে লোভ দেখিয়ে বা বিশ্বাস তৈরি করে; যেভাবেই হোক তাঁকে এই রাজ্যে আনাও।”

বারবণিতাগণ রাজার এমন আদেশ শুনে বেশ ঘাবড়ে গেল। এবং শাপগ্রস্ত হওয়ার ভয়ে এই কাজ করতে অস্বীকার করল। অবশ্য তাদের মধ্যে এক প্রবীণা রাজাকে বলল- “মহারাজ! যদি আমার প্রয়োজন মত কতকগুলি জিনিস দেন, তাহলে আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি।”

রাজা তখন সেই প্রবীণার চাহিদা মত নানারকম রঙ্গ, ভূষণ, টাকা-পয়সা ইত্যাদি প্রদান করলেন। প্রবীণা বারবণিতাটি তখন আর কয়েকজন রূপসী যুবতী মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির উদ্দেশে যাত্রা করলেন।

এরপর সেই প্রবীণা একটি নৌকার মধ্যে একটি কৃত্রিম মনোরম আশ্রম নির্মাণ করলেন। নৌকায় নির্মিত সেই আশ্রমটি নানারকম কৃত্রিম গাছ-পালা, লতা-গুল্ম ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে কাশ্যপ মুনির আশ্রমের সামান্য দূরে রাখলেন। তারপর গুপ্তচর পাঠিয়ে খবর সংগ্রহের চেষ্টা চালালেন; মুনি বিভাণ্ডক (কাশ্যপ) কখন আশ্রম থেকে বাইরে যান ? তারপর সব কিছু জেনে নিয়ে সুযোগ বুঝে নিজের কন্যাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে পাঠালেন।

বারবণিতা কন্যা ঋষ্যিশৃঙ্গ মুনির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— “মুনিবর! সন্ন্যাসী সকলের কুশল তো ? সকলের যথেষ্ট ফলমূলের অভাব নেই তো ? আপনাদের তপস্যার অগ্রগতি কেমন ? আপনার পিতার সব কিছু কুশল তো ? আপনি বেদ পাঠ করে যথেষ্ট আনন্দ পাচ্ছেন তো ? আপনাকে দেখার জন্য আমি এখানে এসেছি।” ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন- “মহাশয়! আপনাকে খুবই তেজস্বী দেখাচ্ছে। মনে হয় আপনি আমার অভিবাদনযোগ্য। আপনি আসন গ্রহণ করুন। আপনাকে যথাযোগ্য আপ্যায়ন করি। হে ব্রহ্মণ! আপনার আশ্রম কোথায় ? আপনি কোন্ দেবতার উদ্দেশে ব্রতানুষ্ঠান করেন ?”

বারবিলাসিনী বললেন- “হে ব্রহ্মণ! এই পাহাড়ের অপর পারে আমার আশ্রম। অভিবাদন গ্রহণ বা পা ধোয়ার জল স্পর্শ করা আমার ধর্ম নয়, বরং, আপনি আমার অভিবাদনযোগ্য । তাই আমি এমন ব্যক্তিকে অভিবাদন নয়, আলিঙ্গন করি।”

ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন— “তা'হলে আমলকী, ঈঙ্গুদ, করূষক ইত্যাদি রুচিমত ফলগুলি গ্রহণ করুন।”

খুঁজতে খুঁজতে যখন তোমাদের জিজ্ঞাসা করবেন, তখন তোমরা বিনয়ের সঙ্গে হাতজোড় করে বলবে যে, এইসব গোরু, পশু ইত্যাদি আপনার পুত্রের অধিকৃত, এবং আমরা আপনার আজ্ঞাবাহী দাস। এখন বলুন, আমরা আপনার কোন আদেশ পালন করতে পারি।”

ওদিকে বিভাণ্ডক ঋষি ফল মূলাদি সংগ্রহ করে আশ্রমে ফিরে এসে দেখলেন ঋষিতনয় আশ্রমে নেই। পুত্রকে না দেখতে পেয়ে তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। তৎক্ষণাৎ তাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লেন । তিনি বিচার করলেন যে, তাঁর পুত্রকে নিশ্চয়ই কোন রাজা চুরি করে নিয়ে গেছেন। এই ভেবে সেই রাজা এবং তার বন্ধু রাজাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য চম্পা নগরের দিকে তিনি রওনা দিলেন । পথ চলতে চলতে তিনি ভীষণ ক্লান্তি এবং ক্ষুধা তৃষ্ণা অনুভব করলে লোমপাদের আদেশে সাজানো ঘোষদের গ্রামে তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করেন। উপস্থিত সকলে তখন মুনিবরকে যথাযোগ্য অভ্যর্থনা এবং আপ্যায়ন করলে মুনিবর বেশ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে রাত্রিটি সেখানে কাটান। তাদের ব্যবহারে মুনিবার অত্যন্ত খুশি হন এবং জিজ্ঞাসা করেন— “হে গোপগণ! তোমরা কারা ? তোমাদের অধিপতি কে ?”

গোপগণ উত্তর দিল- “মহাভাগ! আপনার পুত্রই আমাদের সকলের অধিকর্তা।” ঘোষদের কথা শুনে মুনিবর বিভাণ্ডকের ক্রোধ একেবারে গলে জল । তখন তিনি চম্পা নগরীতে প্রবেশ করলেন। সেখানে রাজা লোমপাদের কাছে যথাযোগ্য আপ্যায়ন ও আতিথেয়তা পেয়ে আরও খুশি হলেন। তারপর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ ও পুত্রবধূ শান্তাকে দেখে তার মন আনন্দে ভরে গেল। তিনি পুত্রকে বললেন— “যতদিন না তোমার সন্তানাদি হচ্ছে ততদিন এখানে থাকো। পুত্র জন্মগ্রহণ করলে আশ্রমে ফিরে যেও।” ঋষ্যশৃঙ্গ পিতার নির্দেশ পালন করে নির্দিষ্ট সময়ে কাশ্যপ আশ্রমে ফিরে গেলেন । তাঁর পত্নী শান্তা ছিলেন যথার্থ পতিব্রতা। স্বামী বনে চলে গেলে তিনিও তাঁর অনুগামিনী হীন। যেভাবে সৌভাগ্যবতী অরুন্ধতী বশিষ্ঠকে, লোপামুদ্রা অগস্ত্যকে, দময়ন্তী নলকে সেবা ও পরিচর্যায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন, শান্তাও অত্যন্ত প্রীতি ও নিষ্ঠা দিয়ে তাঁর বনবাসী স্বামীর সাধন-তপস্যাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।

লোমশ বললেন- ধর্মরাজ! এইভাবে ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রমটি আজও পবিত্র ও কীর্তিস্থাপনকারী হিসাবে বিবেচিত হয়। এর নিকটবর্তী সরোবরের শোভা সত্যিই মনোরম। তার পুণ্য সলিলে অবগাহন করে আপনি শুদ্ধ হোন, তারপর অন্যান্য তীর্থে যাত্রা করুন।


0 Reviews