Read more
মাণ্ডব্য ঋষির কাহিনি
মহাভারতের আদি পর্বে মাণ্ডব্য ঋষির কাহিনি আলোচিত আছে। সাধারণত দেবতারা মানুষদের অভিশাপ দেন, বিশেষ কোনো অপরাধের দণ্ড হিসাবে। কিন্তু মাণ্ডব্য ঋষি স্বয়ং যমরাজকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। এবং আলোচ্য গল্পটির মূল আকর্ষণ হলো ঐ ঘটনাটি। গল্পটি মহাভারতে ঋষি বৈশম্পায়ন ও রাজা জনমেজয়ের কথোপকথনের মাধ্যমে পরিবেশিত হয়েছে।
জনমেজয় জিজ্ঞাসা করলেন— “হে মহাত্মা! ধর্মরাজ কী এমন দোষ করেছিলেন যে, মহর্ষি মাণ্ডব্য তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন ? দয়া করে এই বিষয়টি আমাকে শোনান।”
বৈশম্পায়ন বললেন- “জনমেজয় ! অনেক পুরানো দিনের কথা । মাণ্ডব্য নামে একজন সত্যনিষ্ঠ, ধৈর্য্যশীল, তপস্বী-ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি বালক বয়স থেকেই কঠোর তপস্যা শুরু করেছিলেন। তাঁর আশ্রমের দরজার সামনে একটি গাছের নীচে বসে তিনি দুহাত তুলে তপস্যা করতেন। তপস্যাকালে তিনি আবার মৌনব্রত পালন করতেন। এই হচ্ছে ঋষিবরের তপস্যার বৈশিষ্ট্য।
কিছুকাল পর একদিন একদল ডাকাত কিছু চুরির মালপত্র নিয়ে ঋষির আশ্রমের কাছে দৌড়াতে দৌড়াতে এল। ডাকাত দলটির পেছনে পেছনে কয়েকজন রাজ সিপাহী তাদের ধরার জন্য আসছিল। ডাকাতরা তখন নিজেদের বাঁচানোর জন্য মাণ্ডব্য ঋষির আশ্রমে মালপত্র সহ লুকিয়ে পড়ে। সিপাহীরা ডাকাতদের খুঁজতে খুঁজতে একসময় ধ্যানমগ্ন ঋষিবরকে জিজ্ঞাসা করল— “মুনিবর! ডাকাতরা কোথায় গেল ? আমরা তাদের খুঁজছি। আপনি তাদের সম্পর্কে কি জানেন ? বলুন ?”
মাওব্য ঋষি মৌনি ছিলেন। তাই তিনি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। সিপাহীরা মুনিবরকে বারবার জিজ্ঞাসা করলেও মুনিবর নিশ্চুপ থাকলেন। তখন বাধ্য হয়ে সিপাহীরা আশেপাশের সম্ভাব্য লুকানোর জায়গাগুলি খুঁজতে খুঁজতে একসময়
আশ্রমের ভিতরে ঢুকে তল্লাশি শুরু করল। এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে খুব শীঘ্র মালপত্র সমেত চার ডাকাতকে তারা ধরে ফেললো।
এভাবে অপ্রত্যাশিত সাফল্য পেয়ে সিপাহীরা আর কাল বিলম্ব না করে ডাকাতদের সাথে সাথে মাণ্ডব্য ঋষিকেও রাজার কাছে নিয়ে গেল। রাজামশাই পুরো তদন্ত প্রক্রিয়াটি শুনলেন। তারপর মুনিবরকে এই ঘটনা সম্পর্কে পরপর প্রশ্ন করে চললেন। কিন্তু মুনিবর যেহেতু মৌনি ছিলেন, তিনি আগের মতো এক্ষেত্রেও নীরব রইলেন। তখন রাজা অনন্যোপায় হয়ে ডাকাতদের সাথে সাথে মাণ্ডব্য ঋষিকেও শূলে চড়ানোর দণ্ড দিলেন। সেইমত ঋষিবরকে শূলে চড়ানো হলো।
এরপর অনেকদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। ঋষি মাণ্ডব্য খাওয়া-দাওয়া না করেও দিব্যি শূলে বসে থাকলেন। তাঁর মৃত্যু হলো না। ওইভাবে শূলের উপর বসে বসে তিনি অন্যান্য অনেক মুনি-ঋষিকে আমন্ত্রণ জানাতেন। রাত্রে যখন চারদিক নিশ্চুপ হতো তখন সেইসব মুনি-ঋষি পক্ষী রূপে তাঁর সামনে আসতেন। তাঁরা প্রশ্ন করতেন— “তিনি কী এমন অপরাধ করেছিলেন যে, তাঁকে শূলে চড়ানো হয়েছে ?”
মাণ্ডব্য ঋষি সকলকে প্রায় একই উত্তর দিতেন- “আমি কাকেই বা দোষ দেবো ? ধরুন এ আমারই অপরাধের ফল।”
প্রহরীরা দূর থেকে সব কিছু দেখতো। তাঁরা এটা দেখে অবাক হতে লাগলো যে, ঋষিবর শূলে চড়া অবস্থায় এতদিন আছেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু হয়নি। একদিন প্রহরীরা এই আশ্চর্যজনক ঘটনাটি রাজাকে গিয়ে বিস্তারিতভাবে সব জানালো, রাজামশাইও তা শুনে বিস্মিত হলেন। তারপর মাণ্ডব্য ঋষির সামনে এসে হাত জোড় করে রাজামশাই বললেন— “ক্ষমা করুন মুনিবর! কোন কিছু না জেনে বা বুঝে এই ঘোর অন্যায় শাস্তি আপনাকে দিয়েছি। আপনি প্রসন্ন হোন । এখন আমার কি করা উচিত দয়া করে বলুন
রাজার বিনীত প্রার্থনা শুনে ঋষি মাণ্ডব্য শূল থেকে নেমে এলেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই যে, কোনোভাবেই তাঁর শরীর থেকে শূলটিকে বের করা যাচ্ছিল না । তখন নিরুপায় হয়ে একসময় শূলটিকে কেটে দেওয়া হলো। তারপর ঐ শূলবিদ্ধ অবস্থাতেই তিনি তাঁর তপস্যা চালিয়ে যেতে যেতে একদিন দুর্লভ-লোক প্রাপ্ত হলেন। বলাবাহুল্য, তখন থেকে তাঁর নাম হয়েছিল অণীমাণ্ডব্য ।
মহর্ষি মাণ্ডব্য এরপর, যমলোকে গিয়ে যমরাজকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন— “আমি কি এমন অন্যায় করেছি যে, আমার এই কঠিন শাস্তি হলো ? আপনি অবিলম্বে এর উত্তর দিন। নাহলে আমি আমার তপস্যার ফল দেখাতে বাধ্য হবো।”
ধর্মরাজ প্রত্যুত্তরে বললেন- “আপনি একদিন একটি ছোট ফড়িং-এর লেজে একটি লোহার শিক ফুটিয়ে দিয়েছিলেন। আপনার এই শাস্তি ঐ ঘটনারই ফল। অনেক সময় এমন হয় যে, অল্প দানে অধিক ফল লাভ হয়, তেমনি আবার সামান্য পাপ বা অধর্ম থেকেও অনেক বেশি দণ্ড বা শাস্তি ভোগ করতে হয়। আপনার ক্ষেত্রে ঠিক এমনটি ঘটেছে।”
অণীমাগুব্য পুনরায় প্রশ্ন করলেন— “আমি কবে এই কাজ করেছি ?”
ধর্মরাজ উত্তর দিলেন- “অল্প বয়সে।”
অণীমাণ্ডব্য এবার বললেন- “বারো বছর বয়স পর্যন্ত মানুষ যা কিছু করে তা অধর্ম বলে বিবেচিত হয় না। কারণ তখন তার মধ্যে ধর্ম-অধর্ম বোধ গড়ে ওঠে না। আপনি আমার শৈশবে করা এই সামান্য অন্যায়টির কারণে বেশ গুরুদণ্ড দিয়েছেন। আপনি কি জানেন না ব্রাহ্মণবধ অত্যন্ত গুরুতর পাপ। আপনি আমাকে যে শাস্তি দিয়েছিলেন, তাতে আমার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিল। কেবল আমার তপোবল এক্ষেত্রে
আমাকে রক্ষা করেছে।
তাই আমি আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছি— 'আপনাকে শূদ্রযোনিতে জন্ম নিতে হবে।" মানুষ হয়ে জন্মাতে হবে। আজ থেকে জগতে কর্মফলের এক নতুন নিয়ম আমি স্থাপন করছি। চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত যা কিছু অন্যায় করা হবে, তা পাপ বলে বিবেচিত হবে না। চৌদ্দ বছর বয়সের পর থেকে করা সকল কর্মে পাপ-বিচার প্রযুক্ত হবে।"
মহাতপা মাগুব্য ঋষির অভিশাপ ধর্মরাজকে মনুষ্য জন্ম নিতে বাধ্য করেছিল। পরে তিনি কৌরব বংশে বিদুর রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিদুর ধর্মরাজের সকল গুণ নিয়ে জন্মেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে বীতশোক ও বীতরাগ। জ্ঞান ও সত্যের পরাকাষ্ঠা। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন তার প্রিয় সখা। তিনি প্রকৃত অর্থে ছিলেন কৌরববংশের যথার্থ হিতৈষী, শান্তি ও সাম্যের পূজারী।
এই গল্পের অন্তিম পর্বে মহাতপা মাণ্ডব্য পাপ-পুণ্য বিচারের ক্ষেত্রে বয়সের যে সীমারেখাটি স্থির করে দিয়েছিলেন, সেটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারণ আধুনিককালে আমাদের দেশে ষোলো থেকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত Juvenile Act কার্যকরী হয়। এই আইন যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁরা কী এই গল্প থেকে সূত্র সংগ্রহ করেছিলেন ? আইন প্রণয়ন, কিংবা রাজ্য শাসন, মূল বিবরটি হলো, জ্ঞান। মুনি-ঋষিরা তাই চিরকালই জ্ঞান-রূপ শক্তির উৎস বলে বিবেচিত হয়ে আসছেন।
0 Reviews