Read more
ঋষি অষ্টাবক্রের জীবনকথা
ঋষি আরুণির আশ্রমে বেদের পাঠ নিতেন তাঁর কন্যা সুজাতা। আরুণির তাপোবনে কহোড় ছিলেন আর পাঁচজন শিষ্যের অন্যতম। আরুণি একদিন প্রিয়তমা কন্যার বিয়ে দিলেন শাস্ত্রজ্ঞ কহোড়ের সঙ্গে। তাঁদের একমাত্র সন্তান অষ্টাবক্র। বাল্মীকি রামায়ণে দেখা যায় যে, দশরথ স্বর্গ থেকে ফিরে এসে রামচন্দ্রকে শোনাচ্ছেন 'অষ্টাবক্র-কাহোড়া' উপাখ্যান। আধ্যাত্ম রামারণের বর্ণনা অনুযায়ী এক কবন্ধ রাম-লক্ষ্মণকে বলছেন যে, তিনি আসলে ছিলেন গন্ধর্বকুমার। তিনি অষ্টাবক্র মুনিকে দেখে হেসেছিলেন বলে অভিশপ্ত হয়েছিলেন। অবশ্য পরে ক্রোধ প্রশমিত হলে অষ্টাবক্র বলেছিলেন ত্রেতা যুগে রামচন্দ্র এসে তাঁকে শাপমুক্ত করবেন। এই কারণে রামচন্দ্রের আশীর্বাদ নিতে তিনি এসেছেন, যাতে শাপমুক্ত হয়ে সেই কবন্ধ গন্ধর্বকুমারের পুনর্জীবন পান।
ঋষি অষ্টাবক্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো অষ্টাবক্র গীতা। এটি আসলে অষ্টাবক্রের সঙ্গীত বা গান। সেখানে আলোচিত হয়েছে 'আত্মন' ও 'ব্রহ্মণের' মধ্যেকার সম্পর্ক। ওই আলোচনাতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে এসেছে দ্বৈত ও অদ্বৈতবাদ তত্ত্ব। অষ্টাবক্র গীতার তাই আর এক নাম হলো অষ্টাবক্র সংহিতা। এভাবে জানা যায় ঋষি অষ্টাবক্রের জীবন ছিল আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপে পরিপূর্ণ।
আলোচ্য গল্পটি মহাভারতের ‘বনপর্বের' একশো একত্রিশতম থেকে একশো তেত্রিশ-তম অধ্যায়ের সূত্র ধরে নির্মিত হয়েছে। এখন দেখে নেওয়া যাক মূল গল্পটি।
ঋষি লোমশ যুধিষ্ঠিরকে বললেন- “হে রাজা! উদ্দালক-নন্দন শ্বেতকেতু পৃথিবীতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মন্ত্রবিদ রূপে বিখ্যাত। এটি সেই মহাত্মার বিখ্যাত আশ্রম। এখানেই একদিন তিনি 'দেবী সরস্বতীকে' মানবী রূপে দর্শন লাভ করে বলেছিলেন যে, ‘আমি বাণীকে জানার জন্য তপস্যা করে চলেছি।' হে রাজা! ঐ যুগে কহোড়- তনয় অষ্টাবক্র এবং উদ্দালক-পুত্র শ্বেতকেতু— দুজনে প্রথিতযশা দুই বেদজ্ঞ মুনি ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিল মামা-ভাগ্নে সম্পর্ক।”
লোমশ মুনি পুনরায় বললেন- ঋষি উদ্দালকের (আরুণি) কোহড় নামে এক শিষ্য ছিলেন। তিনি তাঁর গুরুদেবকে দেবতা জ্ঞানে নিষ্ঠা ভরে সেবা করতেন। গুরুদেব শিষ্যের প্রতি তাই কৃপা পরবশ হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে তাঁকে বেদ অধ্যয়ন করিয়েছিলেন। তারপর তাঁর কন্যা সুজাতার সঙ্গে শিষ্যের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের কিছুদিন পর সুজাতা গর্ভবতী হন।
একদিন সুজাতার গর্ভে থেকে তেজস্বী শিশুটি পিতাকে বললেন- “হে পিতা! আপনি সারারাত ধরে বেদ অধ্যয়ন করেন, কিন্তু আপনার অধ্যয়ন যথাযথ হয় না। আমি আপনার কৃপায় মাতৃগর্ভ থেকে সকল প্রকার বেদ সহ অন্যান্য শাস্ত্রগুলি অধ্যয়ন করে ফেলেছি। কিন্তু এখন দেখছি আপনার বেদ পাঠ উত্তম রূপে হচ্ছে না।”
শিষ্যদের সামনে তাঁর গর্ভস্থ সন্তান যেভাবে বেদ পাঠের ত্রুটি নিয়ে তাঁকে বললেন, তাতে মহর্ষি কহোড় অপমানিত বোধ করলেন। এরপর রুষ্ট হয়ে গর্ভস্থ সন্তানকে অভিশাপ দিয়ে বললেন- “তুমি গর্ভে থেকে আমার প্রতি অপমানজনক মন্তব্য করছো, আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি তোমার শরীরে আটটি স্থান বক্র বা বাঁকা থাকবে।'
নিয়তির বিধান মেনে কাহাড়-নন্দন যখন ভূমিষ্ঠ হলেন তখন তাঁর শরীরের আটটি স্থানে বক্তৃতা নিয়েই জন্মেছিলেন। তাই তাঁর নাম হয়েছিল 'অষ্টাবক্র'। শ্বেতকেতু এবং অষ্টাবক্র দু'জনেই ছিলেন সমবয়স্ক এবং শ্বেতকেতু ছিলেন সম্পর্কে অষ্টাবক্রের মাতুল বা মামা।
গর্ভস্থ সন্তান ক্রমে বড় হতে লাগল। একদিন কহোড়-ভার্যা সুজাতা স্বামীকে বললেন- মহর্ষি: আমার সন্তান প্রসবের সময় হয়েছে। আমি বেশ দুর্বল বোধ করছি। আমরা এমনিতে গরীব। কিন্তু এই সময় টাকা-পয়সা ছাড়া এই বিপদ সামলানো যায় না। আপনি কিছু টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করুন। "
স্ত্রী'র কথা শুনে অর্থ সংগ্রহের আশায় মহর্ষি কহোড় তখন জনক রাজার কাছে ছুটলেন। জনক রাজার সভায় 'বন্দী' নামে একজন প্রবীণ বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মহাত্মা কাহোড়কে শাস্ত্র আলোচনায় পরাজিত করলেন। রাজার নিয়ম অনুসারে তখন তাঁকে জলে ডুবিয়ে দেওয়া হলো। উদ্দালক' এই সংবাদ শুনে সুজাতাকে এসে সব খুলে বললেন। সেইসঙ্গে পরামর্শ দিলেন যে, তুমি এ বিষয়ে অষ্টাবক্রকে কিছুই বলবে না। তাই অষ্টাবক্র জন্মের পর এ বিষয়ে কিছুই জানতে পারেন নি। বরং পিতামহ উদ্দালককে তিনি তাঁর পিতা বলে মনে করতেন। এবং উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতুকে তাঁর নিজের ভাই বলে জানতেন।
অষ্টাবক্রের বয়স তখন সবে বারো বছর। একদিন তিনি উদ্দালকের কোলে বসে আছেন। তখন শ্বেতকেতু ঈর্যান্বিত হয়ে তার হাত ধরে টানতে টানতে বললেন— “অষ্টাবক্র! ওঠ, এটা তোর বাবার কোল নয়।”
শ্বেতকেতুর এই কথায় অষ্টাবক্র মনে খুব ব্যথা পেলেন। বাড়ি ফিরে এসে তিনি তাঁর মা'কে জিজ্ঞাসা করলেন— “মা! উদ্দালক যদি আমার বাবা না হন, তাহলে আমার বাবা কে ? তিনি এখন কোথায় ?”
পুত্রের এই বুক ফাটানো কথা শুনে সুজাতা শাপভয়ে পুত্রকে তাঁর পিতার সমস্ত ঘটনা বলে দিলেন। মায়ের মুখে তাঁর পিতার এই করুণ পরিণতি শুনে অষ্টাবক্র চঞ্চল হয়ে পড়লেন। রাত শেষ হলে শ্বেতকেতুর সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির করলেন যে, তাঁরা জনক রাজার যজ্ঞানুষ্ঠানে যাবেন। সেখানে গিয়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্ক-বিবাদে অংশগ্রহণ করবেন। এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করবেন।
এরপর অষ্টাবক্র এবং মাতুল শ্বেতকেতু উভয়ে জনক রাজার যজ্ঞানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশে গমন করলেন। হঠাৎ পথের মধ্যে তাঁদের সঙ্গে জনক রাজার সাক্ষাৎ হলো। অষ্টাবক্র তাঁকে দেখে বললেন- “হে রাজন! পথে যেতে যেতে যতক্ষণ না পর্যন্ত ব্রাহ্মণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সবার আগে থাকবে অন্ধ, তারপর বধির বা কালা, তারপর স্ত্রীলোক, ভারবাহী এবং রাজা বা রাজপুরুষ ক্রমান্বয়ে থাকবেন সবার শেষে। কিন্তু ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেখা হলে সবার আগে থাকবেন ব্রাহ্মণ। কারণ ব্রাহ্মণের আগে গমন করার অধিকার কারুর নেই।”
জনক রাজা বললেন- “বেশ, আপনাকে পথ ছেড়ে দিলাম। এখন আপনার যেমন ইচ্ছা সেভাবে পথ চলুন। আগুন যত সামান্যই হোক তার দাহিকা শক্তি কখনো কমে না। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রও ব্রাহ্মণদের শ্রদ্ধাভক্তি করেন। তাই আপনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানে যান।”
অষ্টাবক্র বললেন- “হে রাজা! আমরা যজ্ঞ দর্শন করার বাসনা নিয়ে এখানে এসেছি। আমরা অতিথি, যজ্ঞক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চাই। দয়া করে দ্বারপালকে বলে আমাদের প্রবেশ করার সুযোগ করে দিন।”
এমন সময় দ্বারপাল এসে বললেন- “হে ব্রাহ্মণদ্বয়! আমরা বন্দীর নির্দেশ পালন করে চলি । তাঁর নির্দেশ অনুসারে এই যজ্ঞস্থলে কেবলমাত্র প্রবীণ এবং বিদগ্ধ ব্রাহ্মণেরাই প্রবেশ করতে পারবেন। বালকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ”
অষ্টাবক্র বললেন— “হে দ্বারপাল! এখানে ব্রাহ্মণগণ যদি প্রবেশ করতে পারেন: তা'হলে আমারও এখানে প্রবেশ করার অধিকার আছে। কারণ আমি সংযম ও বেদ অধ্যয়ন করে বৃদ্ধদের সমতুল্য হয়েছি। তাই আমাকে বালক ভেবে অবজ্ঞা করবেন না। আগুন যত সামান্যই হোক, তা স্পর্শ মাত্র পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।”
দ্বারপাল তখন বললেন- “হে ব্রাহ্মণনন্দন! তুমি নিজেকে বড্ড বেশি অভিজ্ঞ ভাবছো। তোমার এই ভাবনা ঠিক নয়।”
অষ্টাবক্র বললেন— “কেবল শরীর বড় হলে বৃদ্ধভাব আসে না। শরীর বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান ও চিন্তনেও বিকাশ দরকার। শালি বৃক্ষেরও অনেক বীজ জন্মায় । কিন্তু তাতে তার শ্রেষ্ঠত্ব বৃদ্ধি পায় না। ছোট হোক, কিন্তু ফলবান— সেই বৃক্ষই যথার্থ প্রাচীন ও প্রবীণ বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু যা নিস্ফলা তার বৃদ্ধত্ব ধরা পড়ে না।”
দ্বারপাল বললেন— “বালকদ্বয়। বৃদ্ধদের থেকেই বুদ্ধি নিতে হয়। এভাবেই বয়োবৃদ্ধি ঘটে। সামান্য অনুশীলন বা অল্প সময়ের চেষ্টায় জ্ঞানার্জন হওয়া অসম্ভব। তাই বড়দের মত আর বড় বড় কথা বোলো না।”
অষ্টাবক্র বললেন- “হে দৌবারিক ! শুধুমাত্র বয়স হলেই মানুষ বৃদ্ধ হয় না। কিন্তু যে ব্যক্তি বালক অথচ জ্ঞানী, তাকে দেবতারা স্থবির বলে থাকেন। যাঁরা সাঙ্গবেদসম্পন্ন, ঋষিগণ তাঁদেরই মহান বলে আখ্যা দিয়েছেন। আমরা এই রাজসভার ‘বন্দী' নামে একজন বিদ্বান আছেন বলে, শুনেছি। আজ আমরা সেই বিদ্বান ব্যক্তির সঙ্গে শাস্ত্রার্থ করতে চাই। তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে তাঁকে পরাজিত করতে চাই।”
দ্বারপাল বলল- “বেশ! আমি যে কোন উপায়ে তোমাদের সভায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু সেখানে গিয়ে তোমাদের বিদ্বান ব্যক্তিদের মুখোমুখি হতে হবে। কাজটা সহজ তো নয়ই বরং, পরাজিত হলে কি ভয়ানক পরিণতি অপেক্ষা করছে তা নিশ্চয়ই তোমাদের জানা আছে ?” – এই বলে নিজ উদ্যোগে দ্বারপাল অষ্টাবক্র ও শ্বেতকেতুকে যজ্ঞস্থলে নিয়ে গেলেন।
সেখানে পৌঁছে অষ্টাবক্র বললেন- “রাজন! আমি জনকবংশীয় ব্রাহ্মণ। এখানে 'বন্দী' নামে একজন বিদ্বান আছেন। শুনেছি তিনি অনেক ব্রাহ্মণকে শাস্ত্রার্থে পরাজিত করেছেন। এবং আরও শুনেছি যে আপনার লোকজন পরাজিত ব্রাহ্মণকে জলে ডুবিয়ে রাখে। আমি বন্দীর সঙ্গে শাস্ত্রার্থ যুদ্ধে অংশ নিতে চাই। দয়া করে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ করানো হোক।”
রাজা বললেন- “হে ব্রাহ্মণ বালক। তুমি বন্দীর প্রতিভা না জেনে শুনে তাঁকে
পরাজিত করার সংকল্প করেছো। ইতিপূর্বে বহু বেদজ্ঞ ব্যক্তি এই ভেবে ভুল করেছেন।”
অষ্টাবক্র বললেন— “হে নরোত্তম! আমি বেশ বুঝতে পারছি তিনি কখনো আমাদের মতো বালক ব্রাহ্মণের সঙ্গে শাস্ত্রালোচনায় অংশ নেন নি। কিন্তু আমি নিশ্চিত আজ আমি তাঁকে পরাজয়ের স্বাদ পাইয়ে দেবো।”
রাজা তখন অষ্টাবক্রের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য প্রশ্ন করলেন— “যে ব্যক্তি দ্বাদশ অংশ, চব্বিশ পর্ব, তিনশত ষাট আরা সম্পন্ন পদার্থ জানেন, তিনি যথার্থ পণ্ডিত।”
অষ্টাবক্র প্রত্যুত্তরে বললেন- “হে রাজন! চব্বিশ পর্ব, ছয় নাভি, তিনশত ষাট আরাযুক্ত সেই অনবরত ঘূর্ণায়মান কালচক্র আপনাকে রক্ষা করুন।”
রাজা সন্তুষ্ট হয়ে আবার প্রশ্ন করলেন— “ঘুমানোর সময় চোখ কার খোলা থাকে ? জন্মের পরও কার স্পন্দন হয় না ? কার হৃদয় নেই ? কে বেগের সঙ্গে বৃদ্ধি পায় ?
অষ্টাবক্র উত্তর দিলেন— “মাছ ঘুমানোর সময় চোখ খোলা রাখে। ডিম জন্মানোর পরও তার স্পন্দন দেখা যায় না। পাথরের হৃদয় বলে কিছু হয় না। নদী সবেগে ধাবিত হয়। এগিয়ে চলে।”
রাজা আবার প্রশ্ন করলেন— “যে দুই পদার্থ আগুনের ন্যায় সংযুক্ত এবং শ্যেন পাখির ন্যায় পতনশীল; দেবতাদের মধ্যে কে, কে সেই দুই পদার্থের জনক। এই দুই পদার্থ কি— বা সৃষ্টি করে ?”
অষ্টাবক্র বললেন— এই দুই পদার্থ যেন আপনার শত্রুর গৃহেও না থাকে। মেঘ এই দুটি পদার্থের জননী এবং ঐ দুই পদার্থও মেঘ উৎপন্ন করে।
তখন রাজা বললেন- “হে ব্রাহ্মণকুমার! তোমাকে তো সাধারণ বলা যায় না। তুমি বালক হলেও জ্ঞানের গুণে বৃদ্ধ। বাল্যকালেই তুমি যে জ্ঞানের অধিকারী হয়েছো তার তুলনা মেলা ভার। তোমাকে আমি ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি। ঐ দেখ বন্দী বসে আছেন।”
অষ্টাবক্র তখন বন্দীর দিকে তাকিয়ে বললেন— “বন্দী! নিজেকে আপনি অতিবাদী (শাস্ত্রার্থে পারদর্শী) বলে মনে করেন। আপনি নিয়ম করেছেন পরাজিতকে জলে ডুবিয়ে দেবেন। কিন্তু আমি জানি আমার সামনে আপনার মুখ থেকে ‘রা' শব্দটি পর্যন্ত বেরোবে না। প্রলয়কালে যেমন অগ্নির কাছে নদীর প্রবাহ শুকিয়ে যায়, তেমনি আমার সামনে আপনার সকল জ্ঞান-গরিমা নিষ্ফল হয়ে যাবে। এবার আপনি আমাকে প্রশ্ন করুন, দেখুন আমি উত্তর দিতে পারছি কি না!”
মন্ত্রী, পরিষদ সহ ভরা সভায় অষ্টাবক্র যখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বন্দীর সঙ্গে শাস্ত্রার্থে দ্বৈরথ আহ্বান করলেন, তখন বন্দী প্রশ্ন করলেন— “অষ্টাবক্র! এক অগ্নি কত রূপে প্রকাশিত হয়, এক সূর্য সমগ্র ভূমণ্ডলকে আলো দান করে, এক বীর দেবরাজ শত্রুকুলের নিহন্তা, এবং এক যম পিতৃগণের ঈশ্বর। ”
অষ্টাবক্র প্রত্যুত্তরে বললেন— “ইন্দ্র ও অগ্নি দুই সখা, একসঙ্গে ভ্রমণ করেন। নারদ ও পর্বত দেবর্ষিও দুজন। অশ্বিনীকুমারেরাও দু'জন। রথের চাকার সংখ্যা দুই, বিধাতার নিয়মে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ দু'জন, একে অন্যের পরিপূরক— জায়া ও পতি।”
বন্দী সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন— “সকল প্রজা নিজ নিজ কর্ম অনুসারে তিন প্রকারে জন্মগ্রহণ করেন। তিন বেদ একত্রিত হয়ে বাজপেয় সু-সম্পন্ন করে। অবজনও প্রাতঃকাল, মধ্যাহ্ন ও সায়ংকাল— এই তিন সময়ে যজ্ঞানুষ্ঠান করে। কর্ম অনুসারে ফলভোগ ক্ষেত্রও তিনটি— স্বর্গ, মর্ত্য ও নরক। বেদে কর্মজনিত জ্যোতিও তিন প্রকারের।”
অষ্টাবক্রের উত্তর- ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দ্দিষ্ট আশ্রম চার প্রকারের। বর্ণ ও চার যজ্ঞাদি দ্বারা নিজেদের নির্বাহ করে। প্রধান দিক চারটি— ‘ওঁ’কার, ‘অ’কার, ‘উ’কার এবং 'ম’কার। বাণীও চার প্রকার- পরা, পশ্যন্তি, মধ্যমা এবং বৈখরী, আবার গাভীও চতুষ্পদ-বিশিষ্ট।
বন্দীর পুনরায় প্রশ্ন- “যজ্ঞের অগ্নি পাঁচ প্রকার (গার্হপত্য, দক্ষিণাগ্নি, আহ্বনীয়, সভ্য এবং আবসথ্য), পংক্তি ও ছন্দ পঞ্চপদযুক্ত। যজ্ঞ ও পাঁচ প্রকার (অগ্নিহোত্র, দর্শ, পৌর্ণমাস, চাতুর্মাস্য, সোম), ইন্দ্রিয় পাঁচটি, বেদে উল্লিখিত পঞ্চশিখা-বিশিষ্ট অম্পরাও পাঁচজন, এবং পবিত্র নদীর সংখ্যাও পাঁচ বলেই লোকে স্বীকার করেন।”
অষ্টাবক্র প্রত্যুত্তরে বললেন- “অগ্নির আধান করার জন্য দক্ষিণাস্বরূপ ছয়টি গোদান করা হয়। ঋতু ছয়টি, মনকে নিলে জ্ঞানেন্দ্রিয়ও ছয়টি, কৃত্তিকা (ধাত্রী) ছয়টি এবং বেদে উল্লিখিত সাদ্যস্থ যজ্ঞও ছয় ধরনের।”
বন্দীর প্রশ্ন- “ গ্রাম্য পশু সংখ্যা সাত, বন্য পশুও সাত প্রজাতির। যজ্ঞ পূর্ণকারী ছন্দ সংখ্যা সাত, আকাশে বিদ্যমান সপ্তর্ষিমণ্ডল, অহনা সাত প্রকারের এবং বীণা সপ্ততন্ত্রী-সমৃদ্ধ।”
অষ্টাবক্র প্রত্যুত্তরে বললেন- “বস্তু বা পদার্থ ওজন করার পাল্লার গুণ আট হয়ে থাকে। সিংহ বিনাশকারী শরভের (মৃগ বিশেষ) চরণ সংখ্যা আট। দেবতাদের মধ্যে বসু নামক দেবতার সংখ্যাও আট এবং অষ্টকোণ বিশিষ্ট যূপ সব যজ্ঞে ব্যবহৃত হয়।” বন্দী পুনরায় বললেন— “পিতৃযজ্ঞে সমিধ ত্যাগ করার মন্ত্র নয়টি বলেই কথিত আছে। জগতে প্রকৃতিকে নয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। বৃহতী ছন্দের আকার নয়টি, এবং এক থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যা দিয়ে নানা প্রকার সংখ্যা তৈরি হয়।”
অষ্টাবক্র আবার বললেন— দিক দশটি; দশ গুণিতকে সহস্র সংখ্যা পাওয়া যায় ৷ স্ত্রীলোক দশ মাস গর্ভধারণ করে মাতৃত্বের স্বাদ পায়। তত্ত্ব প্রদানকারীর সংখ্যা দশ এবং পূজনীয় ব্যক্তির সংখ্যাও দশ।”
বন্দী পুনরায় বললেন— “পশুদের ইন্দ্রিয় বিষয়ক সংখ্যা এগারো, সেই একাদশটি বিষয়ই তত্ত্বজ্ঞান লাভে প্রতিবন্ধক, স্বর্গে সুপ্রসিদ্ধ রুদ্রের সংখ্যা এগারো এবং যজ্ঞের স্তম্ভ সংখ্যা হ'লো এগারো।”
অষ্টাবক্র বললেন— “বারোটি মাসে এক বছর পূর্ণ হয়, জগতী ছন্দে চরণ সংখ্যা বারো, প্রকৃত যজ্ঞ দ্বাদশ দিনে সম্পন্ন হয় এবং দ্বাদশ আদিত্য ত্রিলোক বিখ্যাত বলেই জানি।”
বন্দী বললেন— “তিথিগুলির মধ্যে ত্রয়োদশীকে উত্তম বলে বিবেচনা করা হয়, এবং পৃথিবী তেরোটি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত বলে জানা যায় ।
ইতিপূর্বে প্রত্যেকেই চারটি করে উদাহরণ দিচ্ছিলেন, কিন্তু বন্দী তেরো সংখ্যার ক্ষেত্রে দুটি উদাহরণ দিয়েই থেমে যান। তখন অষ্টাবক্র বন্দীর অসম্পূর্ণ বক্তব্য পূরণ করে বলেন, “অগ্নি, বায়ু, চন্দ্ৰ— এই তিন দেবতা তেরো দিনের যজ্ঞে প্রকট হন এবং বেদেও তেরোটি আদি অক্ষর বিশিষ্ট অতিছন্দের কথা বলা আছে।
তখন সভাস্থলে বন্দী মুখ নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন। অন্যদিকে অষ্টাবক্রের আত্মবিশ্বাস এবং স্বতস্ফূর্ত যুক্তি ও বাক্যবিন্যাসের গুণে সভাস্থলে উপস্থিত সকলে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে লাগলেন। সেই সঙ্গে তাঁরা সকলে একবাক্যে বন্দীর পরাজয় এবং অষ্টাবক্রের শাস্ত্রজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করলেন।
তখন অষ্টাবক্র বললেন— “এই বন্দী ইতিপূর্বে ব্রাহ্মণদের পরাজিত করে জলে ডুবিয়ে রেখেছেন। এখন তাঁকেও জলে ডোবানো হোক।”
বন্দী প্রত্যুত্তরে বললেন— “আমি বরুণ রাজার সন্তান। আমার পিতা জনক রাজার
মতো বারো বছর ধরে যজ্ঞের আয়োজন করে চলেছেন। আমি সকল ব্রাহ্মণদের সেই যজ্ঞ দেখার জন্য পাঠিয়েছি। তাঁরা প্রত্যেকে ফিরে আসছেন। আমি মহাতপা অষ্টাবক্রকে পূজা করি এবং তাঁরই কারণে আজ আমি আমার পিতা বরুণের কাছে যাচ্ছি।”
অষ্টাবক্র বললেন- “বন্দী যেমন পাণ্ডিত্য ও মেধা দ্বারা বিদ্বান ব্রাহ্মণদের তর্কযুদ্ধে হারিয়ে তাঁদের জলে ডুবিয়ে রেখেছেন, আমিও তেমনি আমার জ্ঞান ও মেধা দিয়ে তাঁর সকল যুক্তিজাল ছিন্ন ও খণ্ডন করেছি। তাই দয়া করে আপনারা আর আমাকে বালক বলে অবজ্ঞা করবেন না।”
রাজা জনক তখন বললেন- “হে ব্রাহ্মণকুমার! আমি এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় আপনার দিব্য বাক্য শ্রবণ করছিলাম। আপনি অবশ্যই বন্দীকে পরাজিত করেছেন। আমার সৌভাগ্য যে, আজ আপনার ন্যায় এমন একজন দেবোপম বালক বীরের সাক্ষাৎ পেলাম।”
অষ্টাবক্র পুনরায় বললেন- “ হে রাজন! বরুণ যদি বন্দীর পিতা হন, তাহলে এখনই উনাকে জলে ডুবিয়ে দিতে আমাদের কোন সমস্যা নেই। আর উনি জীবিত থাকলেই বা আমাদের কি লাভ!”
বন্দী সব শুনে বললেন- “আমি বরুণ-রাজের পুত্র। জন্মলগ্ন হতে আমার কোন ভয়-ডর নেই। আমি তাই জলে ডুবছি। তবে আমি ঘোষণা করছি যে, এখুনি অষ্টাবক্র তাঁর পিতার সাক্ষাৎ পেতে চলেছেন।”
এরপরেই জলে নিমজ্জিত ব্রাহ্মণগণ জলাশয় থেকে উঠে রাজা জনকের সামনে দাঁড়ালেন। তখন অষ্টাবক্রের পিতা কহোড় বললেন- “হে রাজন! লোকে এই জন্যই পুত্র কামনা করেন যার দ্বারা দুর্বল ব্যক্তি পান শক্তিশালী পুত্রের সামর্থ্য ও সাহায্য। মূর্খ ব্যক্তি পণ্ডিত পুত্র পেয়ে খুঁজে পান জীবনের নতুন দিশা। এবং বিদ্যাহীন ব্যক্তি বিদ্বান পুত্রের মাধ্যমে পান বিদ্যারূপী ধনের আস্বাদ। আমি যে কাজ করতে পারি নি আমার পুত্র তা অনায়াসে করে দেখিয়েছে। আজ পিতা হিসাবে গর্বে আমার বুক উন্নত হয়েছে। হে হারাজ! আপনার মঙ্গল কামনা করি। প্রার্থনা করি আপৎকালে স্বয়ং যম যেন শাণিত পরশুরাম দিয়ে আপনাকে রক্ষা করেন। আপনার এই যজ্ঞ সব দিক থেকে যেন সার্থক ও সর্বাঙ্গসুন্দর হয়। দেবগণ এই যজ্ঞে তাঁদের যথাযোগ্য সম্মাননা ও মর্যাদা পেয়ে যেন পরিতৃপ্ত হন।” এরপর বন্দী রাজা জনকের অনুমতি নিয়ে সমুদ্রে ডুব দিলেন। তারপর ব্রাহ্মণেরা অষ্টাবক্রকে যথোচিত মর্যাদা ও প্রাপ্য সম্মান দিয়ে বন্দনা করলেন। এরপর মামা শ্বেতকেতুকে সঙ্গে নিয়ে অষ্টাবক্র আশ্রমে ফিরে গেলেন। সেখানে পৌঁছে পিতা কহোড় অষ্টাবক্রকে বললেন- “তুমি এই সমঙ্গা নদীতে অবতরণ করো।”
পিতার কথা শুনে অষ্টাবক্র যখন জলে ডুব দিলেন তখনই তাঁর সমগ্র শরীর স্বাভাবিক হয়ে গেলো। আটটি বক্র অংশ বিলীন হয়ে গেল। তাঁর অবগাহনে পবিত্র হয়ে গেলো সমঙ্গা নদীও।
0 Reviews