বৈবস্বত মনু এবং মৎস্যোপাখ্যান

বৈবস্বত মনু এবং মৎস্যোপাখ্যান

Size

Read more

  বৈবস্বত মনু এবং মৎস্যোপাখ্যান

প্রাথমিকভাবে ‘মনু' শব্দটির সাহায্যে বোঝায় প্রত্নতাত্ত্বিক বা প্রথম মানুষকে। সংস্কৃতে ‘মানব' শব্দের অর্থ মনু বা ‘মনুর সন্তান’। আবার অন্য কিছু গ্রন্থ অনুসারে মনু হলো পৃথিবীর চৌদ্দজন শাসকের উপাধি, বা নাম। অন্যদিকে ‘মনুস্মৃতি’ অনুসারে মনু বলতে বোঝায় ব্রহ্মার আধ্যাত্মিক পুত্র স্বয়ম্ভূকে।

মনুর প্রথম দিকের উল্লেখ অনুসারে (ঋগ্বেদে) মনু কেবল পাঁচজন। পরবর্তীকালে হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে প্রতিটি করে চৌদ্দটি মন্বন্তর থাকে এবং প্রতিটি মন্বন্তর ভিন্ন ভিন্ন মনুর নেতৃত্বে থাকে। বর্তমান মহাবিশ্ব সপ্তম মনু কর্তৃক শাসিত বলে দাবী করা হয়। যার নাম 'বৈবস্থত। মহাপ্লাবনের আগে বৈবস্বত ছিলেন দ্রাবিড়ের রাজা। তাঁকে বিষ্ণুর মৎস্য অবতার দ্বারা বন্যা বা মহাপ্লাবনের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। তিনি একটি নৌকা তৈরি করেছিলেন যাতে বেদ, তাঁর পরিবার ও সাতজন ঋষিকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল। গল্পটি শুধু মহাভারত নয় আরও অনেক প্রাচীন গ্রন্থে নানাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

আলোচ্য গল্পটি মহাভারতের বনপর্বের একশো ছিয়াশি ও একশো সাতাশিতম অধ্যায়ের রচনার আধারে লিখিত হয়েছে। এবার তুলে ধরা হলো আলোচ্য গল্পটি।

বৈশম্পায়ন ঋষির কথায়- “তারপর পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয় মুনিকে অনুরোধ করে বললেন, মুনিবর আপনি এবার আমাদের বৈবস্বত মনু সম্পর্কে বলুন।”

ঋষি মার্কণ্ডেয় বললেন- “রাজন! বিবস্বান (সূর্য)-এর এক পরাক্রমশালী পুত্র "মনু' যিনি ছিলেন প্রজাপতির সমান কান্তিমান, সৌম্যদর্শন ও মহাত্মা পুরুষ। তিনি বিশাল বদরিকাশ্রমে কখনো মাথা নিচু করে, কখনো বা দুবাহু তুলে; আবার কখনো এক পায়ে দাঁড়িয়ে দশ হাজার বছর ধরে দীর্ঘ তপস্যা করেছিলেন।”

একদিন ভেজা কাপড়ে জটা-বহুল পরিহিত অবস্থায় চারিণী নদীর তীরে বসে তিনি তপস্যা করছিলেন, ঐ সময় একটি মাছ এসে তাকে বললো- “ভগবান! বড় বড় শক্তিশালী মাছেরা দুর্বল মাছেদের খেয়ে ফেলে। আমি একজন অসহায় ক্ষুদ্র মাছ। বড়-বড়, শক্তিশালী মাছেদের ভয়ে সব সময় শঙ্কিত থাকি। আমি আপনার শরণাগত । আমাকে রক্ষা করুন। আমি কথা দিচ্ছি, যথাসময়ে আমি আপনার উপকারে আসতে পারবো।”

মাছের কথা শুনে মহর্ষির মনে করুণা হলো। তিনি তখন দু'হাতের অঞ্জলি করে মাছটিকে তুলে একটি মাটির জ্বালায় রাখলেন। তারপর তাকে যত্ন করে লালন-পালন করতে লাগলেন।

এরপর মুনিবরের যত্ন-আত্তিতে মাছটি দ্রুত বড় হতে লাগলো। এক সময় তা এতটাই বড়ো হলো যে, ঐ জ্বালাটিতে তখন তার জীবনধারণ করা কষ্টকর হচ্ছিল। তখন সে মহামুনি মনুকে একদিন বললো— “ভগবান! এই ছোট মাটির জ্বালাতে আমি ভালভাবে ঘোরাফেরা করতে পারছি না। দয়া করে বড় কোন স্থানে আমার রাখার ব্যবস্থা করুন।”

মাছের কথা শুনে মুনিবর তখন তাকে একটি জলাশয়ে স্থানান্তর করলেন। জলাশয়টি দৈর্ঘ্যে-প্রস্থ্যে বেশ বড়ো ছিল। বেশ কিছু বছর মাছটি সেখানে থাকার পর সে আরও বড় হলো। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে তার শরীর আরও বৃদ্ধি পেল। ধীরে ধীরে ঐ জলাশয়টিও তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পক্ষে অপর্যাপ্ত হয়ে উঠলো। তখন সে মহাতপা মনুকে ডেকে পুনরায় বললো- “মহাভাগ। আপনি আমাকে এখান থেকে তুলে সাগরগামী গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে রাখুন। আমি সেখানে বাস করতে চাই। বলা বাহুলা, আপনার উপযুক্ত লালন-পালনে আমি পরপর বড় হয়ে চলেছি। এই জলাশয়ে আমি ভালভাবে নড়াচড়া করতে পারছি না।”

মাছের কথা শুনে মুনিবর তাকে গঙ্গায় রেখে এলেন। সেখানে বেশ কিছু বছর কাটানোর পর তার শরীর আরও পরিপুষ্ট ও প্রসারিত হ'ল। তখন ঐ গঙ্গা-বক্ষে তার অঙ্গ সঞ্চালন করা সহজ হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে মুনিবরকে মাছটি আবার একদিন বললো- “মহাভাগ। আপনি আমাকে সাগরের জলে ঠাঁই করে দিন। গঙ্গার সলিলে আমি স্বচ্ছন্দ নই।”

মহামুনি মাছের এই প্রার্থনা শুনে এরপর তাকে সাগরের জলে রেখে এলেন। তবে এতবড় মাছটিকে বহন করে নিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হলেও মুনিবর অক্লেশে তাকে সাগরের বুকে স্থানান্তরিত করতে পেরেছিলেন।

মাছটি সাগরের জলে ঠাই পাওয়ার পর বললো- “হে করুণাময়। আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমাকে সব দিক থেকে রক্ষা করেছেন। তাই আমার উচিত আপনার জন্য কিছু করা। যাইহোক্, সামনে এক ভয়ঙ্কর বিপদ আসতে চলেছে, আমি সেই বিষয়ে যা বলছি তা মন দিয়ে শুনুন।

এই জগতের অন্তিমকাল ঘটতে চলেছে। খুব শীঘ্র এই জগৎ সলিল সাগরে ডুবে যাওয়ার পর্যায়ে যাবে। আপনি একটি শক্ত-পোক্ত নৌকা তৈরি করুন। সেটিকে মজবুত দড়ি দিয়ে বাঁধুন। তাতে সপ্তঋষিদের সঙ্গে নিয়ে আরোহণ করবেন। নৌকাটিতে সমস্ত রকমের অন্ন (খাদ্যদ্রব্য) এবং ঔষধির বীজ আলাদা আলাদাভাবে সংগ্রহ করে রাখবেন। এবং নৌকায় বসে আমার জন্য প্রতীক্ষা করবেন। আমি ঠিক সময়ে শিং- ওয়ালা মহামৎস রূপে হাজির হবো। তখন আপনি আমাকে চিনতে পারবেন। আজ এই পর্যন্ত। এখন আসছি।”

মহর্ষি মনু মহামৎসের নির্দেশ অনুসারে একটি নৌকা নির্মাণ করলেন। তাতে সমস্ত রকম বীজ সঙ্গে নিয়ে তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ মহাসাগরের জলে ভাসমান হলেন। এরপর মনে মনে সেই মহামৎসের কথা স্মরণ করতে লাগলেন। মনুর প্রার্থনা শুনে সেই মহামস, শিং-ওয়ালা মাছের রূপ ধরে তাঁর সামনে উপস্থিত হলেন। মহাতপা মনু তখন দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে সেই মাছের শিং-এ বেঁধে দিলেন। সমুদ্রে তখন প্রলয়- তাণ্ডব চলছে। শিং-যুক্ত মহামৎসটি তখন প্রবল বেগে নৌকাটি টানতে লাগলেন । সপ্ত ঋষি সহ নৌকাটি তখন প্রবল হাওয়ায় টলমল করছিল। চতুর্দিকে শুধুই অন্ধকার । শুধু মহামস, মনু এবং সপ্ত ঋষি ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। মহামৎস কেবল একটানা পরিশ্রমের মাধ্যমে সাগর জলে নৌকাটিকে বহু বছর ধরে টেনে চলছিলেন।

যাইহোক, এক সময় হিমাচলের একটি উচ্চ শৃঙ্গ নজরে এলে মহামৎস নৌকাটিকে সেইদিকে টেনে নিয়ে চললেন। নৌকাটি যখন আরও কাছাকাছি এলো তখন মাছটি হাসতে হাসতে বললো— “হে তপোধনগণ! এই পাহাড়ের শৃঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য আপনারা নৌকাটি বেঁধে রাখুন।”

তাঁর কথা মতো তাঁরা তখন নৌকাটিকে বাঁধলেন। সেই থেকে হিমালয়ের ঐ শৃঙ্গটি নৌবন্ধনশৃঙ্গ বলে লোকমুখে প্রচারিত হয়েছে।

এরপর মহামৎস বললেন- “হে মহর্ষিগণ! আমি জগৎ পিতা প্রজাপতি ব্রহ্মা। মাছের রূপ ধারণ করে তোমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করলাম। এখন তুমি বৈবস্বত মনু, স্থাবর জঙ্গম, দেব, অসুর, মানুষ প্রভৃতি সকল প্রাণী জগৎ সৃষ্টি করবে। এই জগতে প্রাণ সৃষ্টি এবং প্রাণের বিকাশ সাধন কেবল তোমার দ্বারাই সম্ভব হবে।

জগৎ সৃষ্টি করার এই ক্ষমতা তোমার দ্বারা তপস্যার মাধ্যমেই সম্ভব হবে। আমি আশীর্বাদ করছি এই বলে যে, জগৎ সৃষ্টির কাজে তুমি কখনো মোহ-তাড়িত হবে না।”

এই বলে সেই মহামৎস হঠাৎ অদৃশ্য হলেন। বৈবস্বত মনু এরপর জগৎ সৃষ্টির খেলায় মেতে উঠলেন। প্রথমে তিনি ভীষণ তপস্যার মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করলেন, তারপর তিনি একে একে প্রজা সকল সৃষ্টি করতে লাগলেন।

মার্কণ্ডেয় ঋষি তখন যুধিষ্ঠিরকে বললেন- “হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ। আমি তোমাকে এই যে গল্প শোনালাম তা ‘মৎস উপাখ্যান' বলে জানবে।”


0 Reviews