ব্রহ্মতেজের মহিমা : ঋষি বশিষ্ঠ এবং ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বামিত্রের সংঘর্ষ

ব্রহ্মতেজের মহিমা : ঋষি বশিষ্ঠ এবং ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বামিত্রের সংঘর্ষ

Size

Read more

 ব্রহ্মতেজের মহিমা : ঋষি বশিষ্ঠ এবং ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বামিত্রের সংঘর্ষ

তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন গন্ধর্বরাজ চিত্ররথের কাছে মহর্ষি বশিষ্ঠের মহিমাময় জীবনী শুনে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— “হে গন্ধর্বরাজ! আমাদের পূর্বপুরুষদের পুরোহিত ঋষি বশিষ্ঠ কেমন ছিলেন ? কৃপা করে আমাকে তাঁর দেবোপম জীবন-কথা শ্রবণ করান।”

গন্ধর্বরাজ বললেন- “মহর্ষি বশিষ্ঠ ছিলেন ব্রহ্মার মানসপুত্র। তাঁর পত্নী হলেন অরুন্ধতী। অসহনীয় কৃচ্ছ্রসাধন ও তপস্যার দ্বারা তিনি অজেয় কাম ও ক্রোধকে বশীভূত করেছিলেন। ইন্দ্রিয়াদি বশীভূত ছিল বলেই তাঁর নাম হয়েছিল ‘বশিষ্ঠ’। বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠের একাধিক ক্ষতি করেছিলেন, তাতে বশিষ্ঠ এতটুকু ক্রুদ্ধ হননি বরং তিনি নিজগুণে তাঁর সকল অপরাধ ক্ষমা করেছিলেন। বিশ্বামিত্র বশিষ্ঠের একশত সন্তানকে বধ করেছিলেন। বশিষ্ঠের প্রতিশোধ নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ এবং ক্ষমতা থাকলেও তিনি তা প্রয়োগ করেন নি। তাঁর ক্ষমতা ছিল যমপুরী থেকে সন্তানদের ফিরিয়ে আনার; কিন্তু যমরাজের নিয়মকে সম্মান জানিয়ে তিনি তা করেন নি। ইক্ষ্বাকুবংশের রাজারা তাঁকে পুরোহিত করে পৃথিবী জয় করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্লোভ। আজন্ম অবলম্বন করে ছিলেন যোগী-ঋষির জীবন।”

অর্জুন পুনরায় প্রশ্ন করলেন— “গন্ধর্বরাজ! বশিষ্ঠ এবং বিশ্বামিত্র উভয়েই আশ্রমবাসী ছিলেন', অথচ তাঁদের মধ্যে বিরোধ বা দ্বন্দ্বের কথা শুনি- এর কারণ কী ?”

গন্ধর্বরাজ বললেন— “কান্যকুব্জ দেশে গাধি নামে এক বিখ্যাত রাজা ছিলেন। তাঁর পুত্র হলেন বিশ্বামিত্র। একদিন মৃগয়ার উদ্দেশে বিশ্বামিত্র অরণ্যে গিয়েছিলেন। অরণ্যে হরিণের সন্ধান করতে করতে একসময় তিনি ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে হাজির হলেন। বশিষ্ঠ তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান ও অভ্যর্থনা জানিয়ে গ্রহণ করলেন। মহর্ষির একটি কামধেনু ছিল-নন্দিনি। সেই ধেনুর কাছে যা প্রার্থনা করা হতো, সে তখনই তা প্রদান করতো। ঋষি বশিষ্ঠ সেই ধেনু দোহন করে তাতে অন্যান্য নানান বনজ বস্তু মিশিয়ে মিষ্টান্ন তৈরি করে রাজাকে খেতে দিলেন। গাভীটি দেখতে খুবই সুন্দর ছিল। বিশ্বামিত্র সেই গাভীটির নানান গুণে আকৃষ্ট হয়ে বললেন— “হে ব্রাহ্মণ! আপনি যথেচ্ছ সংখ্যক গোধন বা আমার সমগ্র রাজ্যটি গ্রহণ করে আপনার এই ধেনুটি আমাকে প্রদান করুন।”

বশিষ্ঠ বললেন— “মহারাজ! আমি এই গাভীটিকে দেবকার্য, পিতৃকার্য, অতিথি সৎকার, এমন কি যজ্ঞানুষ্ঠানের একমাত্র উপায় হিসাবে অবলম্বন করি। একে রাজ্যলোভে কোনমতেই আপনার হাতে তুলে দিতে পারবো না।”

বিশ্বামিত্র বললেন- “আমি ক্ষত্রিয়, আপনি ব্রাহ্মণ। ধীর-স্থির ব্রাহ্মণদের বলবীর্যের কথা কারুরই অজানা নয়। তবুও যথেচ্ছ সংখ্যক গোধন গ্রহণ করে যদি আপনি আমার ইচ্ছাপূরণ না করেন; তাহলে ক্ষত্রিয়দের মতো জোর করে আপনার এই নন্দিনিকে আমি নিয়ে যাবো।”

বশিষ্ঠ বললেন— “মহারাজা! তুমি মহাবলী ও পরাক্রান্ত রাজা। তুমি তোমার বিবেচনায় যা ভাল মনে করো, তাই করো।”

তারপর বিশ্বামিত্র সেই রূপময়ী নন্দিনীকে বলপূর্বক অপহরণ করলেন। নিরুপায় নন্দিনি লাঠি ও চাবুকের আঘাতে ব্যথা পেয়ে ‘হাম্বা’ ডাক দিতে দিতে দৌড়ে বশিষ্ঠের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাজার লোকেরা তখন তার উপর বল প্রয়োগ করতে থাকলেও সে মহর্ষির আশ্রম ত্যাগ করলো না।

বশিষ্ঠ বললেন— “ভদ্রে! আমি তোমার করুণ ‘হাম্বা' ডাক শুনছি। বিশ্বামিত্র তোমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। আমি ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণ। কি করি, বলো ?”

তখন নন্দিনি রাজা বিশ্বামিত্র ও তাঁর সৈন্যদের উৎপীড়নে ভীত হয়ে মহর্ষিকে বললেন- “ভগবন। রাজার লোকেরা আমাকে প্রচণ্ড প্রহার করছে। অনাথার ন্যায় আমি কাঁদছি। এমন সময় কেন আপনি আমাকে উপেক্ষা করছেন।”

মহর্ষি তখনও নিরুদ্বেগ থাকলেন, বললেন- “কল্যাণী, ক্ষত্রিয়দের শক্তি হ'ল তাদের ক্ষমতা। আমি ব্রাহ্মণ, আমার শক্তি হ'ল ক্ষমা। এখন তোমার যদি যেতে ইচ্ছা, তবে যাও।”

তখন নন্দিনি বললেন- “ভগবন। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চাইছেন না। কিন্তু যদি ত্যাগ না করেন, তাহলে আপনি জানবেন, জোর করে কেউই আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না।”

বশিষ্ঠ বললেন— “নন্দিনি! আমি তোমাকে ত্যাগ করতে চাই না। যদি তোমার সামর্থ্য থাকে তাহলে আমার আশ্রমে অবস্থান করো।”

নন্দিনি যখন বুঝতে পারলেন মহর্ষি তাকে আশ্রমেই দেখতে চাইছেন। তখন সে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে চোখ লাল করে ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো। সজোরে হাম্বা বর করতে করতে রাজার সৈন্যদের দিকে তেড়ে গেল। তখন সৈন্যরা লাঠির আঘাতে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও নন্দিনি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল। তার লেজের অগ্রভাগ থেকে অগ্নিবৃষ্টি হতে লাগল। তার গোবর থেকে কিরাত জাতি; মূত্র থেকে কাঞ্চীদেশীয়; পার্শ্বদেশ থেকে শবরকুল; মুখের ফেণা থেকে সিংহল, বর্বর চীন, হুণ, প্রভৃতি নানান জাতির উৎপত্তি হলো। সেই সব ভিন্ন জাতির লোকজনদের অতর্কিত আক্রমণে বিশ্বামিত্রের সৈন্যদল প্রাণভয়ে পালাতে লাগালো। কিন্তু লক্ষণীয় হল, বিশ্বামিত্রের একটি সৈন্যও ঐ আক্রমণে প্রাণ হারাল না।

মহারাজ বিশ্বামিত্র ব্রহ্মতেজ-সম্ভূত এই অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে বললেন— “ক্ষত্রিয় বলে ধিক্ । ব্রহ্মতেজই মহাবল। তপোবলেই লুকিয়ে আছে মহাবলের সন্ধান । আমি স্থির সিদ্ধান্ত নিলাম যে, সমস্ত রকম ভোগ-সম্পদ, রাজ্যপাট ত্যাগ করে এরপর আমি তপস্যায় মনোনিবেশ করবো।”

কালক্রমে সুদীর্ঘ তপস্যা ও কৃচ্ছ্রসাধন করে তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। সবশেষে, ব্রাহ্মণত্ব লাভ করে তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে সোমরস পান করেছিলেন। এমনই শক্তিশালী ছিল ব্রহ্মতেজের মহিমা।


0 Reviews