মহর্ষি মুদ্‌গলের কথা

মহর্ষি মুদ্‌গলের কথা

Size

Read more

 মহর্ষি মুদ্‌গলের কথা

ব্যাসদেব বললেন— “হে ধৰ্মনন্দন! মহর্ষি মুদ্‌গল এক দ্রোন ধান কাকে কিভাবে দান করতেন, তা নিয়ে একটি প্রাচীন ইতিহাস আছে। আমি তা বর্ণনা করছি। মন দিয়ে শুনুন।”

কুরুক্ষেত্রে সত্যবাদী, নিরহঙ্কারী, জিতেন্দ্রিয় মুদ্‌গল নামে এক মহাত্মা ঋষি থাকতেন। তিনি নানারকম ধর্মকর্ম, অতিথিসেবা এবং নামমাত্র উচ্ছিষ্ট ভোজন গ্রহণ করে দিন কাটাতেন। তিনি ‘ইষ্টীকৃত’ এবং ‘দর্শপৌর্ন মাস’ নামক দুটি বিশেষ যজ্ঞ করতেন। তিনি কপোতবৃত্তি (একটু একটু করে সঞ্চয়) করে এক পক্ষে (পনের দিন) এক দ্রোণ ধান সংগ্রহ করতেন। পক্ষ শেষ হলে তা দিয়ে দেবতা ও অতিথি সেবা করে অবশিষ্ট যা থাকতো, তার সাহায্যে স্ত্রী-পুত্র সহ নিজের দেহরক্ষা করতেন। তাঁর যজ্ঞক্রিয়া এতখানি আবেদনশীল ছিল যে, দেবরাজ ইন্দ্ৰ সহ অন্যান্য দেবগণ তাঁর যজ্ঞে উপস্থিত হতেন এবং নিজ নিজ ভাগ গ্রহণ করতেন। তাঁর অন্তঃকরণ এতটাই বিশুদ্ধ ছিল যে, যজ্ঞে অতিথিগণ আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এক দ্রোণ ধান ঈশ্বরের কল্যাণে বাড়তে থাকতো । তিনি তা দিয়ে অনায়াসে শত শত অতিথি, ব্রাহ্মণ সৎকার করতে পারতেন।

মহর্ষি দুর্বাসা লোকমুখে মহর্ষি মুদ্‌গলের এমন অভূতপূর্ব জীবন কাহিনী শুনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা হলো। একদিন উদ্‌ভ্রান্তের মতো লঘু-গুরু কথা বলতে বলতে তিনি মহর্ষি মুদ্‌গলের কাছে এলেন। বললেন— “হে দ্বিজোত্তম! আমি উপোসী হয়ে আপনার কাছে এসেছি।”

মুদ্‌গল তা শুনে খুশি হলেন। ভক্তিভরে তাঁকে স্বাগত জানালেন। তারপর পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমন এবং সবশেষে অন্ন দিয়ে অপ্যায়ণ করলেন। মহর্ষি দুর্বাসা অত্যন্ত ক্ষুধার সঙ্গে গৃহস্থের সকল অন্ন খেয়ে ফেললেন। সবশেষে অন্নপাত্রের উচ্ছিষ্ট অন্নটুকু গায়ে মেখে সেখান থেকে বিদায় নিলেন। এরপর দ্বিতীয় যজ্ঞের দিনও তিনি এলেন এবং যথারীতি আগের মত অন্নভোজন করলেন।

বাস্তবে মহর্ষি দুর্বাসার এই আচরণ মুদ্গল ঋষি পরিবারটিকে অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু মহর্ষি মুদ্‌গল ছিলে জিতেন্দ্রিয়। তাই ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কোং, অভিমান, লোভ, অহংকার কোন কিছুই তাঁকে বিচলিত করতে পারল না। মহর্ষি তখন সব কিছু ভুলে গিয়ে তাঁর উচ্ছবৃত্তি সম্বল করে একটু একটু অন্ন সংগ্রহ করতে থাকলেন। অন্যদিকে, মহাতপা দুর্বাসা একইভাবে সংগৃহীত ভোজ্য একাই ভক্ষণ করে শেষ করে দিচ্ছিলেন। এভাবে মোট ছ'বার সকল অন্ন ভোজন করার পর মহর্ষি দুর্বাসা দেখলেন মহাতপা মুদ্‌গল অচঞ্চল এবং বিশুদ্ধমনাই রয়েছেন।

মুনি দুর্বাসা আর এই পরীক্ষা নেওয়ার খেলাটি না চালিয়ে একদিন এসে বললেন- “হে মহাত্মা মুগল, তোমার মত নিরহঙ্কারী, বিশুদ্ধচিত্ত, জিতেন্দ্রিয়-পুরুষ পৃথিবীতে বিরল। হে ঋষিশ্রেষ্ঠ, ক্ষুধা এমন একটি জিনিস যা, মানুষের ধর্ম, জ্ঞান ও ধৈর্যকে নাশ করে। রসনা রাসের দিকেই ধাবিত হয়। প্রাণ আহারের টানে দেহে অবস্থান করে। মন এতই চঞ্চল যে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। ইন্দ্রিয়গণ সহ মনের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করাই হলো তপস্যা। আর তুমি হলে তপস্যার প্রতিমূর্তি।

হে মহাত্মা। পরিশ্রম করে অর্জন করা যে কোন বস্তু ত্যাগ করা মোটেই সহজ নয়। আমি তোমার জীবন চর্যা দেখে অভিভূত। দম, শাম, দয়া, সত্য, ধর্ম, ধৈর্য্য, ইন্দ্রিয়সংযম— সব কিছুই তোমার মধ্যে উজ্জ্বল রূপে বর্তমান। স্বর্গবাসীরাও তোমার যশোগাথা গাইতে উদগ্রীব। তুমি খুব শীঘ্র সশরীরে স্বর্গলোক প্রাপ্ত হবে।”

মহর্ষি দুর্বাসা এমন দেবোপম উক্তি করা মাত্র সেখানে বিমান যোগে এক দেবদূত আবির্ভূত হলেন। বিমানটি ছিল দিব্য হংস ও দিব্য সারস যুক্ত। তা থেকে পারিজাত সুগন্ধও নিঃসৃত হচ্ছিল। বিমানটি মনোরথ চালিত। দেবদূত মহর্ষিকে বললেন— “মুনিবর! এই বিমান আপনি আপনার অত্যাশ্চর্য জীবনব্রত থেকে লাভ করেছেন। আপনি মহাযোগী, সিদ্ধ পুরুষ। দয়া করে এই বিমানে উঠে বসুন।”

দেবদূতের কথা শুনে মহর্ষি মুদগল বললেন — “ হে দেবদূত! সৎ পুরুষেরা একসঙ্গে সাত পা হাঁটলে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তুমি তাই আমার সুজন, আমার বন্ধু। তোমার কাছে আমার কিছু জেনে নেওয়ার আছে। আমার জিজ্ঞাস্য হ'লো স্বর্গে কী সুখ আছে ? এবং সেখানে দোষ-ত্রুটি বা কী ?”

দেবদূত বললেন- “হে মহবি। আপনি এত বুদ্ধিমান। অন্য কেউ স্বর্গসুখের সুযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিতেন। আর স্বর্গসুখ আপনার হাতের মুঠোয় অথচ আপনি তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ বা প্রশ্নমুখর ? তবে আপনার মনে যখন এত কৌতূহল আর আপনি চাইলে তা নিজেই বুঝে নিতে পারেন; তবুও সুজন হিসাবে আপনার কৌতূহল নিরসনের জন্য আমি সকল বৃত্তান্ত তুলে ধরছি।

স্বর্গলোক এখান থেকে অনেক উপরে অবস্থিত। সেখানে বিমানে চড়ে সকলে যাতায়াত করেন। একমাত্র উত্তম লোকেরাই সেখানে যেতে পারেন। মিথ্যাবাদী, ঠক, প্রবঞ্চক, ধূর্ত, নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোকদের সেখানে কোন স্থান নেই। যাঁরা ধর্মপ্রাণ, জিতেন্দ্রিয়, শম, দম সম্পন্ন; দ্বেষহীন এবং দানশীল তাঁরাই সেখানে যেতে পারেন। তাছাড়া যাঁরা যথার্থ কর্মবীর তাঁরাও তার অধিবাসী হতে পারেন। তবে সেখানে দেবতা, সাধু, বিশ্বদেব, মহর্ষি, গন্ধর্ব, অপরা— এদের প্রত্যেকের জন্য পৃথক পৃথক লোক আছে। সেখানে ভোগ্য বস্তুগুলি ইচ্ছা করলেই পাওয়া যায়। গোটা স্বর্গলোক তেত্রিশ হাজার যোজন বিস্তৃত, আলোকময়। তেজঃপূর্ণ। তাতে একটি সুউচ্চ পর্বত আছে- সুমেরু পর্বত, সেটি সোনার তৈরি।

এই স্থান পুণ্যাত্মাদের বিচরণক্ষেত্র। সেখানে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ভয়, গ্লানি কোন কিছু নেতিবাচক অনুভূতির প্রকাশ নেই। চতুর্দিকে শুধুই সুখ এবং রমনীর সুখস্পর্শের ক্লান্তিহীন সঞ্চরণ। শ্রবণ এবং মননে শুধুই শ্রুতি মধুর শব্দ ও আনন্দের হিল্লোল ধ্বনিত হয়। সেই স্থান শোক, অনুতাপ, জরা, ব্যাধি, দুঃখ বিমোহিত। সেই স্থান ঘাম, মল, মূত্র, দুর্গন্ধ ও অন্যান্য অপবিত্র বস্তু মুক্ত। সেখানে যৌবন চিরস্থায়ী। বার্ধক্য কখনোই শরীরকে স্পর্শ করতে পারে না। সেই স্থান শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর প্রকাশ- মুক্ত। সবসময় বসন্তের মত রমণীয় এককালীন প্রবৃত্তি বিরাজ করে। স্বর্গবাসীদের শরীর পুণ্য কর্মের দ্বারা প্রাপ্ত। মাতা-পিতার দ্বারা নয়। সেখানে নেই কোন বিভেদ, নেই কোন হিংসা। এই যে বিমানটি দেখছেন, স্বর্গবাসী প্রত্যেকেরই এরকম নিজস্ব বিমান আছে। হে মুনিবর। জগতে এটিই সবথেকে উৎকৃষ্ট লোক। তবে স্বর্গলোকের মধ্যে অনেকগুলি দিব্যলোকের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়।

স্বর্গলোকের পূর্বদিকে রয়েছে তেজোময় ব্রহ্মলোক। শুধুমাত্র পবিত্র স্বভাব মুনি- ঋষিরাই নিজ নিজ শুভ কর্মফলে সেখানে যেতে পারেন। সেখানে ঝতু নামে একজন দেবতা আছে, যাঁকে দেবতারাও পূজা করেন। এই লোক উজ্জ্বল প্রতা সম্পন্ন, অভীষ্ট ফলদায়ক। তাঁদের শরীর দিব্য এবং অনির্বচনীয়। তাঁদের কোন আকৃতি বা মূর্তি নেই । তাঁরা কামনা-রহিত । তাঁদের জরা, মৃত্যু, ভয়, শোক, রাগ, ক্ষোভ, দ্বেষ কোন কিছুই নেই। এই দুষ্প্রাপ্য পরম গতি দেবতাদের কাছেও অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত। অবশ্য এই লোক বিষয় ভোগীদের কাছে কখনোই গমনযোগ্য নয়। কেবলমাত্র মনীষীগণ তাঁদের বিস্ময়কর নিয়মব্রত ও অন্যান্য পুণ্যকর্মের জন্য এই লোক প্রাপ্ত হন। আপনিও সেই সুকৃতির কারণে এই লোকের অধিবাসী হতে চলেছেন।

হে মুনিবর! এতক্ষণ আমি স্বর্গসুখের গুণগুলি তুলে ধরেছি। এর কিছু দোষ বা ত্রুটিও আছে। সেগুলি বলছি, তা শুনুন—

স্বর্গে আপনি আপনার অর্জিত কর্মফল জনিত সুখ ভোগ করতে পারেন। সেখানে নতুন কোনো কর্ম করা যায় না। কেবলমাত্র পুঁজি বা আসল ভাঙিয়েই তা ভোগ করতে হয়। আমার বিচারে স্বর্গসুখের এটিই একমাত্র দোষ । যে কোন জিনিসের যেমন শেষ আছে, তেমনি স্বর্গসুখও একদিন শেষ হবে। তখন এই সুখ হঠাৎ করে চলে গেলে প্রাণীদের আবার নিম্নগতি হবে। তখন তা মানিয়ে নেওয়া খুবই বেদনাদায়ক। যখন দেখবেন স্বর্গলোকে কোনো বাসিন্দার গলার মালা শুকাতে শুরু করেছে, তখন জানবেন তাঁর পতনের সময় শুরু হয়েছে। তখন তাঁদের শরীরে রজোগুণের প্রভাব ধীরে ধীরে ক্রিয়াশীল হচ্ছে। আর পতিত হওয়ার সময় তাঁদের বুদ্ধি ও চেতনা লোপ পাবে। ব্রহ্মলোক পর্যন্ত যত লোক আছে, সব ক্ষেত্রেই এই ভয় বিরাজমান।

স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে যাঁরা পতিত হন, তাঁদের কোন অধমগতি হয় না। অর্থাৎ তাঁরা শুধুই মনুষ্যলোকে জন্মান। খুব বিচার বিবেচনা করে যদি কেউ স্বর্গলোকে বাস না করেন তাহলে তাঁকে পুনরায় অধোগামী হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয়। আর পৃথিবী হলো কর্মময়, কর্মভূমি। স্বৰ্গলোক-সুখময়, ফলভূমি। ইহলোকে কর্ম করলে পরলোকে তার ফল ভোগ হয় ।

হে মুনিবর! আপনি যা জানতে চেয়েছেন, তা আমি আমার জ্ঞান বোধ মত সব বললাম। এখন আর দেরি নয়। অনুমতি করুন। আমরা যাত্রা করি।”

মহর্ষি মুল বললেন- “হে দেবদূত! তোমার কথা শুনে স্বর্গলোকে যাওয়ার কোন উৎসাহ আমি পাচ্ছি না। কারণ স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে পতিত হওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই। স্বর্গের এত সুখ ভোগ করার পর পুনরায় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার বাসনা আমার একদম নেই। তাই আমি স্বৰ্গলোকে যাচ্ছি না। আমি সেই লোক প্রাপ্ত হতে চাই যেখানে জীবনের ধূসর বা মলিন বিষয়গুলি চিরকালের মত বিলীন হবে। আমি প্রাণপণে সেই স্থানের অন্বেষণ করতে থাকব।”

দেবদূত তখন বললেন- “ব্রহ্মসদনের ওপরে পরমোৎকৃষ্ট, বিশুদ্ধ, জ্যোতির্ময় বিষ্ণুপদ আছে। লোকে তাকে পরব্রহ্ম বলেন। হে বিপ্রশ্রেষ্ঠ! সেখানে শুধুমাত্র নির্মল, নিরহঙ্কার, নির্দ্বন্দ্ব, জিতেন্দ্রিয় যোগী তাপসেরাই যেতে পারেন।”

তখন মহাত্মা মুদ্‌গল দেবদূতকে বিদায় জানিয়ে পুনরায় উদ্ধবৃত্তি দ্বারা জীবন নির্বাহ

করতে লাগলেন। এরপর তিনি এমন এক মানসিক অবস্থায় পৌঁছালেন যখন তিনি নিন্দা ও প্রশংসা, লোহা ও সোনার মধ্যে কোন বিভেদ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি জ্ঞান শলাকায় উত্তপ্ত হয়ে নির্মল, স্থিতধী ও শান্ত প্রকৃতির হয়ে গেলেন। একদিন ধ্যানযোগে সেই পরমোৎকৃষ্ট মুক্তিপদ লাভ করলেন। এমনই উজ্জ্বল ও উৎকৃষ্ট ছিল মুল ঋষির সাধন-জীবন।


0 Reviews