মহর্ষি বশিষ্ঠের ক্ষমা কৰ্ম্মাষপাদের গল্প

মহর্ষি বশিষ্ঠের ক্ষমা কৰ্ম্মাষপাদের গল্প

Size

Read more

  মহর্ষি বশিষ্ঠের ক্ষমা কৰ্ম্মাষপাদের গল্প

গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ বললেন- হে তৃতীয় পাণ্ডব! রাজা ইক্ষ্বাকুর বংশে কৰ্ম্মাষপাদ নামে এক নৃপতি ছিলেন। তিনি একদিন শিকারের উদ্দেশ্যে বনে গিয়েছিলেন। মৃগয়া শেষে ফেরার সময় তিনি এমন একটি সংকীর্ণ পথ ধরেছিলেন, যাতে শুধু একজন মানুষই চলতে পারেন। যাইহোক, রাজা ছিলেন তখন পরিশ্রান্ত এবং ক্ষুধার্ত। হঠাৎ দেখলেন বিপরীত দিক থেকে শক্তিমুনি আসছেন। শক্তিমুনি হলেন বশিষ্ঠ মুনির শতপুত্রদের সর্বজ্যেষ্ঠ। রাজা বললেন- “মুনিবর। সরে যান, আমাকে যেতে দিন।”

শক্তিমুনি বললেন— “মহারাজ! আমি ব্রাহ্মণ, তাই ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য হলো ব্রাহ্মণের জন্য পথ ছেড়ে দেওয়া।”

এরপর উভয়ের মধ্যে বিস্তর কথা কাটাকাটি হলো। ঋষিও অনড়, রাজাও রাস্তা থেকে সরবেন না। রাজার হাতে চাবুক ছিল, হঠাৎ তিনি বিচারবোধ হারিয়ে উত্তেজিত হয়ে ঋষিকে কশাঘাত করে বসলেন।

শক্তিমুনি তখন ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে রাজাকে বললেন— “আরে অধম রাজা! তুমি রাক্ষসের মতো ব্রাহ্মণ-মুনি-ঋষির ওপর শক্তি প্রয়োগ করছো ? তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি— “তুমি এখনই রাক্ষস হয়ে যাও।”

মুনির অভিশাপে কল্মাষপাদ তখনই রাক্ষস-মনোভাবসম্পন্ন হয়ে গেলেন। তিনি বললেন- “আপনি আমাকে বিনা কারণে অভিশাপ দিয়েছেন। এবার দেখুন, আমি আপনাকে দিয়েই কিভাবে রাক্ষস-বৃত্তি শুরু করছি।”-এই বলে কশ্মাষপাদ শক্তিমুনিকে হত্যা করে সেখানেই তাঁকে খেয়ে ফেললেন।

এরপর রাজা কশ্মাষপাদ বশিষ্ঠ মুনির বাকি পুত্রদের একে একে হত্যা করে উদরস্থ করলেন। শক্তিমুনি সহ ঋষি বশিষ্ঠের অন্য পুত্রদের ভক্ষণ করে কশ্মাষপাদের মধ্যে রাক্ষসভাবটি তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। অন্যদিকে রাজা বিশ্বামিত্র ঈর্ষান্বিত হয়ে কিংকর-নামের এক রাক্ষসকে পাঠালেন কশ্মাষপাদের মধ্যে প্রবেশ করতে যাতে কৰ্ম্মাষ পাদ আরও বেশি হিংস্র ও আক্রমণাত্মক হন। বশিষ্ঠ মুনি বিশ্বামিত্রের এই জঘন্য কীর্তিকলাপ জানতেন। তা সত্ত্বেও তিনি শান্ত ছিলেন। প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি সচেষ্ট হননি তা করার।

পুত্রশোকে কাতর ঋষি বশিষ্ঠ এরপর আশ্রমে মন বসাতে না পেরে নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়লেন। কিছু পথ অতিক্রম করার পর দেখলেন বর্ষার জলে পুষ্ট হয়ে একটি নদী পাড়ের গাছপালা উপড়ে তীব্র বেগে বয়ে নিয়ে চলেছে। শোহাকত ঋষি ভাবলেন, এই স্রোতস্বিনী নদীতে প্রাণ বিসর্জন দেবেন। এই বলে দড়ি দিয়ে নিজেকে শক্ত করে বেঁধে ভরা নদীতে ঝাঁপ দিলেন। কিন্তু নদী ঋষির বন্ধন ছিন্ন করে তাঁকে তীরে এনে তুলে দিল। এই ঘটনার পর তিনি নদীটির নাম রাখলেন 'বিপাশা' (পাশ- বিমুক্ত)।

তারপর কুমিরে ভর্তি হৈমবতী নামে আর এক নদীতে ঋষি ঝাঁপ দিয়ে প্রাণত্যাগ করার চেষ্টা করলেন । নদী ব্রাহ্মণকে আগুনের মত বিবেচনা করে শতধারায় ভাগ হয়ে গেল । সেই থেকে নদীটির নাম হলো ‘শতদ্রু’। ঋষি বশিষ্ঠ আত্মঘাতী হতে ব্যর্থ হয়ে তখন আশ্রমে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তাঁর মনে হল কেউ যেন ষড়াঙ্গাদি সহ বেদপাঠ করতে করতে তাঁকে অনুসরণ করছে। ঋষি মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করলেন— “কে তুমি ?”

উত্তর পাওয়া গেল— “আমি আপনার পুত্রবধূ শক্তি-পত্নী; অদৃশ্যান্তী।”

ঋষিবর বললেন— “আগে শক্তির মুখে যেমন সাঙ্গবেদধ্বনি শুনতাম, তেমনি ষড়ঙ্গ বেদ কে পাঠ করছে ?

অদৃশান্তী বললেন— “আমার গর্ভে আপনার পৌত্র! সে বারো বছর ধরে মাতৃগর্ভে এভাবে বেদ অধ্যয়ন করে চলেছে।”

ঋষি বশিষ্ঠ পুত্রবধূ অদৃশ্যান্তীর কথায় খুশী হলেন। ভাবলেন, আমার বংশ- পরম্পরা তাহলে লোপ পায়নি। মন থেকে তখন তাঁর আত্মঘাতী হওয়ার বাসনা দূর হলো। এরপর পুত্রবধূ সহ হাঁটতে হাঁটতে পথে অকস্মাৎ কশ্মাষপাদের সঙ্গে তাঁদের দেখা হলো। রাক্ষসভাবাবিষ্ট রাজা কশ্মাষপাদ মহর্ষিকে দেখে তাঁকে গ্রাস করার জন্য এগিয়ে আসছিলেন। তা দেখে তাঁর পুত্রবধূ বললেন— “ভগবান। কালদণ্ড হাতে নিয়ে যমদূতের মতো এক রাক্ষস এদিকে এগিয়ে আসছে। আপনি ছাড়া একে আটকানো আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এর থেকে আমাকে বাঁচান।”

মহর্ষি প্রত্যুত্তরে বললেন— “পুত্রী! তুমি ভয় পেয়ো না । এই রাক্ষস থেকে তোমার 

কোনরূপ ভায়ের আশঙ্কা নেই। এই রাক্ষস হলো কার্যপাদ নামে এক রাজা। শক্তির অভিশাপেই তাঁর এই পরিণতি।”

– এই বলে সেই তেজস্বী ঋষি হুঙ্কার দিয়ে রাক্ষসের গতিরোধ করলেন। তারপর মন্ত্রঃপূত জল ছিটিয়ে যোগবলে তার শাপমোচন করলেন।

সামান্য পারে রাজা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন এবং জোড়হাত করে ঋষিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠকে বললেন- “হে ঋষিবর! আমি ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা, কস্মাৎপাদ। আমি আপনার যজমান। আমার সকল অপরাধ মার্জনা করুন। আমাকে যথাযোগ্য আদেশ দিয়ে ধন্য করুন।

ক্ষমার প্রতিরূপ, ঋধিসত্তম বশিষ্ঠ বললেন- “মহারাজ! আপনার অভিশপ্ত জীবনকাল শেষ হয়েছে। আপনি নিজের রাজ্যে ফিরে যান। মন দিয়ে রাজ্য শাসন করুন। তবে হ্যাঁ, আর কখনো ব্রাহ্মণকে অপমান করবেন না।”

রাজা প্রত্যুত্তরে বললেন- “হে মহাভাগ! আমি আর কখনো ব্রাহ্মণকে অবহেলা বা অবমাননা করব না। বরং আপনার নির্দেশমতো তাঁদের যথাযোগ্য ভক্তি সম্মান করে অর্চনা করবো। আর একটি প্রার্থনা, আমার পূর্ব পুরুষদের ঋণ শোধ করার জন্য আমি যাতে একটি সুসন্তান লাভ করি— সেই আশীর্বাদ করুন।”

ক্ষমাশীল কবি বশিষ্ঠ প্রত্যুত্তর করলেন- “তথাস্তু”।

অন্যদিকে অদৃশ্যন্তী যথা সময়ে এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ করলেন। জন্মগ্রহণের পর ভগবান বশিষ্টদের পৌত্রের জাতকর্মাদি সম্পন্ন করলেন। জাতকের নাম দিলেন 'পরাশর। শক্তিলন পরাশর মহর্ষিকে পিতা বলেই জানতেন এবং পিতৃজ্ঞানে তাঁকে পূজা করতেন।

একদিন মাত্রা অদৃশ্যন্তী পুত্রকে ডেকে বললেন- “বৎস। মহর্ষি তোমার পিতা নন, তিনি তোমার পিতামহ।” তখনই তিনি জানতে পারলেন যে বনের মধ্যে এক রাক্ষস কিভাবে তাঁর পিতাকে খেয়ে ফেলেছিল।

মায়ের কথায় শক্তিপুত্র ভীষণ দুঃখ পেলেন এবং তখনই পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলেন। তিনি ঠিক করলেন যে, সকল রাজাদের তিনি পরাস্ত করবেন। একথা ঋষিবরের কানে গেলে তিনি পরাশরকে বললেন- “তুমি এদের ক্ষমা করে দাও। এতেই তোমার মঙ্গল হবে। জানবে যে, ক্ষমাই মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম।” রাজারা রাজ্যপালন করেন, প্রজাদের নিরাপত্তা দেন। তাঁদেরও কখনো কখনো ভুল- ভ্রান্তি হয়। এ জগতে রাজাদেরও প্রয়োজন আছে। তাঁরা না থাকলে সাধারণ মানুষ,

প্রজাকুল, অসহায় হয়ে পড়বে। রাজারাই তাদের বল, তাদের ভরসা।”

পিতামহ বশিষ্ঠের পরামর্শে পরাশর সে সময় রাজাদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা ত্যাগ করলেন। কিন্তু, পিতৃহত্যার বেদনা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারলেন না। তখন তিনি রাক্ষসদের বিনাশ করার জন্য এক ভয়ংকর যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সেই যজ্ঞে দলে দলে রাক্ষসের মৃত্যু হতে লাগলো। পরিস্থিতি বিচার করে পুনরায় ঋষি বশিষ্ঠ হস্তক্ষেপ করলেন। পরাশরকে বললেন— “পৌত্র! ক্ষমাই পরম ধর্ম। তুমি সেই ধর্মের অনুসারী হও। এখুনি রাক্ষস নিধন যজ্ঞ বন্ধ করো। তোমার পূর্বপুরুষেরা ক্ষমার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে স্বর্গলাভ করেছেন। তুমি তা থেকে বিচ্যুত হয়ো না। মানুষ বিনা কারণে কখনো কখনো মৃত্যুর কারণ হয়ে যায়। তুমি ক্রোধ সংবরণ করো।”

ঋষি প্রবরের আদেশকে পরাশর উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি তখন সকলকে ক্ষমা করে দিলেন। তারপর তিনি সেই যজ্ঞের অগ্নি হিমালায়ে রেখে এলেন। মানুষের বিশ্বাস সেই অগ্নি আজও রাক্ষস, গাছপালা, এবং পাথরকে দগ্ধ করে চলেছে।

ঋগ্বেদের রচয়িতা ঋষি বিশ্বামিত্র বাঁকে মোট আঠারো সূক্তের একক এবং ছয় সূক্তের সহ রচয়িতা হিসাবে পাওয়া যায়। অনেকে বলেন বেদের সার যে গায়ত্রী ম উচ্চারিত হয়, সেই মন্ত্রের স্রষ্টা হলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। সেই সঙ্গে যাত্রদের তৃতীয় মণ্ডলের সমস্ত মন্ত্রগুলির এটা রচয়িতা হলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। আসলে তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয় রাজা। পরে জপ, তপ, কৃচ্ছ্রসাধন ও অন্যান্য কাঠার ধর্মানুষ্ঠানের দ্বারা তিনি ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছিলেন। ঋগ্বেদে দশরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ বলে একটি বিখ্যাত যুদ্ধের বর্ণনা আছে। ঐ যুদ্ধে ভরত, যদু, দ্রব্য ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর নেতাদের পুরোহিত ছিলেন বিশ্বামিত্র।

অন্যদিকে বশিষ্ঠ হলেন সপ্ত ঋষিদের একজন ঋষি। ইনি ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডল সহ অন্যান্য বেদের ঋষি। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল অরুন্ধতী। অক্ষমালা নামক এক পুত্রকন্যার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক হয়েছিল। ঋষিবরের সংস্পর্শে এসে পরে তিনি পরম গুণবর্তী এক নারী হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। এই ঋষির নামে উত্তর-পূর্ব আকাশে একটি তারা আছে। বশিষ্ঠ এবং অগস্ত্য উভয়েই মিত্র (তেজোময় সূর্য) ও বরুণের পুত্র ছিলেন। তাঁর একাধিক নামের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো মৈত্রাবরুণ, মৈত্রাবারুণি— ঘটজ, ঘটোস্তব, কুস্তজ, কুস্তযোনি ইত্যাদি। তিনি ছিলেন সুদাম রাজার পুরোহিত।

আলোচ্য গল্পে এই দুই মহান আত্মার দ্বন্দ্বমূলক যে গল্পটি তুলে ধরা হয়েছে তা মহাভারতের আদিপর্বে একশ পঁচাত্তরতম অধ্যায়ে বর্ণিত আছে।


0 Reviews