Read more
চ্যবন উপাখ্যান
মহাতেজ চ্যবন ছিলেন ভৃগু মুনির পুত্র। রাক্ষস পুলোমা যখন ভৃগুর স্ত্রী'কে হরণ করছেন, তখন চ্যবন মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে দুরাত্মা রাক্ষসকে ভস্ম করেন। চ্যবনের পুত্র (পত্নী— আরুষীর গর্ভজাত) ঔবমান হলেন ক্ষত্রিয় সংহারক পরশুরামের পিতামাতা। মহাতপস্বী চ্যবন জানতেন যে, কুশিক বংশ থেকে তাঁর বংশে ক্ষাত্রধর্ম সংক্রামিত হবে, তাই তিনি কুশিক বংশ দগ্ধ করার জন্য কুশিকের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর ভাবনা ছিল এই যে, আতিথ্যে কোনোরকম ত্রুটি দেখলেই তিনি অভিশাপ দিয়ে উদ্দেশ্য পূরণ করবেন। কিন্তু চ্যবনের সকল ইচ্ছা ও আবদার কুশিক দম্পতি পূরণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁদের আন্তরিক সেবা-যত্নে মহামুনি কোনো ত্রুটি খুঁজে পাননি। তখন তিনি প্রসন্ন হয়ে একদিন জানালেন যে, কেন তিনি তাঁদের আতিথ্য নিয়েছিলেন। তখন তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে, কুশিকের পৌত্রী (গাধির কন্যা) ভৃগুবংশোদ্ভূত জমদগ্নিকে বিবাহ করে পরশুরাম নামে যে মহাতেজা জন্ম নেবেন; তিনিই ক্ষত্রিয়কুলকে ধ্বংস করবেন। এমনই মহিমাময় তেজোদ্বীপ্ত ঋষিশ্রেষ্ঠ চ্যবনের জীবনের অনেক ঘটনাকে অনুসরণ করে লেখা এই গল্পটি মহাভারতের ‘বনপর্বের' ১২১-১২৩ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে।
পাণ্ডবগণ বনবাসকালে বিভিন্ন তীর্থ দর্শন করতে করতে এক সময় নর্মদা নদীর তীরে এলে লোমশ ঋষি বললেন- “হে রাজন! বৈদুর্য্য পর্বত দর্শন এবং নর্মদা নদীতে স্নান করলে দেবলোক ও রাজলোক প্রাপ্ত হওয়া যায়। এখানে এলে সকল পাপ দূর হয়। এই দেখুন, এখানে রাজা শর্য্যাতির যজ্ঞস্থান শোভা পাচ্ছে। এখানে স্বয়ং ইন্দ্র অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সঙ্গে বসে সোমরস পান করছিলেন। এখানে মহাতপা চ্যবন ইন্দ্রের প্রতি
ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে অবাক করে দিয়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে যজ্ঞের ভাগীদার করেছিলেন। এখানেই একসময় মহামুনি চ্যবন পুনর্যৌবন লাভ করেছিলেন।”
যুধিষ্ঠির বললেন- “হে মহাভাগ! মহাতপা ভৃগু নন্দন চ্যবন কেন এবং কিভাবে ইন্দ্রকে হতবাক করে দিয়েছিলেন, তা সবিস্তারে বলতে আজ্ঞা হয়। ”
লোমশ তখন বললেন- “হে ধর্মাত্মা! মহর্ষি ভৃগুর ‘চ্যবন' নামে এক পুত্র জন্মালে একটি সরোবর তীরে সেই পুত্র তখনই তপস্যা শুরু করলেন। তিনি বীরাসনে স্থির হয়ে বসে দীর্ঘদিন ঐভাবে তপস্যা-মগ্ন রইলেন। ক্রমে তাঁর শরীরের উপর লতা-গুল্ম ইত্যাদি জড়িয়ে ধরল এবং পিঁপড়ে জড় হয়ে উইঢিপির (বশ্মিক) মত দেখতে লাগলো । এভাবে তপস্যারত ভার্গব কিছুকাল পর মৃৎপিণ্ডের আকার ধারণ করলেন। সাধারণভাবে দেখে তাঁকে তখন চেনা যাচ্ছিল না। বহুদিন এভাবে চলার পর শর্য্যাতি নামে এক রাজা বেড়ানোর জন্য সস্ত্রীক সেই সরোবর তীরে এলেন। তাঁর চার হাজার পত্নী হলেও সুকন্যা নামে একটি মাত্র মেয়ে ছিল। সুকন্যা সখীদের সঙ্গে গাছপালা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি একসময় সেই বশ্মিকের কাছে এলেন। সুকন্যা ছিলেন রূপবতী। কিন্তু তাঁর মধ্যে পরিণতি বোধ ছিল না। তিনি অবুঝের মতো যৌবনের প্রাচুর্যে গাছ-গাছালি, ফুল- ফল ইত্যাদি- বনানীর সৌন্দর্য নষ্ট করতে লাগলেন।
অন্যদিকে চ্যবন এই অরণ্য মধ্যে সুন্দরী, সুবেশা, নানা অলংকারে সজ্জিতা এই মেয়েটিকে দেখে পুলকিত হয়ে বার বার ডাকতে লাগলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে তপস্যারত এবং দুর্বল ছিলেন। তাই তাঁর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত ক্ষীণ ছিল। সে কারণে তাঁর ডাক রাজকন্যা সুকন্যা শুনতে পান নি। তবে সেই ঢিবির মধ্যে জোনাকির ন্যায় কিছু জ্বল জ্বল করছিল, যা তাঁর নজরে এসেছিল। কৌতূহলী হয়ে ‘এটা কি’–এই বলে একটি কাঁটা দিয়ে মুনিবরের চোখ দুটি হঠাৎ তিনি বিদ্ধ করলেন। চোখে আচমকা এমন আঘাত পেয়ে মুনিবর তখন ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন এবং মন্ত্রবলে শর্য্যাতিরাজের সকল সৈন্যদের মল-মূত্র ত্যাগ করা বন্ধ করে দিলেন। ফলে সৈন্যরা এক অদ্ভূত বিড়ম্বনার মধ্যে পড়লো। যা দেখে রাজা জানতে চাইলেন তারা সজ্ঞানে বা না বুঝে ঋষিবরের পক্ষে কোন অন্যায় কাজ করেছে কি-না ?
সৈনিকেরা উত্তর দিল- “মহারাজ! আমরা কোন দোষ করেছি বলে বুঝতে পারছি না। আপনি নিজে মহর্ষিকে জিজ্ঞেস করে তা জানার চেষ্টা করুন।” তখন রাজা তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীদের এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সকলেই নিরুত্তর রইলেন।
এমন সময় সৈন্যরা শৌচক্রিয়া না করতে পেরে কষ্ট পাচ্ছে দেখে রাজকন্যা সুকন্যা পিতাকে বললেন- “পিতা! আজ বেড়াতে বেড়াতে ঐ বশ্মিকের মধ্যে জোনাকির মতো উজ্জ্বল কোনো বস্তু দেখে কাঁটা দিয়ে তা বিঁধে দিয়েছিলাম।”
রাজা এই কথা শুনে আর দেরি না করে উইঢিবির নিকট ভৃগুনন্দনকে স্মরণ ও হাতজোড় করে বললেন- “মুনিবর! আমার কন্যা না জেনে আপনার কাছে অপরাধ করে ফেলেছে। তাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন।”
চ্যবন ঋষি বললেন— “মহারাজ! আপনার কন্যা রূপ-যৌবনে মত্তা হয়ে আমাকে অপমান করেছে। আমার চোখে আঘাত করেছে। তাই এই অহংকারী যুবতীকে বিয়ে না করে আমি শান্ত হব না।”
রাজা ঋষির কথা শুনে অন্য কিছু বিচার না করে তখনি মহাত্মা চ্যবনের হাতে নিজের কন্যাকে সম্প্রদান করলেন। এরপর মুনিবর প্রসন্ন হয়েছেন দেখে রাজা সৈন্য- সামন্ত সহ নিজের ভবনে ফিরে গেলেন। আর নব বিবাহিত রাজকন্যা তপস্বী স্বামীর সঙ্গে তপস্যা, ব্রত, অতিথি-আপ্যায়ন সহ অন্যান্য নিয়মকানুন মেনে স্বামীর পরিচর্যা করে ঐ বনেই জীবন কাটাতে লাগলেন।
এভাবে কিছুদিন চলার পর একদিন অশ্বিনীকুমারযুগল লাবণ্যময়ী সুকন্যাকে দেখে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— “ভদ্রে! তুমি কে ? তোমার স্বামীর নাম কি ? এই অরণ্যে কি করছো ? আমরা এ বিষয়ে শুনতে বিশেষ আগ্রহী ?”
লজ্জাবনত মুখে সুকন্যা বললেন- “হে দেবদ্বয়! আমি রাজা শর্য্যাতির কন্যা, মহাত্মা চ্যবনের সহধর্মিণী।”
অশ্বিনীকুমারেরা স্মিত হেসে প্রশ্ন করলেন— “কল্যাণি! তোমার পিতা কেন তোমাকে এই বয়স্ক স্বামীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। তোমার মত এত সুন্দরী দেবলোকেও সচরাচর দেখা যায় না। সামান্য বস্ত্রে অলংকারাদি না পরে তোমাকে কত মলিন দেখাচ্ছে । তুমি কেন এমন ভোগবিলাসহীন তপস্বিনীর জীবন পালন করছো ? তোমার স্বামী তোমাকে সুরক্ষা এবং ভরণ-পোষণ দিতে অসমর্থ। তাই কেন তুমি এখনো তাঁকে আঁকড়ে ধরে আছো ?”
সুকন্যা তখন বললেন— “হে দেবযুগল! আমি আমার স্বামীর প্রতি যথার্থই অনুরক্ত। আমার মন এ বিষয়ে কখনোই বিচলিত হবে না।”
অশ্বিনীকুমারদ্বয় পুনরায় বললেন— “আমরা তোমার স্বামীকে পুনর্যৌবন দান করবো। পরে তুমি আমাদের মধ্যে একজনকে স্বামী হিসাবে বেছে নেবে।”
সুকন্যা তাঁদের কথা শুনে স্বামী মহাত্মা ভার্গবকে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের প্রস্তাব শোনালেন। এবং মহাতপা ভার্গব তা অনুমোদন করলেন। স্বামীর সম্মতি পেয়ে শৰ্য্যাতি- কন্যা অশ্বিনীকুমারদের সেই মতো কাজ করতে বললেন।
তাঁরা বললেন- “বেশ, তোমার স্বামীকে এই জলের মধ্যে প্রবেশ করতে বলো।
তখন দেবতাদ্বয়ের বিধান অনুসারে মহর্ষি চ্যবন জলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। সেই সঙ্গে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ও সরোবরের জলে ডুব দিলেন।
একটু পরে তাঁরা তিনজনই সরোবর থেকে উঠে এলেন। তখন তাঁরা তিনজনই দেবোপম, যুবা পুরুষ! একই রকম তাদের বেশভূষা। তাঁরা একত্র হয়ে বললেন- “আমাদের মধ্যে স্বামীরূপে যাঁকে পছন্দ হয়, তাঁকে বরণ করো।”
চ্যবন-ভার্যা সুকন্যা অনেক কিছু বিচার-বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত নিজের স্বামী চ্যবনকে বেছে নিতে ভুল করেন নি। মহর্ষি চ্যবন তখন হৃত যৌবন, রূপ-লাবণ্য ও প্রিয়তমা স্ত্রী'কে ফিরে পেয়ে খুব খুশি হয়ে বললেন- “ভগবন! আমি বৃদ্ধ ও দুর্বল ছিলাম। আপনারা আমার রূপ-যৌবন ফিরিয়ে দিলেন, আমার স্ত্রী'কেও নতুন করে পেলাম। তাই আমি সবার সামনে দেবরাজকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করছি যে, আমি আপনাদের সোমপানের অধিকারী করবো।”
এই বলে চ্যবন দম্পতি দেবতাদের ন্যায় সেই অরণ্যে মহানন্দে বেড়াতে লাগলেন।
লোমশ মুনি বললেন- “হে রাজন! রাজা শর্য্যাতি চ্যবনের পুনর্যৌবন লাভ হয়েছে শুনে সস্ত্রীক কন্যা ও জামাতার সঙ্গে দেখা করতে তাঁদের আশ্রমে এলেন। রাজ- দম্পতি নতুন রূপে মেয়ে-জামাইকে চাক্ষুষ দেখে খুবই আনন্দ পেলেন।
ভৃগুনন্দন তখন শ্বশুরমশাই শর্য্যাতিকে বললেন- “হে রাজা! আমি আপনার যজ্ঞ সম্পাদন করবো। আপনি যজ্ঞসামগ্রী সংগ্রহ করে যজ্ঞের আয়োজন করুন।”
এরপর, নির্দ্দিষ্ট দিনে বিধি-সম্মত উপায়ে ভৃগু নন্দন চ্যবন রাজা শর্য্যাতিকে যজ্ঞ করালেন। সেই যজ্ঞে মহর্ষি চ্যবন অশ্বিনীকুমারদের নিমিত্ত সোমরস গ্রহণ করলে ইন্দ্র তাঁকে বারণ করে বললেন— “অশ্বিনীকুমারেরা দেবতাদের চিকিৎসক, তাঁরা অন্যান্য দেবতাদের সমকক্ষ নন, তাই সোমরস পানে তাঁদের কোনো অধিকার নেই।”
চ্যবন প্রত্যুত্তরে বললেন- “হে দেবরাজ! যাঁরা আমার বার্ধক্য দূর করে যৌবন দান করেছেন তাঁরা সোমরসপানে বঞ্চিত হবেন— এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁরাও দেবতা, তাঁদেরও সোমরস পানে অধিকার আছে।”
ইন্দ্র বললেন- “যাঁরা কেবলই চিকিৎসক, নানা রূপ ধারণ করে কারণে অকারণে মর্ত্যলোকে ঘুরে বেড়ায়। যজ্ঞে তাঁদের কোন ভাগ থাকতে পারে না। তাঁদের সোমরস পান করতে দেওয়া মোটেই সঙ্গত নয়। ”
এভাবে যুক্তি-প্রতিযুক্তি কিছুক্ষণ চলার পর দেবরাজের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে মহর্ষি চ্যবন স্বয়ং অশ্বিনীকুমারদের অংশ গ্রহণ করলেন। ইন্দ্র তা দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন— “হে তপোধন! যদি আপনি তাঁদের হয়ে সোমরস গ্রহণ করেন, যজ্ঞের ভাগ নেন, তাহলে এই ভীষণ বজ্র ছুঁড়ে আপনাকে সংহার করবো।”
এই বলে শচীপতি উগ্রমূর্তি ধারণ করে ভার্গবকে বজ্র দিয়ে ধ্বংস করতে উদ্যত হলে ভৃগু নন্দন ইন্দ্রের দুটি বাহু অচল করে দিলেন। তারপর তাঁর অনিষ্ট করার জন্য মন্ত্রোচ্চারণ করে হুতাশনে আহুতি প্রদান করলেন। সঙ্গে সঙ্গে হুতাশন থেকে ‘মদ’ নামে এক ভয়ংকর দৈত্যের আবির্ভাব ঘটলো। তার মুখমণ্ডল ভীষণাকার। দাঁতগুলি বিকট। চোখ দুটি আগুনের মত জ্বলন্ত। বাহুগুলি দীর্ঘাকার। সেই মহাসুর ভয়ংকর গর্জন করতে করতে ইন্দ্রকে খেয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে ছুটে এলো ।
দেবরাজ ইন্দ্র সেই দৃশ্য দেখে মহর্ষিকে বললেন— “হে বিপ্ৰ! আমি ঘোষণা করছি আজ থেকে অশ্বিনীকুমারেরা অন্যান্য দেবতাদের সমান মর্যাদা পাবেন। অন্য সকলের মতো যজ্ঞের ভাগীদার হবেন। সেইসঙ্গে আমি আরও ঘোষণা করছি যে, অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আপনি যেমন আজ সোমরস পানের অধিকারী করলেন তেমনি আপনার যশ ও ক্ষমতা সর্বত্র প্রচারিত হবে। এছাড়া রাজা শর্য্যাতির কীর্তি জগতে বন্দিত হবে। এখন আপনি শান্ত হোন। আমার প্রতি আপনার ক্রোধ সম্বরণ করুন।”
দেবরাজ ইন্দ্রের মুখে এমন বিনয়ী কথাবার্তা শুনে মহাত্মা চ্যবনের ক্রোধ দূর হলো। তিনি দেবরাজকে মদাসুরের আক্রমণ থেকে মুক্তি দিলেন। পরে সেই মদকে স্ত্রী’জাতি, পান, পাশা খেলা ও মৃগয়া এই চার ভাগে বিভক্ত করে দিলেন। এরপর মহাতপা চ্যবন দেবরাজ ইন্দ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় সহ অন্যান্য দেবতাদের সোমরস পান করিয়ে যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন।
0 Reviews