Read more
ক্লাসিসিজম ও রোম্যান্টিসিজম
ক্লাসিসিজম ও রোম্যান্টিসিজম—দুইটি পৃথক সাহিত্য মতবাদ হলেও, এ-দুয়ের মধ্যে কোন মৌল বিরোধ নেই বা এ-দুয়ের মধ্যে কোন স্পষ্ট ভেদরেখা টেনে দেওয়াও সম্ভব নয়। রোম্যান্টিক ভাবধারাকে ক্লাসিসিজমের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া রূপে বর্ণনা করা হলেও অনেকেই মনে করেন যে এরা পরস্পরের পরিপূরক হয়ে একই সাহিত্য অবয়বে স্থান পেতে পারে। প্রখ্যাত শিল্পতত্ত্ববিদ বেনেদেত্তো ক্রোচে বলেছেন 'A great poet is both classic and
Romantic'। আসলে, পার্থক্যটা দেখার ও দেখানোর। বাস্তবকে বাস্তবরূপে দেখানো একরকম, আবার বাস্তবকে কল্পনার জারণে জারিত করে সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধের মাধ্যমে বাস্তবরূপে পরিবেশন করা অন্যরকম। যুক্তি, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা দিয়ে বর্ণিত বাস্তব ক্লাসিক, অন্যদিকে ভাবাবেগে পরিশীলিত বাস্তব রোম্যান্টিক।
যুক্তি, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতার নিরিখে বস্তুজগতের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে এবং রচনারীতির আভিজাত্য ও পরিমিত বিন্যাস বিধি বজায় রেখে ক্লাসিক সাহিত্য রূঢ় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবকে স্থূল ও সহজবোধ্য ভাষায় চিত্রিত করে। ক্লাসিক সাহিত্যের বাস্তব প্রত্যক্ষ, সংহত ও সংযত (Classic art Portrays the finite ) ।
অন্যদিকে রোমান্টিক সাহিত্যে ব্যক্তিগত পছন্দ বড় হয়ে ওঠে এবং রোম্যান্টিক কবি যুক্তিহীন উন্মাদনায় এবং বুদ্ধিহীন উত্তেজনায় প্রত্যক্ষ বাস্তবকে পরিহার করে শব্দঝঙ্কার, ছন্দবৈচিত্র্য এবং অলঙ্কারের অভিনবত্বে গঠন করে এমন এক কল্পজগৎ যা ব্যঞ্জনাময়, স্বপ্নাতুর, বিস্ময়ীভূত এবং আনন্দময়। রোম্যান্টিক প্রবণতা তাই দূরযানী ও দূরাভিসারী এবং অসীমের প্রতি ধাবমান (Romantic art Portrays the infinite)।
ক্লাসিক সাহিত্য ঐতিহ্যের অনুগামী বলে প্রচলিত নিয়মকানুন, সমাজ ও ধর্মীয় অনুশাসনকে মেনে চলে, মানবজীবনের গৌরবময় দিকগুলিকে তুলে ধরে এবং চারিত্রিক সমুন্নতি রক্ষার জন্যে শৌর্য, বীর্য, ত্যাগ, তিতিক্ষাকে মহিমান্বিত করে তোলে।
অন্যদিকে রোম্যান্টিক সাহিত্য বিপ্লবী মনোভাব নিয়ে ঐতিহ্য এবং প্রচলিত নিয়মাদির বিরোধিতা করে, বিষাদময় গ্লানি, হতাশা, বেদনা, অতৃপ্তির যন্ত্রণায় মানবজীবন আন্দোলিত
হয়।
ক্লাসিক সাহিত্য তন্ময় এবং এর গতি কেন্দ্র অভিমুখী, কিন্তু রোম্যান্টিক সাহিত্য মন্ময়, তাই এর গতিও কেন্দ্রাতিগ।
উভয় প্রবণতার মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মহান কবিদের কর্মকাণ্ডে এ দুয়ের পাশাপাশি অবস্থান খুব একটা বিস্ময়কর নয়। পিউরিটান যুগে, পিউরিটান ঘরাণায় পিউরিটান মিল্টনের জন্ম। তবু তিনি ‘belated Elizabethan' কেননা তিনি তাঁর 'প্যারাডাইস লষ্ট'-এ বাইবেলের বিষয়বস্তুর উপর রেনেসাঁ প্রভাবিত মানবতাবাদ আরোপ করেছেন।
"Alone among the Poets, he endeavoured to blend the
spirit of Ren- aissance and Reformation"-Legonis তাঁর মহাকাব্যের প্রাচীন ক্লাসিক স্বীকৃতির পাশাপাশি শাতান চরিত্রে রেনেসাঁ প্রভাবিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ছায়াপাত ঘটেছে। এমনই ঘটেছে আদম ও ইভের ক্ষেত্রেও। নির্বাসিত হতে হবে জেনেও আদম তার নর্ম সহচরীর সঙ্গে নির্বাসন দণ্ড ভাগ করে নিয়েছে। একই ধরণের সমন্বয় ঘটেছে তাঁর ‘স্যামসুন অ্যাগেনিস্টস'-এ। এখানেও বাইবেলের গল্পাংশের উপর রেনেসাঁর প্রভাব বর্তমান।
মিল্টনের ক্লাসিক মহাকাব্যে যেমন রেনেসাঁর প্রভাব পড়েছে, তেমনি রোম্যান্টিক যুগের পথিকৃৎ James Thomson-এর 'The season' কবিতায় প্রভাব পড়েছে ক্লাসিক ছন্দের। ঋতুর বর্ণনায় কবিতাধর্ম আত্মলীন ও বস্তুলীন। চিত্রময়তা, মানবপ্রীতি এবং দার্শনিক প্রেরণা রোম্যান্টিক মনোভাবজাত। কিন্তু তার মধ্যে ভাষা ছন্দ ও অলংকার নিঃসন্দেহে ক্লাসিক, জনসনের ভাষায়, "His blank verse is no more
the blank verse of Milton." মধুসূদনের ঐতিহ্যবাহী ‘মেঘনাদ বধ' সার্থক ক্লাসিক মহাকাব্য। বাল্মীকি রামায়ণের এক মর্যাদাপূর্ণ আখ্যান, সমুন্নত চরিত্রাবলী, সনাতনপন্থী ভারতীয় আদর্শ, কাব্যরচনায় কবির যুক্তি বুদ্ধি ও, অভিজ্ঞতার নিরিখে প্রশান্ত দূরদৃষ্টি ভাষা-ছন্দ-অলঙ্কারের সুপরিমিত বিন্যাস–এ সবই কাব্যটির ক্লাসিক ধর্মীতার নিদর্শন। কবির মানসিকতাও ক্লাসিক ধর্মী।
“কিন্তু ক্লাসিক কাব্য যতটা চমক সৃষ্টি করে, কালক্রমে তার সে চমক আর থাকে না। অধ্যাপক ও শিক্ষার্থী মহলের বাইরে তার স্থান ক্রমে সঙ্কুচিত হয়ে আসে। মধ্যযুগ ও আধুনিক কালের মহাকাব্যের এই একই নিয়তি”, ........বলেছেন ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। মিল্টনের পাঠক সংখ্যা সীমিত, হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্রের পাঠক প্রায় বিরল। কিন্তু মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। মধুসূদনের মেঘনাদ বধের জনপ্রিয়তা বাড়ার কারণ সন্ধান করতে গিয়ে ডঃ বন্দ্যোপাধ্যায় যে প্রশ্ন রেখেছেন তার উত্তরও দিয়েছেন।
“মেঘনাদ বধ একদিক দিয়ে মধুসূদনের অন্তর্জীবনের প্রচ্ছন্ন ইতিহাসও বটে, এ যেন তাঁর আত্মজীবনীর একটি ছিন্নপত্র। তিনি কি রাবণের ছদ্মবেশ? অনন্ত আশার শোকান্ত সমাধি রাবণের শেষ পরিণাম। ‘ছিল আশা’–এ শুধু তাঁর রাবণের নয়, তাঁরও স্বগতোক্তি।”
ডঃ সুবোধ সেনগুপ্তও একই কথা বলেছেন। তাঁর মতে এই কাব্য মধুসূদনের আত্মদর্শন। এই আত্মদর্শন স্বর্ণলঙ্কার নৃপতি রাবণের চরিত্রে, রাজপুত্র ইন্দ্রজিৎ-মেঘনাদে। রাবণের জীবনের প্রতিটি স্তরে কবির আত্মার প্রতিফলন ঘটেছে—উভয়েরই এক স্বপ্নধ্বংসী আর্তনাদ।
এসবই ক্লাসিক নীতির বিরোধী। কবি এখানে রাবণের মধ্যে আত্মলীন, বস্তুলীন হওয়ার নিদর্শনও কম নয়। তিনি রামায়ণের আদর্শ হতে সরে এসে রেনেসাঁর আলোকে রাবণ চরিত্রকে নিজের মনের মাধুরী দিয়ে সৃজন করেছেন। সীতা-প্রমীলারা বাঙালি ঘরের বধূতে রূপান্তরিত হয়েছে। রামায়ণে যারা উপেক্ষিত, তাঁরাই এ কাব্যে মহত্বের গৌরবে মণ্ডিত।
এই কাব্যে লিরিকের বন্যায় ভেসে গেছে ক্লাসিকের রচনাশৈলীর আভিজাত্য। কবির মানসগঠনটাই যতটা না ক্লাসিকধর্মী, তার চেয়ে অনেক বেশী লিরিকধর্মী। ডঃ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় সেই কারণেই বলেছেন,
“মেঘনাদ বধ কাব্য রচনার আয়োজনের মধ্যে কোন ত্রুটি ছিল না, কবি মহাকাব্য রচনার জন্য সচেতনভাবে প্রস্তুত হয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অশ্রুপ্রবাহে মহাকাব্যের
বিশালমূর্তি দিগন্তে ভেসে গেল। এখনও পাঠক মধুসূদনের জীবন কথা বুঝতে পারে না,
ভুলতে পারে না এই নির্জন, নিঃসঙ্গ কাব্যমূর্তিটিকে।”
ইন্দ্রজিতের এসবই রোম্যান্টিকতার বৈশিষ্ট্য। এখানে আছে বিস্ময়ের কল্পরাজ্য। রাবণ ও
বীরত্ব, তাদের দেশপ্রেম, প্রমীলার পতিপ্রেম সবই বিস্ময়ের রাজ্যে পাঠককে পৌঁছে দেয়। রহস্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে প্রেতপুরী নরকের বর্ণনা। ক্লাসিক কাণ্ডের উপর রোম্যান্টিক পুষ্পের বিকাশ ঘটেছে কাব্যের ৪র্থ সর্গে। সমগ্র সর্গটি গীতি উচ্ছ্বাসে পূর্ণ। মূল কাহিনী হতে সরে এলেও ক্লাসিক আদর্শ মেনে তিনি রাম ও লক্ষণকে ছোট করেননি, আদর্শ বোধেও কোন ত্রুটি নেই। রোম্যান্টিক মননের ছটায় তিনি রামায়ণকে নতুনভাবে পরিবেশন করেছেন। এই কাব্যদেহে তাই দুই বিপরীত ভাবধারার একত্রে সন্নিবেশ ঘটেছে। মহাকাব্যের কাঠামোয় একই বৃত্তে দুটি ফুলের মত ক্লাসিক ও রোমান্টিক আদর্শের সমন্বয় ঘটেছে।
0 Reviews