Read more
বাংলা সাহিত্যে রোম্যান্টিকতা
বাংলা সাহিত্যে রোম্যান্টিকতার স্ফূরণ ঘটেছে চর্যাপদে। চর্যাপদের অভ্যন্তরে সহজিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্মুখীন গূঢ় সাধনরহস্য বা ধ্যানতন্ময়তা প্রচ্ছন্ন থাকলেও চর্যাপদকর্তাগণ দেহের মাধ্যমে দেহাতীতের সাধনায় এবং রূপভোগের মধ্য দিয়ে অরূপের অন্বেষণে ব্রতী হয়েছেন। তাঁদের অশান্ত ব্যাকুল হৃদয় মিলনোত্তর মহাসুখে সমাচ্ছন্ন। চণ্ডালী, ডোম্বী ও শবরীর অবয়বে মিষ্টিসিজম-এর প্রয়োগ কলার মধ্য দিয়েই রোম্যান্টিসিজম প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে। তত্ত্বের ধূসর ঊষর মরুভূমিতে চর্যার কবিরা রসের প্লাবন সৃষ্টি করেছেন। বাক্য রসে অন্বিত হলেই কাব্য হয় এবং চর্যায় বহুবিধ রস থাকলেও প্রধান হল আদিরস—“রাতি ভইলে কামরু জাঅ” বা “নিখিল কাহ্ন কাপালি জোই লাঙ্গ”—সবই আদিরসাত্মক। শবরী নারীর বর্ণনায় আছে রোম্যান্টিকতার আভাস।
“উঁচা উঁচা পাবত তাহি বসই শবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিন সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী।”
ডোম্বীর নৃত্যগীতে বর্ণনার মধ্যেও সেই একই সুর। “এক সো পদুমা চৌষী পাখুড়ী
তঁহি চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী।।
বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন'-এ গীতি কবিতার উল্লাস। পরকীয়া প্রেমে সন্দিগ্ধ নায়িকা বংশীখণ্ড হতেই যেন শাশ্বত প্রেমবোধে পাগলিনী।
“কে না বাঁশী বাত্র বড়ায়ি কালিনী নই কুলে / কে না বাঁশী বাত্র বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে / যাকে একদিন উপেক্ষা করেছিল তারই পায়ে সব সঁপে দিতে ব্যাকুলা রাধা বলে, “দাসী হআঁ তার পায়ে নিশিবোঁ আপনা”
দূরাগত অসীমের ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে,
“মুন্ডি আঁ পোনাইবোঁ কেশ জাইবোঁ সাভার/ যোগিনী রূপ ধরি লইবো দেশান্তর / যবে কাহ্ন না মিলিবে করমের ফলে / হাথে তুলি আঁ মো খাইবোঁ গরলে” বৈষ্ণব পদাবলীতে ঘটেছে রোম্যাটিকতার পরিপূর্ণ বিকাশ। প্রাক চৈতন্যযুগের বিদ্যাপতি বয়ঃসন্ধি হতে ভাবসম্মিলন পর্যন্ত রাধার প্রস্ফুটিত শতদলে পরিণত হওয়ার স্তরবিন্যাস বর্ণনা করেছেন। কৃষ্ণ হারা রাধার মানসিক অবস্থা ফুটে উঠেছে;
রোমান্টিসিজম
“সুন ভেল মদির সুণ ভেল নগরী / সুনভেল দশ দিস সুন ভেল সগরী” রাধার কণ্ঠে যেন Cosmic imagination
“জনম অবধি হাম রূপ নিহারল নয়। ক্রিপিত ভেল সেই মধুর রোল শ্রবণ হি সুনল শ্রুতি পথে পরশ না গেল।”
89
লাখ লুখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখল তব হিঅ জুড়ল না গেল।।” জীবনের গভীর উপলব্ধি যা জন্ম নিয়েছে এবং পালিত হয়েছে হৃদয়ের নির্যাসে;
সপনে আএল সখী মঝু পিয়া পাসে / তখুলুক কি কহার হৃদয় হুলাসে উঠলি লেহাই আলিঙ্গন বেরী / রহলি লজা-এ সুনি সেজ হেরী।” প্রেমের কবি চণ্ডীদাসের রাধা স্বয়ত্ত্ব যুবতী। ধ্যানস্বপ্নে রাধা বলে,
“সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম / কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো আকুল করিল মোর পরাণ”
প্রিয় বিরহে রাধা যেন ধ্যানগম্ভীর স্বর্ণপ্রতিমা
“সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘ পানে না চলে নয়নতারা
বিরতি আহারে রাঙা বাস পরে যেমতি যোগিনী পারা”
গভীরতম প্রাণবেদনায় রাধা সমর্পিত প্রাণা,
“বঁধু তুমি সে আমার প্রাণ / দেহমন আদি তোমারে সঁপেছি / কুল শীল জাতি মান।” রোম্যান্টিকতা চণ্ডীদাসের ভাবশিষ্য জ্ঞানদাসে সমধিক। রাধাভাব যদি চণ্ডীদাসে গভীরতর হয়, তবে জ্ঞানদাসে গভীরতম। চিত্রাঙ্কনে জ্ঞানদাস অপূর্ব।
“রজনী শাঙন ঘন
পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে
ঘন দেয়া গরজন বিগলিত চীর অঙ্গে
পূর্বরাগের হৃদয়ভেদী আকুতি জ্ঞানদাসের কবিতায়
রিমি ঝিমি শবদে বরিষে
নিন্দ যাই মনের হরিষে”
“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর / প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।” বেদনা সিক্ত আক্ষেপের ম্লান ছায়া,
“সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল
অমিয়া সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।”
ইংরাজী সাহিত্যের রোম্যান্টিক অনুধ্যান উনবিংশ শতকেই বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করে। প্রেম চেতনা, প্রকৃতি চেতনা, অধ্যাত্ম ভাবনা ও সঙ্গীতধর্মে বাংলা সাহিত্যের রোম্যান্টিসিজম পরিপুষ্ট হয়েছে। মধুসূদন রঙ্গলাল হেমচন্দ্র ক্লাসিক যুগকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। রোম্যান্টিকতার উচ্ছ্বাসে তাঁরা আবেগ তাড়িত হয়েছেন, প্রেম সংবেদনা, সৌন্দর্যচেতনা এবং মানবতাবাদী মনোভাবের স্ফুরণ থাকলেও তাঁরা কেউই পূর্ণ রোম্যান্টিক কবি হতে পারেননি। ওয়াডসওয়ার্থের মতই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অচ্ছেদ্য বন্ধনের কথা বলেছেন হেমচন্দ্র।
‘হায়রে প্রকৃতি সনে মানবের মন / বাঁধা আছে কি বন্ধনে বুঝিতে না পারি নতুবা যামিনী দিবা প্রভেদ এমন / কেন হেন মনে ওঠে চিন্তার লহরী।” অনুভূতিপ্রবণ, গীতিকবি এবং বায়রন ভাবশিষ্য নবীনচন্দ্র পানবমহিমার প্রবক্তা, তবু তিনিও খাঁটি রোম্যান্টিক নন, ফোনটি ছিলেন বিহারীলাল বিশ্বব্যাপী এক আত্মিক শক্তিকে অনুভব করে বিহারীলাল দেখেছেন তাঁর মানসরূপিনীকে আনন্দদায়িনীরূপে।
সাধারণভাবে স্বপ্নকে অর্থহীন ভাবা হয়। কিন্তু ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্ব পরাবাস্তববাদীদের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ফ্রয়েডের মতে অবচেতন স্তরের অবদমিত ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি স্বপ্নের মাধ্যমে প্রতীকী সন্তুষ্টি লাভ করে। বিচ্ছিন্ন এলোমেলো চিত্র ও কল্পনায় যেমন স্বপ্নের মধ্যে অবচেতন জগৎ প্রকাশ পায়, সুররিয়্যালিষ্টরা ঠিক তেমন ভাবেই চাইলেন যুক্তি-নিরপেক্ষভাবে automatic writing-এর সাহায্যে কবিতা ও শিল্পে প্রকৃত বাস্তবকে প্রকাশ করতে। ব্রেতো নিজেই অবচেতনকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে স্বপ্নাচ্ছন্ন বা মোহনিদ্রা (hypnosis) অবস্থায় স্বয়ংক্রিয় লেখা বা automatic writing অভ্যাস করেছিলেন। Automatic writing সম্বন্ধে Bloomsbury বলেছেন,
"By this technique, a writer's faculty of conscious
censorship is laid aside, allowing the chance encounter between two otherwise
unrelated elements which might produce the surreal image and intimate the
incursion of dream into reality.”
সুররিয়্যালিষ্টরা বিশেষ করে আগ্রহী ছিলেন স্বপ্নাচ্ছন্ন ও মোহাবিষ্ট অবস্থার পরিবেশনে। ফ্রয়েডের মতে মানবমনের অবচেতনস্তরে আবেগ ও অনুভূতির দুইটি তল আছে। একটি তলে জাতিগত ভাবে অবদমিত অভিজ্ঞতা ধরা থাকে এবং এই অবস্থায় ঐ অবদমিত অভিজ্ঞতা বা আবেগ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রকাশ পায়। অপর আর একটি তলে ব্যক্তিগত অবদমিত প্রবৃত্তি বা অভিজ্ঞতা ধরা থাকে। স্নায়বিক দৌর্বল্যের কোন রোগীকে কৃত্রিমভাবে মোহাবিষ্ট করে তার অবচেতন থেকে ঐ অবদমিত আবেগকে প্রকাশ করা হয় যা সচেতন অবস্থায় কোন প্রকারেই সম্ভব হত না। সুররিয়্যালিজমের মূল বক্তব্যও তাই,
.......drawing upon the sub-conscious and escaping the
control of reason or any Pre-occupation."
সুররিয়্যালিষ্টরা “true means of knowledge” বলতে বোঝেন “the study of dreams, of hallucination
of the Practice of automatic writing under the dictation of the
sub-conscious."
ব্রেতোঁ তাই মনে করেন যে সুররিয়্যালিজম হল অবচেতন মনকে প্রকাশ করার ঐকান্তিক প্রয়াস। অবচেতনে উদ্ভাসিত ভাবাবেগকে সাহিত্যে ও শিল্পে প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষে তাঁদের মত হল যে একমাত্র এতেই সত্যের সার্বিক পূর্ণতা থাকে। কল্পনার জারণে জারিত হয়ে, নিয়মতান্ত্রিকতার জালে আবদ্ধ থেকে যে সত্য সাহিত্য বা শিল্পে প্রকাশিত হয়, তা পরিপূর্ণ সত্য নয়—হয়তো কল্পনা সমৃদ্ধ সত্যের আভাসমাত্র। প্রকৃত সত্য হল সেটাই যা বাহ্যিক নিয়ন্ত্রকের প্রভাব বহির্ভূত অবস্থায় অবচেতন স্তর হতে উদ্ভাসিত হয়। কাব্যের মধ্যে যে সত্য তা ব্যক্তিমানস দ্বারা পরিশীলিত এবং পরিমার্জিত এবং প্রতীয়মান সত্যস্তরে উপনীত, কিন্তু অবচেতন হতে উদ্ভাসিত সত্যে উচ্চগ্রামের বাস্তবতা বা super reality আছে। তাই সুররিয়্যালিষ্টকে সর্বদাই সচেতন থাকতে হয় যাতে অবচেতনের মনের অনুভব সজ্ঞান চিন্তায় বা যুক্তির আলোকে পরিমার্জিত না হয়। এই Super reality স্তরে মগ্ন চৈতন্যের অতিবাস্তব চেতনলোকের বাস্তবের সঙ্গে মিলে ভাবজগতের এক তন্ময় লোক সৃষ্টি করল যেখানে স্বপ্ন, কল্পনা ও চিন্তার সঙ্গে মিলে মিশে একাকার।
সুররিয়্যালিষ্ট কবিতার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় হল প্রেম, বিদ্রোহ, স্বাধীনতা, আকাঙ্খার উদ্দাম প্রকাশ এবং মগ্নচৈতন্য বা অবচেতন জগতের ভাবনাকে প্রকাশ করা। প্রেমবিষয়ক কবিতায় বিশেষ করে যৌনতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এই কারণে যে প্রেম বিষয়ক কবিতায় প্রচলিত রীতি নীতিকে বর্জন করার মধ্যে এক ধরনের বিদ্রোহের আভাস থাকে। উদ্দাম আকাঙ্ক্ষার প্রকাশকে প্রাধান্য দেওয়ার পিছনে কবিদের বিশ্বাস হল যে আবেগই একমাত্র উৎকৃষ্ট অনুভূতি। কবিতা লেখার প্রচলিত রীতিনীতি যথা versification, rhythm প্রভৃতিকে তাঁরা সচেতনভাবে পরিহার করেন। ফলে, পদ্য ও গদ্যের প্রচলিত সীমারেখা মুছে যায়, শব্দ হয়ে ওঠে প্রতীকী লক্ষণাক্রান্ত। তবে একথা সত্য যে সুররিয়্যালিজমের শ্রেষ্ঠ কবিদের যেমন Breton ও Eluard প্রমুখদের কবিতায় এক অন্তর্নিহিত ছন্দ মাধুর্য অবশ্যই বজায় থাকে। সুতরাং, সুররিয়্যালিজমের মধ্যে যে লক্ষণগুলি বর্তমান তা নিম্নরূপ।
প্রথমতঃ, সুররিয়্যালিজম অবচেতনের অবদমিত প্রবৃত্তি বা আবেগের প্রকাশক। এইসব অবদমিত প্রবৃত্তি বা আবেগ যেমন যৌনতা, সমকামিতা, রুচির বিকৃতি, নীতিহীন কদর্য ভাবনা যে সমাজজীবনে আপত্তিকর বা নিন্দনীয় – তা সাহিত্যে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে এবং এর জন্য সুররিয়্যালিষ্টরা সর্বপ্রকারের প্রচলিত আদর্শ ও মূল্যবোধকে পরিহার করে।
দ্বিতীয়তঃ, সুররিয়্যালিষ্টরা অভিনব প্রতীকধর্মীতার সাহায্যে এবং প্রচলিত ছন্দবৈচিত্র্য ও আঙ্গিক বর্জ্জন করে চমকপ্রদ শব্দের প্রয়োগে যে সাহিত্য ভাবনা সৃষ্টি করেন, তা অনেক সময়েই দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। আপাত অসংলগ্ন ও প্রতীকধর্মী ভাবনার সম্যক অর্থ বোঝার জন্যে মনোবিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয়।
তৃতীয়তঃ, সুররিয়্যালিজমের উদ্ভব হয়েছিল ‘ডাডাবাদ' ও ফ্রয়েডীয় স্বপ্নতত্ত্বকে ভিত্তি করে। তাই সুররিয়্যালিষ্টদের বক্তব্য বোঝার জন্য এই দুই উপাদানের সম্যক অর্থ বোঝা দরকার।
0 Reviews