Read more
পাশ্চাত্য সাহিত্য ভাবনায় সুররিয়্যালিজম
ফরাসী সাহিত্যের সুররিয়্যালিষ্টরা তাঁদের ঋণ স্বীকার করেন সাদে (Marquis de Sade), বোদলেয়ার (Charles Baudelaire) এবং ম্যালার্মের (Stephene Mallarme) কাছে। প্রবক্তা আঁদ্রে ব্রেতো ছাড়াও সুররিয়্যালিজমের অন্যান্য কর্ণধাররা হলেন, লুই আরাগঁ (Louis Argon), অ্যামি সিজে (Aime' Ce'saire), রেনকার (Rene' Char), পল এলু (Paul Eluard)। সুররিয়্যালিজমের প্রভাব ক্রমশঃই ফ্রান্সের বাইরে ছড়িয়ে পড়তেই সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগ এবং চিত্রকলা-এর দ্বারা প্রভাবান্বিত হল। Max Ernst, Rene' Magritte এবং Joan Miro চিত্রকলায় সুররিয়ালিজমের প্রয়োগ করলেন এবং ক্রমে তা Salvador Dali'র চিত্রকলায় উৎকর্ষতায় উন্নীত হল। তিনি ফ্রয়েডীয় ভাবধারায় বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। লুই আরাগঁ-এর বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও সুররিয়্যালিজম ভাববাদে পুষ্ট। কম্যুনিষ্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় আরাগঁ এ বিষয়ে অধিক মনোযোগ দিতে পারেন নি। ব্রেতোঁ ১৯৩০ সালের Send Manifesto-তে ফ্রয়েড ও মার্ক্স-এর চিন্তাধারার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। ১৯৪৫ সাল থেকেই পরাবাস্তববাদ দেশবিদেশের তরুণ কবি ও সাহিত্যিকদের আকৃষ্ট করে এবং বর্তমান সময়েও এর প্রভাব কম নয় যদিও সংগঠিত সাহিত্য আন্দোলন রূপে সুররিয়্যালিজম ইতিমধ্যেই তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। কিন্তু সে সময়ে সুররিয়্যালিজমের প্রভাব এতই ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল যে ১৯৪৯ সালের সুররিয়্যালিষ্ট সেমিনারে প্যারিস শহরে প্রায় চব্বিশটি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল।
ইংরাজী সাহিত্যে ডেভিড গ্যাসকয়েন (David Gascoyne) এবং ডিল্যান টমাস (Dylan Thomas) সুররিয়্যালিজমের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। গ্যাসকয়েনের রচিত ব short sur'ev of surrealism' ফরাসী সাহিত্যের সুররিয়্যালিষ্ট আন্দোলনের এক প্রামাণ্য দলিল ! তাঁর কবিতায় বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। অচেতন স্তরের আবেগ অনুভূতির ক্রিয়াকলাপের পাশাপাশি মগ্নচৈতন্যে লুকিয়ে থাকা পাপবোধ বা ভয়-এর সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়।
ডিল্যান টমাস একজন মৌলিক কবি এবং তাঁকে বলা হয় 'to be a prophet of wild new romanticism'। এ যুগে রোম্যান্টিকতাকে যাঁরা সাহিত্যের উপজীব্য করেছিলেন, তাঁদের বলা হয় দি অ্যাপক্যালিপস্ (The Apocalypse), এবং ডিল্যান টমাস এই দলের পার্থকৃৎ। হেনরী ট্রিস এবং জে. এফ. হেন্ডী তাঁর উত্তরসাধক। তাঁর সাহিত্যকর্ম বিশাল এবং Eighteen Poems দিয়ে তিনি তা শুরু করেছিলেন। তাঁর কবিতার অসাধারণ চিত্রকল্পে বাইবেলের এবং ফ্রয়েডের চিত্রকল্প ও প্রতীককে জারিত করা হয়েছে, প্রেমের সঙ্গে যৌনতার প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটেছে এবং মানবমনের ধর্মসংক্রান্ত মনোবৈকল্যের পাশাপাশি অবদমিত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। অস্বাভাবিক প্রতীক চিহ্নের ব্যবহার তাঁর কবিতার উল্লেখযোগ্য দিক। "In old man's shank one
marrowed with my bone And all the herring smelling in the sea,
I sit and watch the worm beneath my nail wearing the quick
away."
ডিল্যান টমাসের ‘Twenty five Poems' (১৯৩৬)-এর দশটি ধর্মসংক্রান্ত সনেটে যীশু খ্রীষ্টের জীবনকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যৌনতার অনুষঙ্গে এবং এক্ষেত্রে যে প্রতীক ও রূপকল্প ব্যবহার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরনের।
সুররিয়্যালিজমের প্রভাব
সুররিয়্যালিজমের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অপরিশীম। সমগ্র বিশ্বব্যাপী এই ভাবধারা সকল প্রকার শিল্পমাধ্যমকে দীর্ঘকাল ধরে প্রভাবিত করেছে, কবিতার ধারায় এনেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। কবিতাকে আর নান্দনিক সৌন্দর্যপ্রকাশ মাধ্যম বলে ভাবা যায় না, ভাবা হয় পরাবাস্তব বা অধিবাস্তব জ্ঞানের ধারকরূপে। কবিতার ভাষা নিয়ে নিরন্তর গবেষণার ফলে ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশে এক নতুন ভাষাশৈলীর জন্ম হল। সর্বোপরি এই ভাবধারার প্রভাবে প্রেম, স্বাধীনতা, মূল্যবোধ প্রভৃতি প্রাচীন ধারণায় এল এক প্রচণ্ড অভিঘাত এবং সেই অভিঘাতের দোদুল্যমানতার মধ্যেই আধুনিক মানসিকতা রূপ পরিগ্রহ করল।
সুররিয়্যালিজমের ভাবাদর্শ কেবলমাত্র কবিতার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকল না, পক্ষান্তরে এই সীমাকে অতিক্রম করে প্রকাশ মাধ্যমের অন্যান্য দিক যেমন নাটক, থিয়েটার, সিনেমা, উপন্যাস, চিত্রকলা, ভাস্কর্য প্রভৃতি কলামাধ্যমকেও প্রভাবিত করল। চিত্রকলায় সুররিয়্যালিজমের ভাবধারাকে রূপায়িত করলেন চিরিকো (Chirico), ম্যাক্স আর্নষ্ট (Max Ernst), পিকাসো (Picasso) এবং সালভাদোর, ডালি (Salvador Dali) প্রমুখ চিত্রশিল্পীরা। অনেক সাহিত্যিকই সে সময় মনোজগতের অচেতন ও সচেতন অবস্থার বিশ্লেষণে স্ট্রিম অফ কনসাসনেস পদ্ধতিরও প্রয়োগ করেছেন। নাটক ও উপন্যাসে যাঁরা সুররিয়্যালিজম ভাবধারাকে প্রোথিত করেছেন, তাঁরা হলেন আন্তোনি আঁর্তো (Antonin Artend), ইউজিন ইয়োনেক্স (Engine lonesco), জাঁ জেন (Jean Genet), স্যামুয়েল বেকেট (Samuel Beckett), উইলিয়ম বরোস (William Burroughs), অ্যালান বার্নস (Allan Burns), বি. এস. জনসন (B. S. Jhnson) এবং হেনরী মিলার (Henry Miller)।
পরবর্তীকালে রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভেদ সুররিয়ালিজমের অনুগামীদের বিভ্রান্ত করে। সুরনিম্যালিষ্ট আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া রূপে একদল তরুণ “The New Apacalypse' নামে ১৯৩৮-এ এক আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের প্রবক্তারা হলেন Nicholas Moore, I. F. Hendry, G. S.
Fraser ও Henry Treece। এঁরা সুররিয়্যালিজমকে এক যান্ত্রিক দর্শন বলে উল্লেখ করলেন এবং অবচেতনের অসংলগ্ন আবেগ ও অনুভূতিকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সচেতন বিশ্লেষণের সঙ্গে এক সূত্রে বাঁধতে চাইলেন।
0 Reviews