ডাডাবাদ (Dadaisr)

ডাডাবাদ (Dadaisr)

Size

Read more

 


ডাডাবাদ (Dadaisr)

স্বল্পায়ু ডাডাবাদ এর জন্ম ১৯১৬-তে এবং মৃত্যু ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের মাঝামাঝি সাহিত্য আন্দোলনের ইতিহাসে ডাডাবাদ এক নতুন চেতনা সঞ্চারের চেষ্টা করলেও, সাহিত্য জগতে এই ভাববাদ কোন স্থায়ী আদর্শ স্থাপন করতে পারে নি এই আন্দোলনের বহু সদস্যই পরবর্তীকালের সুররিয়্যালিষ্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ডাডাবাদের অপমৃত্যু ঘটে

একই সময়ে ইউরোপের দুটি বিভিন্ন স্থানে ডাডাবাদের উদ্ভব হয় ১৯১৬-তে জুরিখে (zurich) রুমানিয়ার কবি Tristan Tzara, জার্মান লেখক Hugo Ball এবং কবি স্থাপতি Hans Arp মিলিত ভাবে যে আন্দোলন শুরু করেন, ঠিক সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই নিউইয়র্কে Marcel Duchamp, Man Ray এবং Francis Picabia একই আন্দোলনের সূচনা করলেন পরে এই দুটি দল একত্রে মিলিত হয়ে প্যারিসে এই মতবাদের প্রধান কেন্দ্র

স্থাপন করে

ডাডাইজমের মূল উদ্দেশ্য হল যা কিছু প্রাচীন সংস্কৃতি মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা, যা কিছু সত্য, স্থির, সনাতনতা ধ্বংস করা, সাহিত্যে শিল্পের তাবৎ কালের প্রচলিত আদর্শ, রূপরীতি আঙ্গিককে বর্জন করা ডাডাবাদীরা যে যুক্তি দেখালেন তার সারবত্তা অনুধাবন করার পূর্বেই তার চটকদারী মুন্সীয়ানায় চমৎকৃত হতে

হয়

তারা বললেন যে কোন বস্তুই চিরস্থায়ী নয় সত্য, স্থির, শাশ্বত সনাতন বলে কিছুই হতে পারে না এসবই প্রাচীনপন্থী সুবিদাবাদীদের আরোপিত তত্ত্ব তারা আরও বললেন যে স্বয়ম্ভূ চিন্তার প্রকাশই কবিতা এবং এই কবিতাকে ছন্দ, অলংকার, আঙ্গিক, ভাব ভাষার বন্ধনে কৃত্রিম করে পরিবেশনার বিরুদ্ধেই তাদের জেহাদ যা কিছু মননশীল বলে চালানো হয়তা একপ্রকারের চালাকি ভাঁওতা

কাব্যকে এই বন্ধন হতে মুক্তি দেবার জন্য তারা Automatic writing-এর কথাও বললেন এবং তাদের এই উদ্দেশ্য লক্ষ্যকে প্রচারার্থে ত্রিস্তান জারা 'ডাডা' নামে একটি সাময়িক পত্রও প্রকাশ করলেন তারা যে ক্লাব তৈরী করলেন তার নাম হল 'ভলটেয়ার ক্যাবারে' ত্রিস্তান জারা কবিতা রচনা সম্পর্কে যে ভাষ্য রচনা করলেন তা যেমনই হাস্যকর তেমনই বিস্ময়কর বিস্ময়কর এই কারণে যে এমন একটা ভাবনা তাদের মাথায় এল কেমন করে ত্রিস্তান জারা কবিতা সম্পর্কে লিখলেন, — খবরের কাগজের একটা অংশ বেছে নিয়ে কাঁচি চালিয়ে অংশটিকে টুকরো টুকরো করতে হবে তার পর টুকরা গুলো বেশ করে নাড়া দিয়ে, কিছু অংশ তার থেকে নিয়ে পর পর সাজালেই কবিতা হবে

হয়তো বক্তব্যটিতে বলতে চাওয়া হয়েছে মগ্নচৈতন্যের স্বভাবজ ভাবনাসূত্রের কথাযা এলোমেলো, বিশৃঙ্খল, এবং অসংলগ্ন 'ভলটেয়ার ক্যাবারে'তে চিত্র বিচিত্র পোষাকে সজ্জিত হয়ে অন্যতম সদস্য হুগো বস তার কবিতা পড়লেন,

gadji beri bimba

glandrii lauli lonni cadari

অসংলগ্নতা, অর্থহীনতা, দুর্বোধ্যতা সৃষ্টি করাই যেন হয়ে উঠল কবিতার প্রধান উদ্দেশ্য সুতরাং ডাডাবাদের অর্থহল উদ্ভট কল্পনা ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টা

'ডাডাবাদ' নামকরণের পিছনে বেশ কয়েকটি গল্প আছে হুলসেনবেক বলেছেন বে তিনি এবং Hugo Ball দুজনে মিলে জার্মান-ফরাসী ভাষার অভিধান থেকে 'Dada' কথাটি পছন্দ করেন ফরাসী ভাষায়ডাডা' অর্থ হল কাঠের ঘোড়া বা wooden horse শব্দটির মধ্যে যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ ভাব আছে মনে করেই তাঁরা এই মতবাদের নাম দিয়েছেন ডাডাবাদ ত্রিস্তান জারা আবার অন্যকথা বলেছেন কবিতার সংজ্ঞা নির্ণয়ের মতই এটাও একটা হাস্যকর বিষয় টেরাস কাফেতে বসে তিনি নাকি তীক্ষ্ণ ফলক বিশিষ্ট একটি ছুরি জার্মান ফরাসী অভিধানের প্রথম পাতা থেকে বিদ্ধ করতে থাকেন ছুরির ফলা যেখানে শেষ হয় সেখানেই নাকি 'ডাডা' শব্দটি ছিল ছুরি শব্দটিকে স্পর্শ করেছে, কিন্তু বিদ্ধ করেনি এইভাবেইডাডা' কথাটি তাঁদের মাথায় আসে আর একটি মত হল এই যে, শিশু যে কথাটি প্রথম উচ্চারণ করে তা হল 'ডা-ডা' শব্দটির মধ্যে শিশুর চৈতন্য, সারল্য ভাব প্রকাশের প্রথম উদ্যোগ আছে বলেই তারা এই শব্দটিকে গ্রহণ করেছেন এই তরুণের দল ভলটেয়ার ক্যাবারেকে তাদের 'মানছিনামানবো না' আন্দোলনের মূল কেন্দ্র করে বিশ্বময় তরুণ সমাজে একটা হৈ চৈ ফেলে দেয় এর ফলে শুধু প্যারিসেই এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকলো না! অচিরেই লণ্ডন নিউইয়র্কেও এই মতবাদ ছড়িয়ে পড়ল নিউইয়র্কে মার্সেল ডুক্যাম্প, ম্যানডে, ফ্রান্সিস পিকারি প্রমুখ শিল্পীরা ছবি এঁকে এবং২৯১' নাম দিয়ে এক পত্রিকা বের করলেন চিরাচরিত সৌন্দর্যবোধ যুদ্ধের বিরুদ্ধে ধিক্কার ঘোষণাই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল

কিন্তু প্রশ্ন এই যে, ডাডাবাদের মত একটা অস্থির মতবাদ কেন তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজে ভূমিষ্ট হয়েছিল, চিন্তাবিদেরা এই সম্পর্কে যা বলেছেন তার মধ্যে সে যুগের অস্থিরতা, হতাশা, ব্যর্থতা অবিশ্বাসই প্রাধান্য পেয়েছে ডাডাবাদের স্রষ্টাদের বুদ্ধিহীন ভাবার কোন কারণ নেই, তারা বুদ্ধিমান তো বটেই, সংবেদনশীলও প্রথম মহাযুদ্ধের ভয়াবহ হত্যালীলা, রাষ্ট্রনায়কদের অবিবেচনায় হাজার হাজার মানব সম্পদের অপচয়, স্বার্থান্ধ পাশবশক্তির নিয়ন্ত্রণহীন জঘন্য হত্যালীলা দর্শন করে তৎকালীন যুব সমাজের মধ্যে নে হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল— 'ডাডাবাদ' তারই স্বপ্রকাশ বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক পরিকাঠামো, প্রাচীন ঐতিহ্য পরম্পরাগত সংস্কৃতি, সাহিত্য শিল্প অন্যান্য মানবিক উৎকর্ষতায় প্রবহমান ধারাকে পরিবর্তন করে তারা এমন এক শিল্পের দাবী করে যেখানে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি যথেষ্ট প্রকাশ থাকবে, অবচেতনের উন্মোচন ঘটবে হয়তো মানস লোকের এই এলোমেলো চিন্তাস্রোতে দুর্বোধ্যতা, শৃঙ্খলহীনতা, পারম্পর্যহীনতা থাকবেতবু সেটাই হবে নিরস্ত্রণহীন মনের স্বপ্রকাশ

ডাডাবাদ ছিল প্রথম মহাযুদ্ধের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এই মতবাদ বুদ্ধদেবের মত উদ্ভূত হয়ে অচীরেই বাতাসে মিলিয়ে যায় ডাডাবাদী মনোভাব স্বস্থান খুঁজে পায় আন্দ্রে ব্রেতো এবং লুই আবার্গ এর সুর রিয়্যালিজমের মধ্যে

ইউরোপীয় সাহিত্যে ডাডাবাদ যেমন কোন স্থায়ী রেখা পাত করেনি, বাংলা সাহিত্যেও ডাডাবাদী কর্মকাণ্ডের তেমন নজির নেই রবীন্দ্র বিরোধিতা হতে কল্লোলের জন্ম হলেও তা ডাডাবাদের মত অস্তির অরুচিকর ছিল না রবীন্দ্রোত্তর যুগে জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব, প্রেমেন্দ্র এবং বিষ্ণু দে প্রমুখ কবিরা যে কবিতা রচনা করেছেন, তার মধ্যে কবিদের স্বকীয়তা এতই প্রবল যে, তাদের কবিতার মধ্যে মগ্ন চৈতন্যের যৌনতার দিকটি কোন ভাবেই প্রাধান্য লাভ করেনি কবি মাত্রেই কিছুটা কল্পনাশ্রয়ী মগ্নচৈতন্যের কারবারী নিরঙ্কুশ কবয়ঃ’--কথাটির উদ্ভব হয়তো সে কারণেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে জৈবিক বৃত্তি কেন্দ্রিক নৈরাশ্যবাদী হাংরি জেনারেশনের কিছু কবি নগ্নতাকে হাতিয়ার করে কবি সমাজে প্রবেশ করলেও, তাদের ডাডাবাদী বলা যায় নাকারণ ডাডাবাদের বিন্যাস প্রকরণ, বিষয় বৈচিত্র্য, ভাবনার সমারোহকোনটাই এদের ছিল না যৌনতার সুড়সুড়ি দেওয়াটাই তাদের প্রধান কাজ বলে মনে করা হয়েছিল

কবিসেনা গোষ্ঠীনিজেদের কবিতার মুক্তি ফৌজ বলে দাবী করে কবিতার ক্ষেত্রে তাঁরা জ্যামিতিক, গাণিতিক এবং ভৌগলিক বিচার বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন রীতিতে নতুনত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু তা ডাডাবাদী কবিতার মত অবচেতনের বিশৃঙ্খল আচরণের উদ্ভাস হয়ে ওঠেনি

প্রতিষ্ঠিত কবিদের অসংখ্য কবিতার মধ্যে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের ফলে ডাডাবাদের ছাপ হয়তো মিলতে পারে, কিন্তু কোন কবি বা কবিগোষ্ঠীকে ডাডাবাদী বলে চিহ্নিত করা

যায় না

 

0 Reviews