Read more
রোম্যান্টিকতার বৈশিষ্ট্য
ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, শেলী, কীটস্, বায়রণ প্রমুখ রোমান্টিক রিভাইভ্যাল যুগের সকল কবিই সার্বিকভাবে রোম্যান্টিক হলেও, রোম্যান্টিক ভাবধারার সকল বৈশিষ্ট্যই সকল কবির সমুদয় কবিতায় একইসঙ্গে প্রযুক্ত হবে—এমনটা কখনই সম্ভব নয়। এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় থাকাটাই সম্ভব। রোম্যান্টিক কবিতার বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ।
(১) প্রকৃতি প্রীতি জলকে বাদ দিয়ে বাষ্পের চিন্তার মতই প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে রোম্যান্টিক কবিতার কথা ভাবাই যায় না। আধুনিক ইমেজিষ্ট কবিরা প্রকৃতিকে পরিহার করতে চাইলেও রোম্যান্টিক কবিতায় প্রকৃতি এসেছে বিষয় হয়ে। প্রকৃতির মধ্যেই মানুষের আবির্ভাব এবং প্রকৃতির মধ্যেই তার লয়। Cult of noble savage-এর কবিরা আদিম প্রকৃতির সরলতা, শান্তি ও স্নিগ্ধতার যে ছবি এঁকেছিলেন, রূশো আহ্বান জানালেন সেই আদিম প্রকৃতির মধ্যে ফিরে যেতে। রুশোর এই আহ্বানে ওয়ার্ডসওয়ার্থ গভীরভাবে আস্থাশীল ছিলেন বলেই প্রকৃতির তিনি প্রেমিকও পুজারী; প্রকৃতির মধ্যে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন সখা শিক্ষক ও ঐশী শক্তিকে।
"The guide, the guardian of my heart, and foul of all my
moral being." কোলরিজের স্বক্ষেত্র অতিপ্রাকৃত জগৎ, ‘A world of suspence and
disbelief" প্রকৃতি এখানে প্রতীকী। শেলী ও প্রকৃতি প্রেমিক, তবে প্রকৃতির মধ্যে তিনি দার্শনিক সত্যের অনুসন্ধান ব্রতী। তাঁর অ্যালাষ্টার (Alaster) কবিতায় প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে নিঃসঙ্গ তরুণ পেয়েছে দিব্যদর্শন। কবি কীটস সুন্দরের পূজারী রূপে প্রকৃতির মধ্যে আবিষ্কার করেছেন সুন্দরের প্রকাশ ও লীলাক্ষেত্র। 'Ode to a Nightingale' এ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। 'Charm'd magic carements opening on
the foam
of Perilous seas, in facry lands forlone.”
(২) মানবপ্রীতি .....। ওয়ার্ডসওয়ার্ড ও শেলীর প্রকৃতি প্রেমই পরিণত হয়েছে মানবপ্রেমে। মানবপ্রীতির বীজ সুপ্তছিল ফরাসী বিপ্লবের ভাবধারায় এবং রূশোর প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার নির্দেশে। ওয়ার্ডসওয়ার্থের মাইকেল, লিচ গ্যাদারার, দি ইডিয়ট বয়, উই আর সেভেন, রেজোলিউসান অ্যান্ড ইণ্ডিপেন্ডেস্—প্রভৃতি কবিতায় কবি মানবপ্রীতির নিপ-নে স্বরূপ মানব সমস্যার বিভিন্ন চিন্তায় নিমগ্ন থেকেছেন। শেলীর প্রমেথিয়াস মানব প্রেমের জন্যেই শাস্তি পায়। ‘দ্য রিভোল্ট অব ইসমান’ এ রয়েছে মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্যে উৎসর্গীকৃত জীবনের লাঞ্ছনা। ‘কুইন ম্যাচ' কবিতায় আর্ত মানবের জন্য কবির চিন্তা এবং 'দি ট্রায়াঙ্ক অব লাইফ'-এ জীবন ভাবনা মানব প্রেম হতে উৎসারিত।
(৩) বিদ্রোহ ....। ফরাসী বিপ্লব, রুশো ও গডউইনের দর্শনপ্রভাব রোম্যান্টিক কবিদের ভাব বিদ্রোহী করে তুলেছিল। এ বিদ্রোহ সমসাময়িক ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজের যুগ্ম রচনায় প্রকাশিত হল নতুন যুগের কাব্যাদর্শ লিরিক্যাল ব্যালাডস। কোলরিজ নিয়ে এলেন মধ্যযুগীয় অতিপ্রাকৃত বাতাবরণ যা ব্লেকের কল্পরাজ্যের অনুষঙ্গী। কবি বায়রণের বিদ্রোহ সব কিছু নিয়মনীতি আচার ও আচরণের বিরুদ্ধে। জীবনকে উপভোগ করার অদম্য পিপাসা রয়েছে তাঁর কাব্যকবিতায়। শেলী দাবি করলেন ন্যায় বিচার, সমাজ বিপ্লব। তাঁর প্রমেথিয়াস আনবাউন্ড এবং দ্য রিভোল্ট অব ইসলাম'-এ রয়েছে সমাজ বিপ্লবের ইশারা। কীটস এর বিদ্রোহ কালের বিরুদ্ধে, স্কুলের বিরুদ্ধে। তিনি অনুভব করলেন 'a thing of beauty is a joy forever
|
(৪) সৌন্দর্যানুভূতি .... রোম্যান্টিক কবি কল্পনা সৌন্দর্য চেতনায় উৎসারিত। ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতির বাহ্য সৌন্দর্যের মধ্যে অন্তসৌন্দর্যকে উপলব্ধি করে বলেছেন। "To me the meanest flower that
blow can give Thoughts that do often lie two deep for tears' কোলরিজের সৌন্দর্যচেতনা পরিপূর্ণতা পেল অতিপ্রাকৃত চেতনায় । "A mighty fountain momently was forced Amid
whose swift half-intermitted burst" সৌন্দর্য সম্ভোগে বিহ্বল চিত্ত শেণী বলেন, "My soul is an enchanted
boat" বায়রণের অশান্ত চিত্তও সৌন্দর্য সমাহিত। "My altars are the mountains
and the ocean ও
আত্মিক শূন্যতাবোধকে উপন্যাসে প্রয়োগ করেছেন সাত্র, ক্যামু, কাফকা, জেমস জয়েস ও কেরল (Cayrol)। বাংলা উপন্যাসে এই দর্শনকে কাজে লাগিয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, বিমল কর, সমরেশ বসু প্রমুখ সাহিত্যিকেরা। কবিতার ক্ষেত্রে জার্মান কবি ফ্রেডরিচ হোল্ডারলিন (Friedrich Holderlin) এমনই এক অস্তিবাদী ব্যক্তিত্ব। বিচ্ছিন্নতার সঙ্কট যা ছিল নীৎসের চিন্তাভাবনা, তাকেই কবিতায় তিনি আভাসিত করেছেন। Schiller শিষ্য হোল্ডারলিন ‘singer bird' এর মতই হারিয়ে যাওয়া গ্রীসের গান গেয়েছেন, Evening Fantasy তে Subjective isolation এর কথা বলেছেন এবং Bread and wine এ actual Process of the withdrawal of
the gods' এর
যুক্তি দেখিয়েছেন। এ সবই তাঁর সত্তার নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন। ঈশ্বরের অস্তিত্বে তাঁর সন্দেহ নেই, ‘To be sure, the gods are living', তাঁরা ‘endlessly active'। কিন্তু আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি সেখানে তাঁরা to give little heed'। তিনি আরও বলেছেন ‘When the father averted his face
from man/ And very properly, mourning began over the whole earth.” কবি ইয়েটস-এর ‘The second Coming' এ অদ্ভুত এক আঁধার সংবেদনশীল প্রাণের বিনাশ চায়। ‘The falcon Can not hear the
falconer' 'the blood dimmed The tide is loosed.' Mere anarchy is loosed upon
the world'. কবি এলিয়ট এই অবস্থায় ছিন্নমূল মানুষের বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গতার কথা বলেছেন, 'we are the hollow men/ We are the
stuffed men/ Leaning together." Waste Land' এও রয়েছে যুদ্ধোত্তর পটভূমিকার ‘Tragic gloom ও despair'। বুদ্ধদেব বসুর মরছে পড়া পেরেকের গান' এ রয়েছে বিচ্ছিন্নতার অভিব্যক্তি। এক মূহূর্ত এই তবে তার মৃত্যু/ চৌরঙ্গিতে প্রেয়সী কলকাতা/ বিশাল নগর আকাশে রুমাল নাড়ে/ বিশাল দুপুর বাজায় সুদূর ভেঁপু/ চুমো খায় চোখে মেখলা সবুজ হাওয়া/। —এমনই বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা ধরা পড়েছে ‘নতুন পাতা' কবিতায়।
‘তিমির হননের গান'-এ জীবনানন্দ দেখেছেন কালনাগিনীর ছোবল, লিঙ্গরখানার অন্ন খেয়ে/ মধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে/ নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে ওঠে/ নর্দমায় নেমে/ ফুটপাত থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাতে গিয়ে/ নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা মরে যেতে জানে।' ‘সুচেতনা” কবিতাতেও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন', আধুনিক কবিদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় 'মানুষ যেভাবে কাঁদে' কবিতায় বলেছেন ‘এই বাঁচতে হবে বলে বেঁচে থাকে । জীবন যন্ত্রণার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি প্রশ্ন করেন, “আমি যখন অনঙ্গ অন্ধকারে হাত দেখি না, পা দেখিনা, তখন তোর জরায় ভর করে এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি'। সময় সঙ্কটের ছায়াপাত ঘটেছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কাঁচা-রোদ্দুর’এ। ‘চাপ চা জমাট রক্ত। ছায়ামূর্তি কে দাঁড়িয়ে ?/ ধুলো, ধুলো। আমি ইয়াসিন/ পূব-চটির হাটে যাব, লাহেরিডান্ডা ছাড়িয়ে/ সে কতদূর। সেই এক ভাবনা ঘুরছে। অন্য দল! মরচে পড়া চুল উড়ছে।”
0 Reviews