Read more
রোম্যান্টিকতাব লক্ষণগুলি নিম্নরূপ।
(১) রোম্যান্টিসিজম হল মানুষের স্বাধীন সত্তার বিকাশের অনুকূলে সকল প্রকার নিয়মনীতি ও সংস্কারের নিগূঢ় বন্ধনের বিরুদ্ধে এক প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিবাদ।
(২) রোম্যান্টিসিজমের দ্বিতীয় লক্ষণ হল সরলতা ও প্রকৃতির কাছে প্রত্যাবর্তন। এই মতবাদ ক্লাসিসিজম বা নিওক্লাসিসিজম যা যুক্তি ও বুদ্ধির সীমায়িত জগতে অভিজাত শ্রেণীর চালচিত্রণেই ব্যস্ত ছিল, তার সম্পূর্ণ বিরোধী।
(৩) মধ্যযুগে হারিয়ে যাওয়া গৌরবময় ও স্বপ্নময় যুগকে সাহিত্যভাবনার মধ্যে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা বা পুরানো মধ্যযুগীয় পরিবেশকে নতুনভাবে চিহ্নিত করাই রোম্যান্টিসিজমের তৃতীয় লক্ষণ।
(৪) এলিজাবেথীয় রোম্যান্টিক ভাবধারায় মানুষ তার হৃতমর্যাদা ফিরে পায় এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের রোম্যান্টিক ভাবধারায় আত্মার মুক্তি ঘটল অর্থাৎ, এমন এক চেতনার জন্ম হল যে চেতনাপ্রভাবে সুদূর অতীত হতে সমসাময়িক যুগ প্রবাহ একই ঐতিহ্যের বা একই উপলব্ধির রোম্যান্টিক মূর্ছনায় উদ্বোধিত হয়।
(৫) রোম্যান্টিক ভাবধারার কোন ধরাবাঁধা প্রতিষ্ঠিত নিয়ম বা তত্ত্ব না থাকায় স্রষ্টা তার প্রতিভার স্বাতন্ত্র্যে ও স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক ঘটনা বা তার উপাদানসমূহ হয়তো এক, কিন্তু স্রষ্টার অনুভূতির ক্ষেত্রে এই উপাদানসমূহের নব রূপায়ন প্রক্রিয়া সর্বদাই অনন্ত বৈচিত্র্যময়।
(৬) রোম্যান্টিকতার স্রষ্টারা নিজ নিজ মেধা ও প্রতিভার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হলেও সার্বিকভাবে এই ভাবধারায় মানব অনুভূতির সার্বজনীনতা সর্বত্রই দৃষ্ট হয়। 'Cult of noble savage' প্রবর্তিত প্রিমিটিভিজম অর্থাৎ কবি মিল্টনের আদম ও ইভের মত innocent Prototypal মানবতার প্রতি তারা অনুরাগী। কোন একটি বিশেষ যুগের সাহিত্য লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য হঠাৎ আরম্ভ হয়ে হঠাৎই শেষ হয়ে যায় না। আরম্ভের যেমন বিস্তৃত পটভূমিকা থাকে তেমনই যুগের পরিসীমার শেষ লগ্ন চিহ্নিত হলেও তার রেশ বেশ কিছুকাল শব্দ তরঙ্গের অনুরণনের মত বজায় থাকে। শেক্সপীয়র, স্পেনসার এবং অষ্টাদশ শতকের ধ্রুপদী সাহিত্যসৃষ্টির মধ্য হতেই রোম্যান্টিক ভাবধারার স্ফুরণ ঘটে এবং জেমস টমসন, জন ডায়ার, এডওয়ার্ড ইয়ং, উইলিয়ম কলিন্স, রবার্ট গ্রে এবং উইলিয়ম ব্লেক প্রমুখ ইংরাজ কবিদের রচনাশ্রয়ী হয়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ এবং শেলীর যুগে পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। স্যর ওয়াল্টার স্কটের মৃত্যুকে ইউরোপে রোম্যান্টিকযুগের অবসান বলে চিহ্নিত করা হলেও ভিক্টোরিয়া যুগের লর্ড টেনিসন, ম্যাথু আর্নল্ড, রসেটি, সুইণবার্ন প্রমুখ কবিরা তাঁদের কাব্যরচনাকে রোম্যান্টিক কবিদের পথেই পরিশীলিত করেছেন।
রোম্যান্টিক আন্দোলনের আবির্ভাব স্থান মূলতঃ ব্রিটেন এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ ও কীটস প্রমুখ কবিদের রোম্যান্টিসিজমের পশ্চাৎপটে 'Graveyard school of Poetry - র কবিদের ‘Pre-romantic Sensibility'র অবদান প্রায় অনস্বীকার্য। গ্রেভ ইয়ার্ড কবিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তাঁরা এমন এক ধরনের কবিতা লিখেছিলেন যা হল 'mourfully reflective Poetry with
emphasis on the brevity of life and on the hope of immortality”। এঁরা সকলেই Augustan Principles of Decorum' অর্থাৎ অগাষ্টাস যুগধর্মের নিয়মনীতির বিরোধী। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধাংশে তাঁদের এই দর্শনের অভিব্যক্তি উপলব্ধির স্তরে পৌঁছাতে না পারলেও ঐ শতকের পরবর্তী অর্ধাংশে ইউরোপে রোম্যান্টিক ধারণার অগ্রদূত রূপে চিহ্নিত হয়। গ্রেভ ইয়ার্ড কবিতাবলীর মধ্যে Thomas Parnell-এর 'Night Piece on Death' এবং 'Robert Blair' এর 'The Grave' সমধিক বিখ্যাত।
বিষাদের সুর ও মানসিক আবেগের চিত্ররূপ ফুটে উঠেছে এডওয়ার্ড ইয়ং-এর “Thie complaint বা Night Thoughts on life, Death and
immortality” কবিতায়। কবিতাটি হিরোয়িক কাপলেটের পরিবর্তে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। রোম্যান্টিক ধারার পথিকৃৎদের বিখ্যাত হলেন জেমস টমসন। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত চারটি খণ্ডের 'The season' কবিতায় তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, কল্পনামাধুর্য, বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রেরণা, চিত্রময়তা এবং আত্মলীন ও বস্তুলীন দিকগুলির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে। স্পেনসারের ছায়াবলম্বনে রচিত তার রূপক কাব্য 'The castle of Indolence -এ দানবপ্রেমসহ রোমান্টিক কবিতার তিনটি লক্ষণ বর্তমান। স্পেনসারিয়ান স্টানজা ব্যবহার করে অলসতার প্রাসাদকে তিনি স্বপ্নময়তার আবেশে রহস্যময় করে তুলেছেন। টমসনের 'দ্য সীজন' কবিতার মাধ্যমে রোমান্টিক ধারণা সমগ্র ইওরোপে ছড়িয়ে পড়ে। জন ডায়ার-এর 'Gronger Hill'-এ আছে প্রাকৃতিক দৃশ্যের রোম্যান্টিক বর্ণনা। মার্ক একেনসাইড-এর ‘Pleasure of the Imagination' এবং টমাস ওয়ার্টসন এর ‘The pleasure of Melancholy' রোম্যান্টিক কল্পনা ও বিষাদের লক্ষণযুক্ত। হারভে-এর ‘Meditation among the Tombs' এবং টমাস গ্রের এলিজিতে মানবপ্রীতি, সহানুভূতি এবং বিষাদ বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করেছে। ম্যাকফারস এর 'Ossian' কবিতা বা
“কে তুমি গাহিছ গান আকাশমণ্ডলে জ্যোতির প্রবাহ মাঝে / বিশ্ব বিমোহিনী রাজে । কে তুমি লাবণ্য লতা মূর্তি মধুরিমা / মৃদু মৃদু হাসি হাসি / টিলাও অমৃত রাশি।
আলোয় করেছ আলো প্রেমের প্রতিমা”
বিহারীলালের সরস্বতী সৌন্দর্যপ্রেম ও জ্ঞানের মিলনসম্মেলনের এক রোম্যান্টিক ভাবব্যঞ্জনা— 'সারদামঙ্গল'-এ তাই কল্পলোকের অভিসার।
“আমারে বলে যে ওরা রোম্যান্টিক / সে কথা মানিয়া লই /
রসতীর্থ পথের পথিক।”
বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। অন্যত্রও তিনি একই কথা বলেছেন,
“এ গলিতে বাস মোর, তবু আমি জন্ম রোম্যান্টিক”
রোম্যান্টিক কবি রূপ হতে অরূপে, সীমা হতে অসীমের দিক ধাবমান হয়েছেন উন্মেষ পর্বের ‘সন্ধ্যা সংগীত', ‘প্রভাত সংগীত’, ‘ছবি ও গান’ এবং ‘কড়ি ও কোমল' কাব্যে। পরবর্তী পর্বের মানসী’, ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’ ও ‘চৈতালী’ কাব্যে কবির নিসর্গ প্রকৃতির সৌন্দর্য সম্ভোগ এবং মানবপ্রেমের বিবিধ ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে। ক্ষণিকায় গীতিপ্রাণতার প্লাবন, ‘নৈবেদ্য’-তে ঘোষণা করলেন “বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়'। গীতাঞ্জলিতে বিষাদ আছে, তবু আনন্দই ধ্রুবপদ, ‘গীতালী’-তে তিনি ফিরতে চান “বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় ভূমিতে”-তে। ‘বলাকা'র কবি যেন বিদ্রোহী, জরাবন্ধন ধ্বংস করে চিরযৌবনকে আহ্বান জানিয়েছেন। পূরবী-পুনশ্চ শ্যামলী-বনবানী-তে ঘটেছে পূর্বধারার অনুবৃত্তি।
রবীন্দ্র অনুসারী কবিদের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের জ্ঞানদীপ্ত মনন, রোম্যান্টিক আবেগ, গীতিপ্রাণতা, কল্পনাশক্তি ইত্যাদি থাকা সত্ত্বেও ইন্দ্রিয় নির্ভরতা ছেড়ে ভাবের গভীরে তিনি প্রবেশ করতে পারেন নি অর্থাৎ, হারফোর্ড কথিত 'extra-ordinary development of
imaginative sensibility ছিল না। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে বাঙালি রোম্যান্টিক কবিরূপে যাঁরা আত্মপ্রকাশ করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রূপসী বাংলার রোম্যান্টিক কবি জীবনানন্দ দাশ, শাশ্বতীর কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সুন্দর ও যৌবনের উপাসক অমিয় চক্রবর্তী এবং বুদ্ধদেব বসু, প্রেমের কবি অজিত দত্ত, “নাম রেখেছি কোমল গান্ধার'-এর রচয়িতা বিষ্ণু দে, সংবেদনশীল কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মানবাত্মার চারণ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সংবেদনশীল হৃদয় জাগরণের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং আত্মবীক্ষণ ও আত্মজিজ্ঞাসার কবি শঙ্খ ঘোষ। রোম্যান্টিকতার পথে পদচারণা করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সামসুর রহমান, আলোক সরকার ও আলোক দাশগুপ্ত এবং জয় গোস্বামী।
0 Reviews